২৯শে জুন,১৯৭১
ঐ দূর ছায়াপথ থেকে ভেসে আসছে বিজয়ের আলো। নক্ষত্রের গায়ে লাগা আবিরমাখা সেই আভা কাছে আসতে থাকে রেজার। দ্রুত, অতি দ্রুত! ধীরে ধীরে সেটি প্রখর আলোকপিন্ডে পরিণত হয়। সবে মাত্র এগারো পার করা রেজার মন আন্দোলিত হয়ে উঠে আলোর বাহার দেখে। এ আলো বুঝি শরীফ মামা নিয়ে আসছে। সেদিন মামা বলেছিল, বাংলার দামাল সন্তানদের থেকে স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। মামা বুঝি তাদের সাথে নিয়েই এই আলো ছিনিয়ে আনছে নক্ষত্র থেকে। তীব্র আলোয় ঝলসে দেবে সব পাক সেনাদের! পুড়ে ছারখার করে দেবে সেই জঘণ্য নরপশুকে, যার বেয়নেটে এখনও লেগে আছে সুমনা বুবুর লাল টকটকে রক্ত, আর ক্ষণে ক্ষণে শাপ বাণে বিদ্ধ করছে সকল রাজাকারদের। কিন্তু হঠাৎ মিইয়ে গেল কেন সব আলো? চোখ জ্বালা করছে কেন? মুখে কেন নোনা স্বাদ? রেজা সর্বশক্তি দিয়ে চোখ খোলার চেষ্ঠা করল কিন্তু তীব্র আলোয় কিছুই দেখতে পেল না। শুধু অনুভব করল সে, গায়ে কোন জোর নেই আর শরীরময় উৎসহীন অসহনীয় ব্যাথা। নিঃস্ব স্নায়ু ভেজারক্তের স্বাদ গ্রহণে ব্যাস্ত। রেজা হাতে অনুভব করল প্যান্ট পুরোটা ভিজে গেছে। ঝাপসা চোখে হাতের তালুতে কালচে রক্ত বৈ কিছু দেখা গেল না।
২৯শে জুন,১৯৯৬
রেজা অফিস থেকে বাসায় ফিরেই পেপার নিয়ে বসল। অফিসে পেপার পড়া তার সবথেকে অপছন্দের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত সকল খবর সে এড়িয়ে যায়। আজ হঠাৎ পেপার খুলেই পচিশ বৎসর পূর্বের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সোনালী দিনগুলোকে কিভাবে কালচে বেদনা গ্রাস করে নিয়েছিল সেসময়! শরীফ মামার মুক্তিফৌজে যোগদানের খবরটি কিভাবে যেন কাশেম মোল্লার কানে যায়, আর সেই রাতেই আলবদররা ঘেরাও করে ফেলে তাদের বাড়ি। শরীফ মামাকে না পেয়ে সবার চোখের সামনে ধর্ষণ করে রেজার বড়বোন সুমনাকে। বেয়নেট দিয়ে খুবলিয়ে সুমনার বুক ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সেদিন রাতে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছিল। রেজাদের বাড়ির টিনের চালে পড়া বৃষ্টির ফোটাগুলো যেন হৃদয় ছিদ্র করে বের হচ্ছিল ওদের। রেজাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল নানী। কিন্তু কাশেম মোল্লার নগ্নচক্ষুর লোলুপতা থেকে রেজাকে বাচাতে পারেনি নানী। রেজাকে যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা তখন মা আর নানীর বুকফাটা আর্তনাদের হেতু রেজা টের পায়নি। বুকে অফুরন্ত সাহস নিয়ে শুধু ভাবছিল, যাবার আগে শরীফ মামার বলে যাওয়া শেষ কথা "হেরোস নেভার ক্রাই!" বন্দী সেই দিনগুলো আর মনে করতে পারছে না রেজা। মাথার ওপর ১০০ ওয়াটের বাল্ব ঝুলিয়ে চোখে-মুখে গরম নোংরা তরল বর্জ্য ঢেলে দেয়া কিংবা প্রচন্ড তৃষ্ণায় পাকিদের মূত্র বিসর্জন! টানা ৯ দিনের নিষ্ঠুর নির্মমতা থেকে রেজা পালিয়ে এসেছিল দগদগে ঘা আর রেক্টাল প্রলাপস্ নিয়ে। আর ভাবতে পারছে না রেজা! পেপার রেখে এবার সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজল সে।
"বাবা! বাবা! রায়ান একেছে, রায়ান একেছে ! দেখো না, দেখোনা!", রেজার তন্দ্রা ভেংগে দিল তার প্রাণপ্রিয় একমাত্র সন্তান রায়ান। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে স্ত্রী রিয়া এবং আট বছর বয়সী রায়ানকে নিয়েই রেজার ছোট্ট সংসার। রায়ানের মায়াভরা তুলতুলে হাতে ধরা ড্রয়িংটি দেখে চমকে যায় রেজা। গ্রামের স্নিগ্ধ পটভূমিতে আকা ছবিটিতে নদীর পাশে দুটি ঘর আর পেজা মেঘে ভরা উদার আকাশ। ঘর দুটির একটির নিচে রেজা ও রিয়ার নাম লিখা আর অন্যটিতে রায়ান আর ওর হোমটিউটর আব্দুল এর নাম। আর ওপরে লিখা,"শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে!" রেজা কিছুটা বিস্ময় নিয়ে রায়ানের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকাতেই ভেংচি কেটে দৌড় দেয় সে। রেজা তার সন্তানের চমৎকার এ গুণটি নিয়ে ভাবার পূর্বেই অন্য এক ভাবনা আচ্ছন্ন করে তোলে তাকে। ড্রয়িংটি নিয়ে রিয়ার কাছে যেতেই রিয়া বলে ওঠে,"আমি বলেছিলাম না নতুন ছেলেটা খুব ভালো, দেখলে তো কত কম সময়ে আমাদের সোনামণিকে আপন করে নিয়েছে যে আমাদের দুজনকেই রায়ান অন্য ঘরে দিয়ে দিল! আর দেখেছো ড্রয়িং এর ওপরে কত সুন্দর একটি কথা লিখেছে। আমি নিশ্চিৎ! আব্দুল থাকলে রায়ানমণি এমন আরও অনেক সুন্দর কথা শিখতে পারবে।"
"হুম!বুঝলাম", প্রত্যুত্তরে রেজা বলল।
"হুম কি আবার, অফিস থেকে এসে এখনও ড্রেস আপ করনি? যাও এখনি ড্রেস আপ করে ফ্রেস হয়ে এস, আমি নাস্তা রেডি করছি!" রিয়াকে না চটানোর ভয়ে রেজা চুপিসারে বেডরুমে চলে গেল।
৮ই জুলাই,১৯৯৬
অফিসের কাজে মন দিতে পারছিল না রেজা। শুধু রায়ানকে ভাবছিল সে। তিন বছর বয়সে যখন ওর অটিজম ধরা পড়ে তখন ওর সুখের ঘরে নেমে এসেছিল কালো শোকের রুদ্ধতা। নিস্তব্ধতার অন্তঃপুরে রেজা ছিল দিশেহারা। চোখের সকল আলো যেন মিইয়ে যাচ্ছিল বেদনার্ত সন্ধ্যায়। কিন্তু নিরাশায় আলোর পথ দেখিয়েছিলেন পেডিয়েট্রিশিয়ান ডা. ইউসুফ রহমান। অটিজম যে কোন মানসিক রোগ নয় এবং বিশ্বের তাবৎ মহারথীদের অনেকেই যে অটিস্টিক ছিলেন, জানার পর রেজা স্বস্তিবোধ করেছিল। এরপর অটিজম নিয়ে বেশ পড়াশোনা করেছে সে। আইজ্যাক নিউটন থেকে শুরু করে বিশ্বখ্যাত সুরস্রষ্টা মোজার্ট, টমাস এডিসন, নিকোলা টেসলা, আলবার্ট আইনস্টাইন, স্ট্যানলি কুবেরিকসহ আরও অনেক বিশ্ববিখ্যাত থিংকট্যাংক অটিস্টিক ছিলেন। শুধু তাই নয়, রেজা যখন জানতে পারলো মাইক্রোসফটের স্রষ্টা বিল গেটসও এসপারগার সিন্ড্রোমের শিকার তখন গর্বে বুকটা প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল ওর। অটিস্টিক শিশুরা মারাত্মক রকম মেধাবী ও গঠনমূলক হয় এবং তাদের বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতিতে সমাজের শক্তিতে পরিণত করার উপায় সে শিখে নিয়েছে। রায়ান এত কম বয়সে যেকোন সালের যেকোন তারিখ বললে বার বলে দিতে পারে। কিছুটা গর্ব আর কিছুটা সুখ রেজার নিঃশ্বাসে বের হয়ে এসে অফিস রুমে একটি স্নিগ্ধ-কোমল পরিবেশ তৈরি করে। প্রশান্তি নিয়ে রেজা ফাইলওয়ার্ক করছিল, হঠাৎই ফোন বেজে উঠল।
"তুমি এখনই আসো। আমার রায়ানের প্রচন্ড জ্বর। রায়ানকে নিয়ে আমি ঢাকা মেডিকেলে আসছি। ডাক্তার বলেছে ভর্তি করাতে হবে। আমার খুব ভয় লাগছে! আমার রায়ানের কি হয়ে গেল!"রিয়ার কান্না বিজড়িত কন্ঠ রেজার প্রশান্তি এক নিমিষে স্তব্ধ করে দিল। মুহূর্তেই অফিস থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হল রেজা। হাসপাতালে পৌছে রিয়াকে পেয়ে হণ্য হয়ে রায়ানকে খুজছিল রেজার চোখ। রিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল শুধু নিথরতা। রিয়া রেজার হাত ধরে টেনে ডাক্তারের রুমে নিয়ে গেল। রেজা ডাক্তারের কাছে রায়ানের বাবা পরিচয় দিতেই ডাক্তার তাকে আশ্বস্ত করে বসতে বলল। রেজা বসতে পারলো না, ওর দেহের প্রতিটি কোষ আর্তনাদ করছে রায়ানের কথা শোনার জন্য। ডাক্তার কথা বলা শুরু করল।
"আপনি প্লিজ শান্ত হোন। আপনার ছেলে এখন সুস্থ্য আছে, আশা করি ও কিছুদিনেই ভালো হয়ে যাবে। তবে............................................................একটি ব্যাপার যেটি নিয়ে আমি বেশ চিন্তিত, আপনি একটু ঠান্ডা মাথায় আমার কথাগুলো শুনবেন প্লিজ! "
"ওকে, আপনি বলতে পারেন", চিন্তামগ্ন কন্ঠে রেজা বলল।
"আপনার স্ত্রীর নিকট শুনেছি আপনার ছেলে অটিস্টিক। তাই এ ব্যাপারটা ওকে যতনা শারীরিক ততটা মানসিকভাবে আক্রান্ত করেছে। হি ইজ এ ভিক্টিম অব স্যাডিজম। হি ওয়াজ মোলাস্টেড বাই এ পেডোফিলিক" ডাক্তার কথাটুকু বলার পর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রেজার পিঠে হাত রাখল। কথাগুলো রেজার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল কতটুকু বুঝা গেল না কিন্তু ওর অস্ফুট কন্ঠের আওয়াজে একটি নাম ভেসে এল,"আব্দুল!!"
রেজা দাড়িয়ে থাকার মত জোর পাচ্ছ না পায়ে। ধপ করে বসে পড়ল ফ্লোরে। মস্তিষ্কের বিকারগ্রস্থ ভাবনাগুলো আজ ছুটে পালালো কোথায় বুঝতে পারল না। শুধু নির্মম অসহায়ত্ব গ্রাস করতে লাগলো, ফিরিয়ে নিয়ে গেল একাত্তরের সেই দুঃস্বপ্নে।
একাত্তর চলে গেছে। আমরা এখন একটি স্বাধীন জাতি। বুক উচিয়ে নিজেদের স্বাধীনতার কথা বিলিয়ে বেড়াই। কিন্তু আদৌ কি আমরা স্বাধীন? আজ আমাদের শহীদ মিনারে পড়ে থাকে বিড়ির টুকরা-বাদামের খোসা, বধ্যভূমির শূণ্যতাকে পরিপূর্ণ করে তোলে নেশাখোরদের আড্ডা। মা-বোনের সম্ভ্রমে আঘাত করে যায় হায়েনারা, নিষ্পাপ-পবিত্র শিশুদের গোপনে ধর্ষণ করে যায় পাষন্ড পশুপাল। দেশের সুনিশ্চিৎ আলোকময় ভবিষ্যৎকে যারা এভাবে ধর্ষণ করে চলেছে তারা কি বাংলাদেশী? কখনও না, তারাই সেই পাকিদের ফেলে যাওয়া নোংরা বীজ, তারাই নব্য রাজাকার!!
না!! দাতে দাত চেপে দাড়িয়ে যায় রেজা। নতুন একটা যুদ্ধের সময় এসেছে। এ যুদ্ধে আবার দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে হবে। রুখে দিতে হবে সেসব হায়েনাদের। নইলে যে আমাদের নতুন প্রজন্ম আলো জ্বালবার পূর্বেই অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। এতো হতে দেয়া যায় না। রেজা ১১ বৎসর বয়সে যে মনোবল হারিয়েছিল এবার সেটা পুরোদমে ফিরে পেয়েছে। রিয়াকে পাশে ধরে সে জানালার দিকে তাকায়। ঐ যে আকাশ দেখা যায়, অন্ধকারকে ঠেলে আলো ঠিকরে পড়ছে অবিরত!
বি:দ্র: পেডোফিলিয়া নিয়ে নাজনীন আপুর একটি চমৎকার পোস্ট। শিশুদের যৌন নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একটি পেজ। আমার এই শীতনিদ্রা পোস্ট টি খুব প্রিয় একজন মানুষকে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:৩১