somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাণী চিরন্তনী

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চার্বাক দর্শন বা লোকায়ত দর্শন এক বিষ্ময়কর বস্তুবাদী দর্শন। প্রাচীন ভারতের এক আগাগোড়া নাস্তিক্যবাদী দর্শন| ধারণা করা হয় যীশু খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগেই এই অঞ্চলে বিভিন্ন বস্তুবাদী দর্শন বিকাশ লাভ করে; যেমন : সাংখ্য দর্শন, মীমাংসা দর্শন, স্বভাববাদ, বৌদ্ধ মতবাদ, বৈভাষিক, চার্বাকসহ বিভিন্ন দর্শন। বৃহস্পতি, অজিত কেশ কাম্বলী, ধীষন, পরমেস্তিন, ভৃগু, কপিলা, কশ্যপমুনি, পুরন্দর, চরক, সুশ্রুত, বাৎসায়ন, রাজা বেন প্রমুখ চিন্তাশীল মনীষীরা খ্রিষ্টপূর্বাব্দের যুক্তিবাদী। কিন্তু যুগে যুগে যা হয়ে আসছে, এই সকল চিন্তাশীল নাস্তিক মনীষী বৈদিক ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এই চিন্তাশীল যুক্তিবাদীদের লিখিত কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায় না এখন আর। তাঁদের সকল রচনা ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীরা ধ্বংস করে দিয়েছেন। এমন কি চার্বাকদের আগুনে পুড়িয়ে, সমুদ্রে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছে; হিন্দুধর্ম গ্রন্থ রামায়ন, মহাভারতেই এর নানা প্রমাণ রয়েছে। পরবর্তীতে ব্রাক্ষ্মণ্যদের রচিত গ্রন্থ থেকে আমরা এইসকল দ্রোহী, যুক্তিবাদীদের রচনার কিছু কথার সঠিক, অতিরঞ্জিত, বিকৃত তথ্য পেয়ে থাকি এবং তৎকালীন যুক্তিবাদী দর্শনের সামান্য কিছু পরিচয় পেয়ে থাকি।

নিম্নে এ রকমই কিছু চার্বাকবাদীদের উক্তি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের রচিত ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে গ্রন্থ (পৃষ্ঠা : ১৬- ১৮) থেকে তুলে ধরা হলো।


(১) যাবজ্জীবং সুখং জীবেন্নাস্তি মৃত্যোরগোচরং।

ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।

অর্থাৎ: যতদিন বেঁচে আছ ততদিন সুখ ভোগ করে নাও। মরণ থেকে কারুরই রেহাই নেই। লাশটা পোড়াবার পর আবার ফেরাবার কায়দা কী হতে পারে?

(২) ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ।

নৈব বর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ ।।

অর্থাৎ: স্বর্গ বলে কিছু নেই; অপবর্গ বা মুক্তি বলেও নয়, পরলোকগামী আত্মা বলেও নয়। বর্ণাশ্রম-বিহিত ক্রিয়াকর্ম নেহাতই নিস্ফল।

(৩) অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো বেদাস্ত্রিদন্ডং ভস্মগুণ্ঠনম্‌।

বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকা ধাতৃনির্মিতা ।।

অর্থাৎ: যাদের না আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মুরোদ, তাদের জীবিকা হিসাবেই বিধাতা যেন সৃষ্টি করেছেন অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, তিন বেদ, সন্নাসীদের ত্রিদন্ড, গায়ে ভস্মলেপন প্রভৃতি ব্যবস্থা।

(৪) পশুশ্চেন্নিহতঃ স্বর্গ জ্যোতিস্টোমে গমিষ্যতি।

স্থাপিতা যজমানেন তত্র কস্মান্ন হিংস্যতে ।।

অর্থাৎ: জ্যোতিস্টোম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সরাসরি স্বর্গে যায়, তাহলে যজমান কেন নিজের পিতাকে হত্যা করে না? আরো সোজা ভাষায় বলা যায় - স্বর্গে যাবার অমন সোজা সড়ক থাকতেও যজমান কেন নিজের পিতাকে তা থেকে বঞ্চিত করে?

(৫) মৃতানামপি জন্তূনাং শ্রাদ্ধং চেৎ তৃপ্তিকারণম্‌।

নির্বাণস্য প্রদীপস্য øেহঃ সংবর্ধয়েৎ শিখাম্‌ ।।

অর্থাৎ: কেউ মারা যাবার পর শ্রাদ্ধকর্ম যদি তার তৃপ্তির কারণ হয়, তাহলে তো প্রদীপ নিভে যাবার পরেও তেল ঢেলে তার শিখা প্রদীপ্ত করা যেত।

(৬) গছতামিহ জন্তূনাং ব্যর্থং পাথেয়কল্পনম্‌।

গেহস্থকৃতশ্রাদ্ধেন পথি তৃপ্তিরবারিতা ।।

অর্থাৎ: যে পৃথিবী ছেড়ে গেছে তার পাথেয় (পিন্ড) কল্পনা করা বৃথা, কেননা তাহলে ঘর ছেড়ে কেউ গ্রামান্তর গমন করলে ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিন্ড দিলেই তো তার পাথেয়-ব্যবস্থা সম্পন্ন হতো। (অর্থাৎ গ্রামান্তরগামীর পক্ষে তো তাহলে পাথেয় হিসাবে চাল-চিঁড়ে বয়ে নিয়ে যাবার দরকার হতো না।)

(৭) স্বর্গস্থিতা যদা তৃপ্তিং গছেয়ুস্তত্র দানতঃ।

প্রাসাদস্যোপরিস্থানামত্র কস্মান্ন দীয়তে ।।

অর্থাৎ: যিনি স্বর্গে গেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে দান নেহাতই বৃথা, কেননা তিনি প্রাসাদের উপরে উঠে গেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে (মাটিতে বসে) দান করলেও তো তাঁর তৃপ্তি হবার কথা।

(৮) যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।

ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।

অর্থাৎ: যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর দেহ আবার কেমন করে ফিরে আসবে?

(৯) যদি গছেৎ পরং লোকং দেহাদেষ বিনির্গতঃ।

কস্মাদ্‌ ভূয়ো ন চায়াতি বন্ধুøেহসমাকুলঃ ।।

অর্থাৎ: জীব যদি এই দেহ ছেড়ে পরলোকে যায়, তাহলে বন্ধুবান্ধবের টানে সে আবার ফিরে আসে না কেন?

(১০) ততশ্চ জীবনোপায়ো ব্রাক্ষ্মণৈবির্হিতস্ত্বিহ।

মৃতানাং প্রেতাকার্যাণি ন ত্বন্যৎ বিদ্যতে ক্কচিৎ ।।

অর্থাৎ: ব্রাক্ষ্মণদের জীবিকা হিসেবেই মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে (শ্রাদ্ধাদি) প্রেতকার্য বিহিত হয়েছে। তাছাড়া এসবের আর কোনো উপযোগিতা নেই।

(১১) ত্রয়ো বেদস্য কর্ত্তারো ভন্ডধূর্তনিশাচরাঃ।

জর্ফরীতুর্ফীত্যাদি পন্ডিতানাং বচঃ স্মৃতম্‌ ।।

অর্থাৎ: যারা তিন বেদ রচনা করেছেন তাঁরা নেহাতই ভন্ড, ধূর্ত ও চোর (নিশাচর)। জর্ফরীতুর্ফরী (প্রভৃতি অর্থহীন বেদমন্ত্র) ধূর্ত পন্ডিতদের বাক্য মাত্র।

(১২) অশ্বস্যাত্র হি শিশ্নং তু পত্নীগ্রাহং প্রকীর্তিতম্‌।

ভন্ডৈস্তদ্‌বৎ পরং চৈব গ্রাহ্যজাতং প্রকীর্তিতম্।।

অর্থাৎ: আর তাঁরাই (ভন্ড) বিধান দিয়েছেন, অশ্বমেধ-যজ্ঞে যজমান-পত্নী অশ্বের শিশ্ন গ্রহণ করবে।

(১৩) মাংসানাং খাদনং তদ্বন্নিশাচর-সমীরিতম্‌।

অর্থাৎ: চোরেরাই (নিশাচর) মাংস খাবার মতলবে (যজ্ঞ পশুবলির) বিধান দিয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:০৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

১. ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:১৪

বাদ দেন বলেছেন: ফেসবুকে বলেছিলুম এখনও বলছি, ব্যকরনগত ভাবে ঠিক হলেও এদেরকে বর্তমান অর্থে নাস্তিক বলা যায় না, বেদবিরোধী কিংবা প্রচলিত ধর্ম বিরোধী বলতে পারেন

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:৩৬

লেখক বলেছেন: বর্তমানে ‘নাস্তিক’ বলতে ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস বোঝায়। ধর্মগ্রন্থের প্রদত্ত সংজ্ঞা আলাদা। বেদের দৃষ্টিতে তো বৈদিক মতাবলম্বী ছাড়া সবাই নাস্তিক হয়ে যায়!!



যাইহোক, চার্বাকরা বেদের অপৌরেষয়তায় অবিশ্বাস করতো। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করতো। বৈদিক মতের স্বর্গ, নরক ধারণারও বিরোধিতা করছে। কিন্তু তারা কি নিজেরা কোনো আলাদা ধর্মের-ঈশ্বরের উপাসনা বা চর্চা করতো? কোনো ধরনের লৌকিক দেবতা বা সর্বপ্রাণবাদ, টোটেমবাদ ইত্যাদি ধরনের। আমি এই ধরনের কোনো তথ্য পাই নাই। আপনার জানা থাকলে জানাবেন। কাজে লাগবে আমার।

২. ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:১৫

বাদ দেন বলেছেন: আপনাকে অনুসরনে রাখলুম আশা করি নিয়মিত লেখা দিবেন

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:২১

লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ। হুঁম... দেখা হবে।

৩. ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০০

বাদ দেন বলেছেন: আপনার ব্যাখা আমার পছন্দ হয়েছে।++++++

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:০৪

লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ অাপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আয়নাঘর শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েও ছিল

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, আয়নাঘর শুধু ক্যান্টনমেন্টেই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল এমনকি ব্যক্তিগত বাড়িতেও ছিল। আপনারা শুধু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১১:০০

প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় এখন আর কেউ নিজের মতো হতে চাই না, হতে চাই বিশ্ববরেণ্যদের মতো। শিশুকাল থেকেই শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সব ছাত্রদের মাথায় জিপিএ ৫, গোল্ডেন পেতে হবে! সবাইকেই ডাক্তার,... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। এইচএমপিভি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৩




করোনা মহামারির ৫ বছরের মাথায় নতুন একটি ভাইরাসের উত্থান ঘটেছে চীনে। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নামের নতুন এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে দেশটিতে।চীনের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাকিস্তান, আমেরিকা, জামাত-শিবির আমাদেরকে "ব্যর্থ জাতিতে" পরিণত করেছে।

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৭



আজকে সময় হয়েছে, আমেরিকান দুতাবাসের সামনে গিয়ে বলার, "তোরা চলে যা, ট্রাম্পের অধীনে ভালো থাক, আমরা যেভাবে পারি নিজের দেশ নিজেরা গড়বো। চলে যাবার আগে তোদের পাকী... ...বাকিটুকু পড়ুন

=হয়তো কখনো আমরা প্রেমে পড়বো=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৯:০০


পোস্ট দিছি ২২/১২/২১

©কাজী ফাতেমা ছবি

কোন এক সময় হয়তো প্রেমে পড়বো আমরা
তখন সময় আমাদের নিয়ে যাবে বুড়ো বেলা,
শরীরের জোর হারিয়ে একে অন্যের প্রেমে না পড়েই বা কী;
তখন সময় আমাদের শেখাবে বিষণ্ণতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×