কালকে রাতে (নিউ ইয়ারস ইভ এ) এক কলিগের বাসায় দাওয়াত ছিলো। বাসা চিনিনা, তাই আমার বাংগালী বসের জন্য বাস স্টেশনে বসে ছিলাম আধাঘন্টা। ঠান্ডায় পা জমে অবশ হয়ে গেসলো, বাসে যখন উঠেছি তখন পা এ কোনই অনুভূতি ছিলোনা... পুরা সময়টা মনে হচ্ছিলো একটা ডিপ ফ্রিজারে রাখা হয়েছে আমাকে। বাসায় ঢুকে দেখি এক দংগল লোকজন... পরিচয়ে জানা গেলো আমার পোলিশ কলিগের পোলিশ দোস্ত, তার ক্যান্টানিজ সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ডের ভাই আর ভাই এর হাউস মেট সব। ক্যান্টানিজ আর জাপানিজদের আমার আজীবনই পুতুলের মতো লাগে, মানুষ বলে বিশ্বাস হয়না। ছোটবেলায় পড়া চাইনিজ সেই সব রূপকথার গল্পের মানুষজন চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে- আসলেই বিশ্বাস হয়না। যাই হোক বেশিরভাগ মেয়ে বসে রান্না-বান্না, নরওয়ের ঠান্ডা, ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী বলছিলাম আর ছেলের একজোট হয়ে দুনিয়া উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিলো, অবশ্য ঠিক ছেলে-মেয়ে বলে বিভাজন হয়নি গল্পের... বসার জায়গা'র উপরে ছিলো। আমার শরীরটা নেহায়েত ভালো ছিলোনা, তাই আমি ঘাপটি মেরে সোফার উপরে বসে ছিলাম, এমনিতেও আমি পার্টিতে আজীবন চুপচাপ থাকি, মানুষজনদের দেখি, কথা বলি মাঝে-সাঝে। কালকে তুলনামূলকভাবে ভালোই সরব ছিলাম। বেচারা ব্লাজেই (আমাদের গৃহকর্তা) সারাক্ষণ উৎকণ্ঠায় ছিলো ঠিকমতো অতিথি সৎকার হচ্ছে কিনা ভেবে, আমরা তাকে বার বার আশ্বস্ত করবার পরেও সে বার বার ঘুরে ঘুরে গ্লাস, বোতল, বাটি, পেয়ালা হাতে ঘুরে ঘুরে সবাইকে জিজ্ঞাসা করে বেড়াচ্ছিলো কারো কিছু লাগবে কিনা। খাবার-দাবারের কমতি ছিলোনা, বাদাম, চিপস, টেম্পুরা, ইয়োগার্ট ডিপ, সালাদ, মেক্সিকান একটা কি জানি ডিশ( রুটির ভেতরে চিজ, শসা, ক্যাপসিকাম আর মাংস দিয়ে ভাজা), ওয়াইন, বিয়ার, আর আমার মতো ভেরেন্ডা ভাজাওয়ালাদের জন্যে লেমোনেড আর ফ্রুটস জুস। আর সবার শেষে ব্লাজেই'র অনুরোধে আমার বানানো একটা কেক। খেয়ে-দেয়ে বারোটা বাজার আগ দিয়ে সবাই মিলে বাজি পোড়ানো দেখতে গোলাম.. সেকি রোশনাই! ওইখানে অনেকেই পরিবার, নাইলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নাইলে প্রিয় কারো সাথে দাঁড়িয়ে হই-হল্লা করছিলো, আর আমি মুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভবছিলাম, আমি কি ভীষণ একলা, যেই এককীত্ব আমার নিজেরই বেছে নেওয়া। লন্ডনে মৌসুম আর তাজীনের সাখে থাকলে আমার অবশ্য একলা লাগেনা মোটেও।
যাই হোক, এরপরে বাসায়ে ফেরার পালা, ব্লাজেই রাস্তা দেখিয়ে দিলো, ওর বাসা থেকে আমি যেখানে থাকি সেইটা মোটে মিনিট পনের'র হেঁটে যাবার রাস্তা। একলা হেঁটে বাসায় আসবার সময় আমি জানিনা কেন আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো অনেকদিনের পরে। আমি নতুন বছরের প্রখম ধোঁয়াশা চাঁদের আলোয় ধূসর সাদা বরফ জমা রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলাম, অথচ কাঁদবার কোন কারণ ছিলোনা... কিন্তু ওই মুহূর্তে কান্নাটাকে ভীষণ স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো। বাসায় ফিরে সিংকে ডোবানো বাসন-কোসন ধুয়ে ডুভেট এর নিচে ঢুকে হাউমাউ করে আরো কিছুক্ষণ কাঁদলাম। অথচ এমন কিছু ঘটেনি, যাতে করে আমার কান্না পেতে পারে, কিংবা কিছুই ঘটেনি সেই হতাশায়ও কাঁদতে পারি। অথচ এই জীবন আমি মেনেই নিয়েছি... আসলে নিয়েছি কি? নাকি মেনে নেবার ভান করি প্রতিমুহূর্তে নিজের সাথেই? ভাবতে ভাবতে বিরক্ত লাগছিলো, তাই একটা সময় জোর করে ঘুমিয়ে গেলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১০ ভোর ৪:৫৬