'তাবলীগ' আরবী শব্দ। এর অর্থ প্রচার করা। যে সকল মানুষ আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী নয় এবং হযরত মুহাম্মদ(স) কে রাসূল বলে স্বীকার করেনা, এক কথায় ইসলাম ধর্মকে মনে প্রাণে গ্রহন করেনা, তাদের প্রতি ইসলামের মহা সত্যর বাণী প্রচার পৌছিয়ে দেয়ার নামই তাবলীগ।
হযরত আদম (আ) হতে এ পৃথীবিতে যত নবী ও রাসূল আগমন করেছেন, সকলেই পথভোলা মানুষদেরকে আল্লাহর পথ প্রদর্শন করার জন্য তাবলীগ করে গেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক নবী শহীদও হয়েছেন।
হযরত ইব্রাহীম (আ) বাদশাহ নমরূদকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু অত্যাচারী বাদশাহ নমরূদ তার সত্যর দাওয়াত গ্রহণ না করে বরং হযরত ইব্রাহীম কে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেন।
হযরত মুসা (আ) নবুয়ত লাভের পর তাবলীগ বা ধর্ম প্রচারের কাজ করেছিলেন। তিনি বাদশাহ ফেরাউনকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন।ফেরাউন তা গ্রহন করা তো দুরের কথা বরং হযরত মুসা (আ) কে হত্যা করারও ষড়যন্ত্র করেছিল। অথচ ব্যর্থ হয়ে নিজেই দলবলশ নীল নদে ডুবে মারা গেল।
বিশ্বনবী (স) এর তাবলীগ
আখেরী জামানার নবী হযরত রাসূলে আকরাম (স) সূদীর্ঘ ১৫ টি বছর হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর গভীর ধ্যান সাধনার মাধ্যমে যে সত্যর সন্ধান লাভ করেছিলেন, তা লোক সমাজে প্রকাশ করার জন্য তিনিও তাবলীগ করেছিলেন। এখন আমাদের জেনে নেয় দরকার যে, হযরত রাসূল (স) এর তাবলীগ কোন ধরণের ছিল? এবং এর সাথে রাসূল (স) এর সময়কার শিক্ষা পদ্ধতিও আলোচনা করা দরকার।
রাসূল (স) এর শিক্ষা পদ্ধতি
হযরত রাসূেল (স) খোদা নবুয়তি লাভ করার পর প্রথমদিকে গোপনে গোপনে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। কিছুদিন পরে আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে তিনি আত্মীয় স্বজনদের মধ্য এক মজলিস আহবান করে তাদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু সে মজলিসে আবু জাহেল 'হে মোহাম্মদ! তুমি ধ্বংস হও' বলে মজলিস ত্যগ করলো। একমাত্র বালক হযরত আলী (র) তখন ইসলাম গ্রহন করলেন। এরপর থেকে রাসূল (স) ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে হযরত যায়েদ বিন আকরামের গৃহকে ( দারূল আরকাম) কেন্দ্র করে কাফেরদের মধ্য ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেলে হযরত ওমর (র) ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন থেকে রাসূল (স) বিধর্মীদের প্রকাশ্যভাবে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। ফলে আস্তে আ্স্তে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। রাসূল (স) একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেই তাদের শিক্ষা দিতেন। তিনি ইসলামের মূলনীতি ঘোষনা করতে গিয়ে ফরমান।
'হযরত ইবনে ওমর (র) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন ৫ টি বস্তুর উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। তাহলো আল্লাহর ব্যতীত কোন মাবুদ নাই এবং মোহাম্মদ (স) তার বন্ধু ও রাসূল (স)। এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যথার্থভাবে নামাজ কায়েম করা, সম্পদের যাকাত প্রদান করা, হজ্ব করা এবং রমজান মাসে রোজা পালন করা" (বুখারী-মুসলিম)
হযরত রাসূলে আকরাম (স) এর আদর্শ ও ইসলামের মৌলিক নীতীমালার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেক অমুসলিম দলে দলে ইসলাম গ্রহন করেন।
হিজরতের পরে হযরত মোহাম্মদ (স) মদীনার মসজিদে নববীতে বসে সাহাবাদেরকে দ্বীনি তালিম দিতেন এবং মসজীদ সংলগ্ন আস্তানা বা খানকায় বসবাসরত আস হাবে সুফফাদেরকে এলমে তাসাউফ শিক্ষা দিতেন। তার আদর্শ শিক্ষার ফলে আস হাবে সুফফাগণ যেমন তাসাউফের গভীর জ্ঞান লাভ করেছিলেন, তেমনি তার তাবলীগের ফলে অনেক কাফের ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিল। হযরত রাসূল (স) বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েও বিধর্মী বাদশাহদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠাতেন, ফলে অনেক অমুসলিম শাসকও ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদীনের তাবলীগ
হযরত রাসূলে খোদা (স) এর ওফাতের পরে খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যও ইসলামের তাবলীগ প্রথা বিদ্যমান ছিল। তারাও রাসূল (স) এর নীতি অনুসরন করে বিভিন্ন অমুসলিম এলাকায় লোক পাঠিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন । যারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতেন তাদেরকে আদর্শ চরিত্র গঠনের মাধ্যমে ধর্মের কাজ করার নিয়ম শিক্ষা দিতেন।
সাহাবায়ে কেরামের এত সুন্দর আদর্শ ছিল যে, তারা কখনো ব্যক্তিস্বার্থের বশবর্তী হয়ে কারো প্রতি অন্যায় ও অবিচার করেন নি। একদা হযরত আলী (র) জনৈক কাফেরকে (মুসলমানদের সাথে দুশমনি করার অপরাধে) হত্যা করার জন্য উদ্যত হলেন। কাফের লোকটি কি যেন ভেবে হযরত আলী (র) এর মুখমন্ডলে থু থু নিক্ষেপ করলো। হযরত আলী (র) লোকটিকে হত্যা না করে ছেড়ে দিলেন। এতে অবাক হয়ে লোকটি হযরত আলী (র) এর নিকট তাকে হত্যা না করার কারণ জিগ্গেস করলে তিনি উত্তর দিলেন যে, আমি তোমাকে ইসলামের দুশমন হিসেবে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নয়। কিন্তু তুমি যখন আমাকে থু থু দিলে তখন তখন আমি তোমাকে হত্যা করলে প্রমান হবে যে, আমি থু থু দেয়ার অপরাধে তোমাকে হত্যা করেছি। তাই আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি। হযরত আলী (র) এর এ ধরণের মহত্ব দেখে উক্ত অমুসলিম লোকটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। সাহাবায়ে কেরাম তথা খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ ও চরিত্রের মাহাত্য দেখে এভাবে অসংখ্য অমুসলিম ব্যক্তি ইসলাম গ্রহন করেছেন
অলী-আল্লাহগণের তাবলীগ
রাসূলে (স) খোদা এর ওফাতের পরে দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ খোলাফায়ে রাশেদীন ইসলাম প্রচারের জন্য তাবলীগ করে গেছেন। তাদের পরে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের তাবলীগ করেন অলী-আল্লাহগন।
কারবালার যুদ্ধে হযরত ইমাম হোসাইন (র) এর শাহদাতের পর থেকে এজিদ শাসন ক্ষমতায় আসে এবং হযরত ইমাম হোসাইন (র) এর সমর্থকদের প্রতি অত্যাচার শুরু করে দেয়। তার পরবর্তী আব্বাসীয় শাসকবৃন্দও তৎকালীন যুগের স্বনামধনয় অলি-আল্লাহদের উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়। ফলে অলী-আল্লাহগনের অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পরেন এবং বিধর্মীদের মাঝে তাবলীগ করে অসংখ্য লোককে মুসলমানে পরিণত করেন।
তৎকালীন যুগের বেশির ভাগ অলী-আল্লাহই পাক -ভারত-বাংলা উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য আগমন করেন এবং তাদের মাধ্যমেই এ উপমাহাদেশে ইসলামের আলো প্রজ্বলিত হয়েছে, অনেক অমুসলমান ইসলামের সুশীতল ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। অলী-আল্লাহগন আল্লাহর প্রিয় পাত্র। তারা আল্লাহর তরফ থেকে বান্দার মুক্তির জন্য এক মহান দায়িত্ব লাভ করে থাকেন।
'আমি আমার উম্মতের মধ্য থেেক এমন একদল লোক সৃষ্টি করেছি যারা মানুষদেরকে হেদায়েতের পথ দেখাবে এবং ন্যয় বিচার কায়েম করবে" ( সুরা আরাফ, আয়াত ১৮১)
মুলত অলী-আল্লাহগনই ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় আগমন করেন এবং দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে অমুসলিমদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। এই ভারতবর্ষে ইসলামের আদর্শ প্রচার একমাত্র অলি-আল্লাহগণের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই সম্ভব হয়েছে। ইমাম আযম হযরত আবু হানিফা (র), হযরত ইমাম সাফেয়ী (র) , হযরত ইমাম মালেক (র) ও হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) একদিকে যেমন ছিলেন শরীয়তের ইমাম, অপরদিকে ছিলেন উচু স্তরের অলি-আল্লাহ। ফলে তারা ইসলামের বিভিন্ন জটিল ব্যপারগুলো এজতেহাদ করে একটি সুষ্ঠু সমাধান দিতে চেষ্টা করেছেন। যার ফলে আজও বিশ্ববাসী ইসলামের মূল বিষয়গুলো গ্রহন করার সুযোগ লাভ করছেন।
অপরদিকে হযরত বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র), হযরত খাজা মাঈনুদ্দীন চিশতি (র) , হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (র) , হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী ও ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (র) প্রমুখ ইমাম গন মানুষের মুক্তির সঠিক পথ হিসেবে যুগপোযোগী এক একটি তরীকা প্রবর্তন ও প্রচার করে গেছেন। যা অনুসরণে আজও অসংখ্য মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হচ্ছেন।
এভাবে এই বেলায়েতের যুগে অসংখ্য অলি-আল্লাহ, পাপী-তাপী মানুষদের ইসলামের সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন।
"যে করুণাময়ের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি বা অনুমতি পেয়েছে, সে ছাড়া অন্য কারও সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকবেনা"( সুরা মরিয়ম আয়াত ৮৭)
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অনাদিকাল থেকে এ পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল মানুষকে হেদায়েতের কাজ সম্পাদন করেছেন, তারা প্রত্যকেই প্রথমত নিজেরা সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে মানুষের মাঝে তাওহীদের বানী প্রচার করেছেন। রাসূল (স) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তা স্বত্বেও তিনি নিজে দীর্ঘ ১৫ বছর হেরা গুহায় ধ্যন সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তারপর আল্লাহর কাছ থেকে আদিষ্ট হওয়ার পর তিনি মানুষের মাঝে তাওহিদের বানী প্রচার করেছেন। সুতরাং হেদায়েতের দায়িত্ব পালনের জন্য সর্বপ্রথম নিজে সাধনা করে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে তার পক্ষ থেকে হেদায়েতের কাজ করার জন্য আদিষ্ট হতে হয়। অন্যথায় এ কাজে নিয়োজিত হলে আল্লাহর বিধান মোতাবেক অমার্জনীয় অপরাধ বৈ আর কিছু নয়।
বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ
বর্তমানে 'তাবলীগ জামাত' নামে একটি ধর্ম প্রচারক দল মুসলমানদের মধ্য কালেমার দাওয়াত দিচ্ছেন। এ দলের মূলনীতি হলো ৬ টি
১। কালেমা ২।নামাজ ৩। একরামূল মুসলেমীন ৪।তছীহুন নিয়াত ৫।এলেম ও জিকর ৬। নাফরূন ফি সাবিলিল্লাহ বা তাবলীগ
অতি সংগবদ্ধ ভাবে এই দলটি এক মসজিদ থেক অন্য মসজিদে গিয়ে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা আহার নিদ্রা সবকিছুই এই মজলিসে বসে সমাধা করে থাকেন। কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে এ দলের সদস্যগন যাবতীয় ব্যয়ভার ব্যক্তিগত ভাবেই বহন করে থাকেন।
১৩৪৫ হিজরীতে (১৯২৫) তাবলীগ জামাতের যাত্রা শুরু হয়। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা কাসেম নানতুবীর অনুসারী ও দেওবন্দ মাদ্রাসার ভূত পূর্ব ছাত্র মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াছ ১৯৩৮ সালের ১৪ ই মার্চ সউদী আরবের তৎকালীন বাদশাহ সাথে ৪/৫ সদস্যর একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাত করেন। তিনি এই সাক্ষাত আলোচনার পর থেকে 'তাবলীগ জামাতের" কর্মতৎপরতা ব্যপকভাবে শুরু হ্য়।
বর্তমানে তাবলীগ জামাতের প্রধান প্রচারকেন্দ্র হচ্ছে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (র) এর মাজার সংলগ্ন 'তাবলীগ মসজিদ'। দ্বিতীয় প্রচার কেন্দ্র হচ্ছে পাকিস্তানে এবং তৃতীয় প্রচারকেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশে কাকরাইল মসজিদ।
সৃষ্টিজগতের আদি থেকে নবী রাসূলগণ এবং তারপর থেকে অদ্যাবধি খাটি আলেম ও অলী-আল্লাহগন তাবলীগ তথা ইসলাম ধর্মের প্রচার কার্য চালিয়ে আসছেন।
" তোমাদের মধ্য একদল লোক এমন হওয়া চাই, যারা মংগলের প্রতি আহবান করবে, সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে"
(সূরা আলে ইমরান। আয়াত-১০৪)
এর ব্যাখ্যা প্রসংগে 'তাবলীগ দর্পন' নামক কিতাবের ২য় পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে-" এই আয়াতে 'তোমাদের মধ্য একদল লোক' এই কয়টি শব্দ দ্বারা ইহাই পরিস্কারভাবে বুঝাচ্ছে যে, দাওয়াত বা তাবলীগ করবার নির্দেশ সমস্ত মুসলমানদের উপর নহে বরং মুসলমানদের মধ্য একদল অর্থাৎ আলেম সম্প্রদায়ের উপর তাবলীগ ফরজ করাহয়েছে। এই আয়াতে নির্দেশিত তাবলীগ ইসলামের প্রথম যূগ হতে অদ্যবধি ওলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানেদ্বীন (অলী-আল্লাহগণ) সম্পাদন করে আসছেন।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তফসীরে বায়জাবিতে বলা হয়েছে-
" কেননা সৎকাজের নির্দেশ দান করা ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা ফরজে কিফায়া ( অর্থাৎ কিছু সংখ্যক লোকের উপর ফরজ) কারণ এই গুরু্ত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের যোগ্যতা সকলের নেই। এ কাজ সম্পাদনের জন্য যে শর্তাবলী রয়েছে, যেমন শরীয়তের বিধি নিষেধ সম্পর্কে অবগত হওয়া, হুকুম আহকামের তাৎপর্য্য এবং এগুলি প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা বা বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হওয়া ইত্যাদি। অথবা এ সমস্ত শর্ত সকলের মধ্য পাওয়া যায়না, এ আয়াতের মধ্য সমস্ত উম্মৎকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক হতে এ কাজ চাওয়া হয়েছে।
'তাবলীগ দর্পন' কিতাবে আছে, "উপরোক্ত বর্নণায় এটাই প্রমাণিত হল যে, সৎকাজের নির্দেশ দান করা ও অসৎ কার্য নিষেদঃ করা ফরজে কিফায়া"। তাছাড়া ' এ কাজ করার মধ্য যে সব শর্ত রয়েছে, তাহা সকলের মধ্য পাওয়া যায়না"
সুতরাং যারা ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে নিজেরাই অজ্ঞ তারা কি করে মানুষের মধ্য তাবলীগ করবেন?
তাফসীরে জামেউল বয়ানে আছে
" কারণ সৎকাজের নির্দেশ দান ফরজে কিফায়া এবং নির্দেশদাতার জন্য শর্তাবলীও রয়েছে। ইমাম দাহহাক বলেছেন- তারা হচ্ছেন সাহাবায়ে কেরাম, মুজতাহেদিন এবং হক্কানী আলেম অলী-আল্লাহগন কিন্তু সম্বোধন সকলকেই করা হয়েছে"
'তবলীগ দর্পনে" আরো বলা হয়েছে যে " এইসব তাফসীর হতে ইহাই সুস্পষ্ট হয় যে, সৎকাজের নির্দেশদাতা ও অসৎকার্যের নিষেধকারী হচ্ছেন
প্রকেতপক্ষে সাহাবায়ে কেরাম,মুজতাহেদীন ও ওলামাই উম্মৎ। দু চারটি বই পাঠ করে ( অথবা হাদীস কোরানের কয়েক পাতা পাঠকারী) ধর্মীয় জ্ঞানহীন জনসাধারন নহে"
এ আয়াতের ব্যখ্যায় আল্লামা জালালউদ্দীন সিয়ুতি তফসীরে জালালাইন বলেন-
অর্থাৎ এ আয়াতের মধ্য 'মিন' শব্দটি দ্বারা কিছুসংখ্যক লোক কে বুঝায়। কেননা তাবলীগ করা ফরজে কেফায়া। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক লোকের প্রতি ফরজ। এ নির্দেশ সমস্ত উম্মতের প্রতি নয় এবং প্রত্যক ব্যক্তি এর যোগ্যও নয়-যেমন মুর্খ্য ব্যক্তি।
হযরত আনাস বর্ননা করেন যে, রাসূল (স) বলেছেন উপদেশ দানে (তোমরা) নম্রতা অবলম্বন কর, কঠোরতা অবলম্বন করোনা, সুসংবাদ দাও, ঘৃণার উদ্রেক করোনা। এ থেকে বুঝা যায় যে, অমুসলিমদের মাঝে তাবলীগ করার জন্যই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অথচ বর্তমান যুগের প্রচলিত তাবলীগ পন্থীদের দেখা যায় তারা অমুসলিমদের মধ্য ইসলামের দাওয়াত সম্পুর্ণ পরিহার করে শুধু মুসলমানদেরকেই কালেমার দাওয়াত দিচ্ছেন। তাও আবার মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছা ও সময় সুযোগের প্রতি লক্ষ্য না রেখেই করেছেন।অথচ সাহাবায়ে কেরাম জিহাদের ময়দানে গিয়ে যুদ্ধের প্রাক্কালেও অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। খায়বরের যুদ্ধে শেরে খোদা হযরত আলী(র) এর নির্দেশ তাই প্রমাণ করে।
বোখারী শরীফে আছে-"খায়বর বিজয়ের প্রাক্কালে যখন শেষবারের মত হুজুর (স) ইসলামী পতাকা দিয়ে হযরত আলী (র) কে রওনা করিয়ে দিবেন-তখন হযরত আলী (র) জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর ওখানে গিয়ে প্রথমেই যুদ্ধ আরম্ভ করে দিব? এবং ইসলাম গ্রহন না করা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাব? রাসূল (স) বললেন, না তা নয়, ওখানে পৌছে প্রথমেই শান্তির সাথে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিবে। ইসলাম গ্রহন করতে বলে, যদি তোমার চেষ্টায় একটিমাত্র ব্যক্তি ইসলাম গ্রহন করেন তবে গনীমতের মূল্যবান লাল রংয়ের উট হতেও ইহা শ্রেষ্ঠ মনে করবে। যদি তারা ইহাও অমান্য করে তবে দ্বিতীয় নম্বরে তাদের কে জিজিরা কর দিতে উদ্বুদ্ধ করবে। হতভাগারা যদি তাও অমান্য করে তবে অগত্যা যুদ্ধ করবে'
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, অমুসলিমদের সাথে জিহাদ করার পূর্বে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার বিধান ছিল। যার কারনে ইসলামের ব্যপক প্রসার লাভ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বর্তমান যুগের তাবলীগ পন্থীরা কোন অমুসলমানদের নিকটে দ্বীনের দাওয়াত দেন না বরং মুসলমানদের নিকটই এই দাওয়াত পৌছিয়ে থাকেন।
হযরত রাসূলে আকরাম (স) অনেক সময় সাহাবাকেরামদের অমুসলিম, বেদ্বীন ও কাফেরদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌছানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতেন।
বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ পন্থীরা সাহাবায়ে কেরামগন মুসলমানদের নিকটেও তাবলীগ করেছেন বলে যে বর্ননা দিয়ে থাকেন। তার অর্থ হচ্ছে এই যে, দূর দুরান্তের যে সকল লোক রাসূল (স) কে নবী বলে স্বীকার করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষীত হয়েছেন, তাদেরকে হযরত রাসূল (স) শিক্ষা পদ্ধতি ও ইসলামের নিয়ম কানুন অবগত করানোর জন্যই এই ব্যবস্থা করেছিলেন। তাছাড়া যে সকল সাহাবীদের এই হেদায়েতের কাজে পাঠানো হতো তারা এলমে তাসাউফের জ্ঞানে সুপন্ডিত ছিলেন। কিন্তু বর্তমান যুগের তাবলীগ পন্থীদের এলমে তাসাউফের জ্ঞান তো দুরের কথা বেশীরভাগ লোকই শরীয়তের জ্ঞান সম্পর্কেও অজ্ঞ। তাছাড়া যারা মুরব্বী বলে খ্যত, তাদের বেশিরভাগই প্রকৃতপক্ষে ইসলামের রীতি-নীতি কোরআন ও হাদীসের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূল (স) এর প্রদত্ত নির্দেশ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল নন, কি করে তারা অন্যর কাছে ইসলামের তাবলীগ করবেন?
হযরত রাসূলে আকরাম (স) এর জামানায় যে সকল সাহাবায়ে কেরাম অমুসলিমদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দইতেন,তারা ছিলেন গভীর পান্ডিত্যর অধীকারী এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র বিশেষ। হযরত ওসমান গনী (র), হযরত আলী (র) ও হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (র) তাদের মধ্য অন্যতম ছিলেন। হযরত আলী (র) সম্পর্কে রাসূল (স) বলেছেন
" আমি বিদ্যার শহর এবং আলী তার দরজা'
বর্তমান যুগে যে সকল অলী-আল্লাহ মানুষদেরকে হেদায়েতের পথ দেখাচ্ছেন, তারা আল্লাহ ও রাসূলের গুনে গুনী। তারা মানুষকে চরিত্র গঠনের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন এবং ক্বালবে জিকর জারী করত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দিয়ে নামাজে হুজুরী বা একাগ্রতা সৃষ্টির উপায় শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে যারা তাবলীগ করছেন তাদের ক্বালবের ভিতরে আল্লাহর জিকির জারী হওয়ার শিক্ষা পদ্ধতি চালূ নেই।
" যাদের ক্বালব আমার জি্বকর থেকে কঠিন হয়ে গেছে সে প্রকাশ্য গোমরাহীর মধ্য আছে" ( সূরা জুমার আয়াত-২২)
'যে ব্যক্তির ক্বালব বা দিল আমার জিকর থেকে গাফেল রয়েছে তোমরা তার হুকুম মানবেনা" ( সুরা কাহাফ, আয়াত-২৮)
প্রচলিত তাবলীগ পন্থিদের ৬ উছুলের মধ্য জিকরের কথা থাকলেও তা মৌখিক জিকর, ক্বালবী জিকর নয়। এই ক্বালবী জ্বিকিরের প্দ্ধতি শিখতে হলে অলী-আল্লাহগনের সান্নিধ্য গমন করতে হয়। মুখে শুধু ধর্মের কথা বললে অথবা কালেমার দাওয়াত দিতে বের হলেই ধর্ম প্রচার হয়না। বরং নিজে আগে ঈমানদার হতে হবে। অন্যথায় সব প্রচেষ্টাই বিফল হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ২:২৩