আমাদের রাজশাহী ভ্রমনের পরের দিন চাপাইনবাবগঞ্জ ভ্রমন। হাতে সময় কম থাকায় সকাল সকাল খাওয়ার পাঠ সেরে চেপে বসলাম আমাদের জন্য নির্দারিত মাইক্রোবাসে। রাস্তার দুই ধারে সবুজ়ের সমারোহ, আলো আধারির খেলা, আর মাইলের পর মাইল আমের বাগান দেখেতে দেখতে কখন যে তিন ঘন্টার মত পার হয়ে গেছে তার খয়াল নাই। চলে এলাম আমের রাজ্যে, চাপাইনবাবগঞ্জ শহরে। চাপাইনবাবগগঞ্জে বেশ কিছু দেখার জায়গা আছে, আমরা আজ মুলত খানাইয়া দিঘি মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ আর কানসাট বাজার দেখব।
চা পানের বিরতি আর দুপুরের খাওয়ার অর্ডার দিয়ে আমরা চল্লাম খানাইয়া দিঘি মসজিদের দিকে। যে তিনটি জায়গার নাম বললাম, এইটিই সবচেয়ে দূরে।
খানাইয়া দিঘি মসজিদ
চাপাই শহর থেকে খানাইয়া দিঘি মসজিদ দুরর্ত আনুমানিক ৪৫ মিনিট। যানবাহনের ধরনের উপর নির্ভর করবে সময় কম বা বেশী লাগা। খানাইয়া দিঘি মসজিদ এর COORDINATE: 24°50'25.48"N 88°08'53.96"E ।
খানাইয়া দিঘি মসজিদ, ইন্ডিয়া সিমান্তের খুব কাছাকাছি। খানাইয়া দিঘি মসজিদ বিশাল এক দিঘির পাড়ে যা খানাইয়া দিঘি নামে পরিচিত। ১৪শ সালের দিকে এই মসজিদ নির্মিত। লোকাল অনেকে এই মসজিদকে “চামচিকা” মসজিদ ও বলে আবার রাজবিবি মসজিদ নামেও এর পরিচিতি আছে।
অত্যান্ত রুচিশীল কারুকার্জ বিদ্যমান মসজিদের দেয়াল ঘিরে। বিভিন্ন ধরনের নকশা মুলত এই মসজিদের সৈন্দর্য বারিয়ে দিয়েছে বহূগুন। বর্গাকার আক্রতিক (২৯x২৯ft)এই মসজিদটি মুলত ইট দিয়ে তৈরি।
মসজিদের চারপাশ ঘিরে আমবাগান, আর এখন মুলত আমের মসুম তাই দেখলাম চাপাই এর আম কাকে বলে। গাছ থেকে ঝুলছে বিশাল বিশাল সাইজের আম। এই গুলোই কিছুদিন পর কানসাট হাট পার হয়ে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন যায়গায় রওনা দিবে।
মসজিদের সামনেই খানাইয়া দিঘি। অনেক ধরনের পাখি দেখলাম মুক্ত মনে বিচরন করছে সেখানে। বার্ডিং (যারা শুধু পাখির ছবি তুলে) প্রিতি কনো সময়ই আমি ছিলাম না। সহযাত্রী কয়েক জনকে দেখলাম কি বিদ্ঘুটে টাইপের পাখির নাম বলতে আর তার পিছন পিছন ছুটতে। একবার বলতে শুনলাম “সাদা গলার মাছরাঙ্গা”। যাই হক আমি সামনে যা পেলাম তার কয়েটা ছবি তুলে নিলাম। যেহুতু পাখি বিশারদ নই তাই এই গুলার নাম আমার কাছ থেকে জানতে চাওয়া আমার লজ্জার কারন হবে আরকি।
ঘন্টা দুইয়েক খানাইয়া মসজিদ আর এর আশে পাশে দর্শন শেষে আমরা চল্লাম “ছোট সোনামসজি” এর দিকে।
ছোট সোনামসজি
ছোট সোনামসজি এর COORDINATE: 24°48'50.17"N 88°08'34.75"E
চাপাই জ়েলার পশ্চিম সীমান্তে শিবগঞ্জ থানার ফিরোজপুর মৌজাস্থিত এই ছোট সোনামসজিদটি সুলতানী আমলের স্থাপত্য কীর্তিগুলোর মধ্যে শিল্প ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন। গঠনভঙ্গি বৈচিত্রময় এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই মসজিদের গম্বুজগুলির মধ্যস্থলে কেন্দ্রীয় গম্বুজ হিসিবে বাংলাদেশে প্রচলিত চৌচালা বাড়ির চালের মতো পরস্পর তিনটি গম্বুজ সংযোজিত রয়েছে। এছাড়া দুই সারিতে ৩টি করে দুই পার্শ্বে আরো ১২টি গোলাকৃতি গম্বুজ - মোট ১৪টি গম্বুজ মসজিদের অপরূপ শোভা ধারণ করেছে। এই মসজিদের অভ্যন্তর গৌড়ের আদিনা মসজিদের করে অনুরূপ। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে (সম্ভবত মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য) একটি স্বতন্ত্র ছাদ বা মঞ্চ প্রস্তর স্তম্ভের উপর স্থাপিত রয়েছে এবং সেখানে গমনাগমনের জন্য উত্তর দেওয়ালে একটি সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি সংলগ্ন একটি মিনারও রয়েছে আজান দেওয়ার জন্য। ভেতরের ওই ছাদটির একটি প্রস্তরখণ্ড স্থানান্তরিত হয়ে নিকটস্থ হযরত শাহ্ নেয়ামত উল্লাহর সমাধি প্রাঙ্গণে নীত হয়েছে। মসজিদে কারুকার্য খচিত একটি মেহরাব রয়েছে।
এই মসজিদটি দৈর্ঘ ৮২ ও প্রস্থ ৫২ ফুট, উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং এর চার পার্শে অষ্টকোণ বিশিষ্ট সুউচ্চ চারটি বুরুজ আছে। মসজিদটি মূলত ইটের ইমারত হলেও দেওয়ালের বাইরের অংশ পাথর আবৃত। ভিতরের দিকেও দেওয়ালের বেশ অংশ জুড়ে পাথর আবৃত। সামনের দেওয়ালে সমমাপের ৫টি দরজা রয়েছে। এছাড়া মসজিদের গায়ে নানা প্রকার লতাপাতার কারুকার্য তো আছেই। মধ্যবর্তি দরজার চারপাশের কারুকাজ অধিকাংশই পাথরে খোদিত। স্থানীয় লোকেরা গৌড়ের বড় সোনামসজিদের সংগে তুলনা করে একে ‘ছোট সোনামসজিদ’ বলে অভিহিত করে থাকেন। ঐতিহাসিক জেনারেল ক্যানিংহামের মতে, কিছ সংখ্যক স্বর্ণশিল্পী এই মসজিদের সাজ-সজ্জার পরিকল্পনা বা নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। পরে এ গম্বুজগুলি সোনালী রং-এ গিল্ট করা হলে এটি সোনা মসজিদনামে অভিহিত হয়।
বংগের গৌরবময় রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান আলা-উদ-দীন হোসেন শাহের রাজস্তকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খৃস্টাব্দ) ৮৯৯ হতে ৯২৫ হিজরীর মধ্যে জনৈক আলীর পুত্র ওয়ালী মুহম্মদ কর্তৃক রজব মাসের ১৪ তারিখে ছোট সোনামসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মসজিদের সম্মুখবর্তী কারুকার্য খচিত দরজার উপরের অংশের একটি পাথরে উৎকীণ আরবী শিলালিপি থেকে একথা অবগত হওয়া যায়। মসজিদের অভ্যন্তরের আয়তন ৭১ ফুট ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৪০ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ। ৩ সারিতে বিভক্ত। প্রত্যেক সারিতে ৫টি করে পাথরে স্তম্ভ রয়েছে। কতটা গোলাকৃতি অথচ একটু লম্বা ৫টি মেহরাব আছে। কিন্তু মেহরাবের কারুকার্য খচিত শ্বেত পাথরগুলো বর্তমানে নেই। স্থানীয় জনশ্র“তি ও কয়েকটি বিবরণীতে জানা যায় যে, ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালের বহুলাংশ ভেঙ্গে পড়ে। ১৯০০ সালে তা কেবলমাত্র ইট দ্বারা মেরামত করা হয়। এসময় মেহরাবের উপরে স্বতন্ত্র শ্বেত পাথরের একখণ্ড উজ্জ্বল বস্তু ও আরো কয়েক টুকরো পাথর খণ্ড ইংরেজরা বিদেশে নিয়ে যায়। এমনি পশ্চিম দেওয়ালের কারুকার্যপূর্ণ কতগুলো দুপ্রাপ্য ও বহু মূল্যবান শিল্প নিদর্শনও স্থানান্তরিত হয়ে বিলের চলে যায়।
জনশ্র“তি আছে, মসজিদের সামনের প্রবেশ পথে যে একটি বিরাট ইট নির্মিত তোরণের অবশিষ্টাংশ রয়েছে, ভূমিকম্পের আগে তার সর্বাঙ্গে বিবিধ রং-এর পাথরখণ্ডে অলংকৃত ছিল। বেনারস থেকে আগত শিল্পীদের দ্বারা এই মসজিদের কারুকার্য সম্পাদিত হয়েছিল। মসজিদের পূর্ব উত্তর কোণে মঞ্চাবস্থায় পরস্পর সন্নিহিত যে দুটি পাথর নির্মিত অজ্ঞাত মসাধি (দৈর্ঘ ১৫ ফুট ও প্রস্থ সাড়ে ১০ ফুট) রয়েছে তা একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা ও আরেকটি নাকি তার আত্মীয়ের সমাধি। মতান্তরে এই দু’টি কাল্পনিক কবর বরং মসজিদ প্রতিষ্ঠাতার কিছু গুপ্তধন রতি রয়েছে।
“এক প্রহর বেলা পর্যন্ত সোনা বর্ষিত হয়েছিল মতান্তরে প্রচুর সোনা পাওয়া গেছে সেজন্য স্বর্ণপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক এখানে দীঘি খনন ও মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে ‘সোনামসজিদ নামকরণ হয়েছে।”
এই সোনামসজিদ এর আংগিনায় শুয়ে আছে বাংলার ৭ বীরের এক বীর, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গির। পিতলে খোদাই করা তার জিবনী আছে তার সমাধি পাশে।
এবার আমারা চল্লাম কানসাট বাজারের দিকে।
কানসাট আমের বাজার
বাংলাদেশে যে পরিমান আম হয় তার বেশীর ভাগ হয় চাপাই তে। আর চাপাইতে যত আমের বাজার আছে, সবথেকে বড় বাজার হল এই কানসাট আমের বাজার। এক কথায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমার বাজার এই কানসাট আমের বাজার।
কানসাট আমের বাজারের COORDINATE: 24°43'40.40"N 88°10'14.63"E
সুতারং বুজতেই পারছেন আপনি যখন এই বাজারে দাড়াবেন তখন আপনার মনে হবে লাখ লাখ আমের মাঝ খানে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। বিভিন্ন প্রজাতির আম। দামেও অনেক সস্তা। সারা দেশ থেকে শত শত আমের ব্যপারী এই সময় পাইকারী দরে আম কিনে ট্রাকে ভর্তি দেশের বিভিন্ন যায়গায় নিয়ে জায়। তার কিছু অংশ হয়ত দেশের সীমা পার করে বিদেশেও পাড়ি জমায়। সত্তি গর্ব করার মতো একটা ব্যপার। কানসাট বাজার থেকে এক মণ আম কিন ফিরলাম রাজশাহীতে। এবার বাড়ি ফিরব আম হাতে। বাবার অনেক শখ চাপাই এর গোপালভোগ আম খাওয়ার। তার জনন্য নিয়ে যাচ্ছি এক মণ গোপালভোগ আম।
আগের ব্লগঃ পুঠিয়া রাজবাড়ি, রাজশাহী
পরের ব্লগঃ রাতের গুলশান লেক, ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:৪৮