[ভাবিয়া পড়িও, পড়িয়া ভাবিও না].....................
মফিজ বাবুর কাজ করিবার কোনো দরকার ছিল না। তাহার ছিল গোলা ভরা ধাণের শীষ, আর পুকুর ভরা নৌকা! কিন্তু তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন কাজের লোক হইবার জন্যে। ইহা মোদের বাড়ির কাজের লোক নহে, ইহা হইল মস্ত বড় কাজের লোক যাহার হস্তমুঠে সকল কাজ কুক্ষিগত থাকে। চলিতেছে ডিজিটাল যামানা। দিনমজুর হইতে শুরু করিয়া রাতমজুর পর্যন্ত সবারই একখান ফেসবুক পেজ রহিয়াছে। স্কুল পড়ুয়া দুধের শিশুও নাকি পেজের ব্যাবসা করিয়া দিনানিপাত করিয়া বেড়ায়। এইজন্য মফিজবাবু THE DAILY MOTI নামক একখান ইংরেজি পেজ খুলিয়াই বসিলেন ফেসবুকে।
"হোয়াট ইজ করল্লা> ইট ইজ এ তিতা ফ্রুট লাইক ক্রোকোডাইল স্কিন"-হেন ইংরেজি জ্ঞান লইয়াও তাহার ইংরেজি লিখিবার এবং বক্তৃতা দিবার শখ ছিল। প্রয়োজন না থাকিলেও ইংরেজি পেজগুলাতে তিনি পোস্ট লিখিতেন এবং যথারীতি তাহা এডমিন প্রকাশ করিত না। মূলত এই পীড়া হইতেই তাহার নিজস্ব পেজ খুলিবার বাসনা জাগ্রত হইয়াছিল।
অবশেষে তাহার বটতলার উকিল বন্ধু উমাবাবু ওকালতি ব্যবসায় ধরা খাইয়া যখন কামলা খাটিবে বলিয়া মনস্থির করিল, তখন মফিজবাবু তহারে আনিয়া THE DAILY MOTI পেজের কো আডমিন বানাইয়া দিল। মফিজবাবু এখন সকালে ওঠিয়া এক হাতে ঘটি এবং অপর হাতে ল্যাপ্পু লইয়া টাট্টিঘরে গমন করেন। এক ঘটি জলের আধাখানিই অব্যাবহার্যরূপে পড়িয়া থাকে বলিয়া গন্ধে তাহার আশে-পাশে থাকাটা বেশ দুরূহ কার্যই বটে!
এইরূপে মফিজবাবু যতদিন পেজ লইয়া মাতাল হইয়া ছিল ততদিনে বাড়ির পাশের ডালিম বাগানের ডালিমগুলো পাকিয়া টসটসে হইয়াছিল সেইটাও খেয়াল করা হয় নাই, অপরদিকে তাহার বালিকা বধূ চারুলতা ধীরে ধীরে যৌবনে পর্দাপণ করিল! পেজ এডমিন মফিজবাবু এই মস্ত খবরটিও ভালো করিয়া টের পাইল না। বরং ভারত রাষ্ট্রের জনগণ বড় বেলুন রাখিয়া কেন ছোট বেলুনে আস্থা ফেরাতে পারছে না কিংবা সীমান্ত কাটাতারে কারাই বা ষড়যন্ত্র করিয়া জল খসাইয়া ক্রমশ স্ফীত হওয়া বেলুন ঝুলাইয়ে রাখিতেছে, ইহাই তাহার প্রধান ভাবনার বিষয় ছিল।
ধনীগৃহে চারুলতার কোনো অভাব ছিল না। পরিপক্ক ডালিমের ন্যায় অনাবশ্যকতার মধ্যে পরিস্ফুট হইয়া উঠাই তাহার দিনরাত্রির একমাত্র কাজ ছিল। এমন অবস্থার সুযোগ পাইলে বধূ স্বামীকে লইয়া অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করিয়া থাকে, প্রেমলীলা সংসারের সমস্ত সীমা ছাড়িয়া যায়, অনাবাদি জমিতে অশ্বগতিতে লাংগল চলে, ফসলে পরিপূর্ণ হইয়া যায় জমি। চারুলতার সে সুযোগ ছিল না। ফেসবুক পেজ লইয়া অন্ধকারে বিদিশার দিশা খুজিতে ব্যাস্ত মফিজবাবুরে অধিকার করা চারুর জন্য সম্ভব নহে। তাই তাহার অনাবাদি জমিতে কাস্মিন কালে কে লাংগল দিবে, কিংবা সেই লাংগলের কতটুকুইবা জোর থাকিবে, অত-শত ভাবিয়াই চারুর দিন পার হইয়া যায়। তবে বাড়ির পেছনে ডালিমবাগানের পাশে পতিত জমিখানিতে বেগুন চাষ করিবার অদম্য বাসনা জাগ্রত হইতে থাকে ক্রমেই!
এইদিকে চারুলতার সংগি হিসেবে উমাবাবুর পত্নী বাহারার আগমন ঘটিল, সেই সংগে বাহারার ছোট ভাই জামরুল। চারুর রূপ-যৌবনের ধারের কাছেও নাই বলিয়া বাহারার সহিত জমিল না চারুর। বরং জামরুলরে দেখিয়া চারু যেন আধার ঘরে মোমবাতি খুজিয়া পাইল। এখন শুধু ম্যাচ খিচাইয়া মোমবাতি জ্বালোনোর পালা।
জামরুল ভার্সিটি পড়ুয়া সাতনারীতে ছড়ি ঘুরানো আগুণের গোলা। আর লেখাপড়ার দিকে চারুলতার একটা স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল বলিয়া জামরুলের সহিত তাহার ভালোই জমিল। তাহাতে চারুর মন হইতে ডালিম বাগানের পাশে বেগুণক্ষেতের বাসনা এক নিমিষে বিদায় লইয়া সেইখানে ফুলের বাগান করিবার শখ জাগিল। জামরুলরে লইয়া চারু বাগানের কাজে মনোনিবেশ করিল। বাগানের এবড়ো-থেবড়ো জমি কয়েকদিনেই লাংগল মারিয়া চাষযোগ্য করিয়া দিল জামরুল। চারুর আনন্দ আর ধরে না, জামরুলরে লইয়া সারাদিন তাহার বাগানেই কাটিয়া যায়।
জামরুলেরও ফেসবুকে পেইজ ছিলো, যাহাতে জামরুল সারাদিন লাইক ভিক্ষা করিয়াই কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারিত না। কি করিলে ফ্যান বৃদ্ধি পাইবে তাহা লইয়া চারুর সহিত আলোচনা চলিতেছিল। অবশেষে চারুর বুদ্ধিতেই চারুর একখান উদ্দীপক ছবি আপলোড করিয়া তাহাতে ট্যাগ লাগাইয়া দিল,
"চুরি করেছ আমার শাড়িটা,
তাইতো আমি আজ খেমটা"!
আর যায় কই, পেইজে লাইকের বন্যা বইয়া গেল আর চারুর মনে বইল আন্ধার ঘরে মোমবাতি জ্বালানোর সুখ!
পুকুর হইতে স্নান করিয়া পুতঃপবিত্র হইয়া মন্দিরের দিকেই যাইতেছিল বাহারা। চারুরে জামরুলের সহিত কলকলাইয়া হাসিতে দেখিয়া তাহার পিত্তি জ্বলিয়া গেল। সাদা ভাতে নুড়ি খুজতে উস্তাদ বাহারা, চারুর চুলখোলা রূপ দেখিয়া বিমোহিত হইয়া চোখও ফিরাইতে পারিতেছিল না, আবার লাজ-শরমহীন মেয়েছেলের কান্ড দেখিয়া চুপও থাকিতে পারিতেছিল না। "আজ-কালকার মেয়েছেলে কি যে বেহায়া, গুরুজন দেখিলে আদাব তো দূর, ফিরেও চায় না! দূগ্গা, দূগ্গ......দূগ.......গ......" কথা শেষ না করিতেই ধপাশ!! বাগানের পাশের নোংরা পানির নালা খেয়াল ছিল না বলিয়া সদ্য পূজার জন্য স্নান করিয়া ফিরিতেই আবার কাদা ভর্তি নালায় পড়িয়া গেল বাহারা। হেন অবস্থা দেখিয়া চারু আকাশ-পাতাল এক করিয়া হাসি জুড়িয়া দিল। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এর বিহিত করিবে বলিয়া, চারুরে হাজারো শাপ-বাণে বিদ্ধ করিতে করিতে বাহারা আবার পুকুরপানে ছুটিল স্নানের নিমিত্তে!
চারুর সুখ আর সহিল না বাহারার। মফিজবাবুর নিকটে কিভাবে নালিশ করা যায় সেইটা ভাবিয়াই ঘন্টা পার করিয়া মাসও অতিক্রম করিয়া গেল বাহারার। চারুর কিছু না করিতে পারিয়া পাগল হইয়া আবোল-তাবোল বকিতে শুরু করিল সে। এইদিকে মফিজবাবুর একদিন ফেইসবুকে সার্ফ করিবার সময় হঠাৎ জামরুলের পেইজ চোখে পড়িল। উৎসুক হইয়া লাইক মারিতেই তাহাতে চারুর অর্ধবসনা ছবি চোখে পড়িল তাহার। মস্তকে রক্ত উঠিয়া গেল তাহার, তবু কি করিবে তাহা ভাবিতেই দিন পার হইয়া যাইতে লাগিল। চতুর জামরুল ভাব বুঝিয়া পালাইলো আর চারু সেই দুঃখে বিষপান করিল। সঠিক সময়ে জমিতে লাংগল না চড়াবার ভুল বুঝিতে পারিল মফিজবাবু। শুধুমাত্র লাংগলের ভুলে সুখের নীড় তাই নষ্টনীড়ে পরিণত হইল। চারুরে হারাইয়া মফিজবাবু চোখে আন্ধার দেখিতে লাগিল। আর এই আন্ধারই তাহারে আলোর দিশা দেখাইলো। চারুরে ভুলিয়া ধূতিতে শক্ত করিয়া গিট লাগাইয়া উঠিয়া দাড়াইলো মফিজবাবু। THE DAILY MOTI র সাফল্যের পর মফিজবাবু নতুন পেজ খুলিতে মনস্থির করিল। পেইজের নাম হইবে, আন্ধারের আলো!
বি: দ্র: রবিবাবুর ভক্তদের নিকট ক্ষমাপ্রর্থনা করিতেছি একটি ক্লাসিক গল্পের রিমিক্সের জন্য। সেইসাথে কারও সহিত মিল খুজিবার হীন চিন্তা হইতে দূরে থাকিতে অনুরোধ করিতেছি, অন্যথায় মিল খুজিতে কাকের মাথায় তাল পড়িলে লেখক দায়ভার লইতে সম্পূর্ণ অবাধ্য থাকিবে!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:৩২