খুব কবিতা পড়ার নেশা আমার। সময়ে-অসময়ে, অবসরে-ব্যস্ততায় কবিতা আমাকে আশ্রয় দেয়। মাঝে-মাঝে কোনো-কোনো কবিতা পড়ে এতটাই অভিভূত হই যে, শুধু নিজে পড়ে তৃপ্তি হয় না, মনে হয় আরো অনেকের সঙ্গে এই পাঠ-আনন্দ ভাগ করে নিই। কিন্তু, হায়, কবিতার মতো অলাভজনক (!) বিষয় নিয়ে কথাবার্তা কে-ই বা শুনতে চায়! এই ব্লগে, তাই, এর আগেও কবিতা নিয়ে লেখা দিয়েছি, শুধু ওই আনন্দ ভাগ করে নেয়ার উদ্দেশ্য থেকেই। আজও, অনেকদিন পর, তেমনই আরেকটি কবিতা।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'ও চিরপ্রণম্য অগ্নি' কবিতা এটি- তাঁর একুশতম কাব্যগ্রন্থের, সম্ভবত প্রায় শেষ বয়সের রচনা। শক্তি আমার প্রিয় কবিদের একজন। তাঁর অনেকগুলো কবিতা প্রায় ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে, পড়তে পড়তে। এটি তারই একটি।
কবিতাটি, মৃত্যুর পর কবির আকাঙ্ক্ষা ও মিনতি নিয়ে। মৃত্যুর পর না বলে, সৎকারের সময় বলাই ভালো। অর্থাৎ দাহ করবার সময় কবি আগুনের কাছে যে মিনতি জানাচ্ছেন তাই নিয়ে এই কবিতা।
কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে-
'ও চিরপ্রণম্য অগ্নি
আমাকে পোড়াও।
প্রথমে পোড়াও ঐ পা দুটি যা চলৎশক্তিহীন,
তারপর যে-হাতে আজ প্রেম পরিচ্ছন্নতা কিছু নেই।
এখন বাহুর ফাঁদে ফুলের বরফ,
এখন কাঁধের পরে দায়িত্বহীনতা,
ওদের পুড়িয়ে এসো জীবনের কাছে
দাঁড়াও লহমা, তারপর ধ্বংস করো
সত্যমিথ্যা রঙে-শ্বেতে স্তব্ধ জ্ঞানপীঠ।'
বোঝাই যাচ্ছে - মৃত্যু হয়েছে কবির, দাহ করবার জন্য সমস্ত আয়োজন শেষ, আর কবি আগুনকে 'চিরপ্রণম্য' সম্বোধন করে পোড়াতে বলছেন তাঁর সবকিছু- চলৎশক্তিহীন পা, প্রেম-পরিচ্ছন্নতাহীন হাত, দায়িত্ববিহীন কাঁধ (যে কাঁধে সারাজীবন ধরে আমরা নানারকম দায়িত্ব বয়ে বেড়াই), তারপর 'সত্যমিথ্যা রঙে-শ্বেতে স্তব্ধ জ্ঞানপীঠ'- সবই।
সবই? না, এর পরের পঙক্তিতেই আছে-
'রক্ষা করো দুটি চোখ
হয়তো তাদের
এখনো দেখার কিছু কিছু বাকি আছে।'
অর্থাৎ, চোখ দুটো রক্ষা করতে বলছেন তিনি, কারণ- 'হয়তো' এখনো দেখার কিছু বাকি আছে! কি বাকে আছে? পরের পঙক্তিটি পড়ুন-
'অশ্রুপাত শেষ হলে নষ্ট করো আঁখি'
কার অশ্রুপাত? নিজের? না, বলাইবাহুল্য। তিনি তো মৃত এখন, নিজের অশ্রুপাতের প্রশ্ন নেই তাই। এইঅশ্রুপাত স্বজন-প্রিয়জন এমনকি অপ্রিয়জনদেরও! আমরা তো কখনো-কখনো নিজের অজান্তেই এমনটি ভাবি - আমি মরে গেলে কে-কে কাঁদবে আমার জন্য? কার দুচোখ ভেসে যাবে জলে? কার চোখের কোণ ভিজে উঠবে শুধু? কে-ই বা অবরুদ্ধ কান্নায় নিজেকে কেবল পুড়িয়েই চলবে? কবিও তেমনটি ভেবেছেন নিশ্চয়ই, আর তাই অশ্রুপাতগুলো দেখে যেতে চান। কিন্তু এ-ও জানেন এই অশ্রুপাত একসময় শেষ হবে, তখন- 'নষ্ট করো আঁখি'! কী অভূতপূর্ব একটি পঙক্তি, না?
কবিতার আসল বাঁকটি অবশ্য দেখা যাবে পরের পঙক্তিগুলোতে। নিজের সবকিছুই পোড়াতে বলছেন তিনি 'চিরপ্রণম্য অগ্নি'কে, কিন্তু একটি জিনিস না পোড়াবার জন্য মিনতি জানাচ্ছেন-
'পুড়িয়ো না ফুলমালা স্তবক সুগন্ধে আলুথালু
প্রিয় করস্পর্শ ওর গায়ে লেগে আছে।'
ফুলমালা-স্তবক যাকিছু দেয়া হয়েছে তার শবদেহে, তা যেন না পোড়ানো হয়! কেন? কারণ-
'প্রিয় করস্পর্শ ওর গায়ে লেগে আছে'
এ কি শুধু ফুলমালা? না তো! ওতে যে 'সুগন্ধে আলুথালু' প্রিয়জনের করস্পর্শ লেগে আছে! ওই করস্পর্শ কি পোড়ানো যায়?
কী বিপুল আবেগ, কী ভয়াবহ রোমান্টিকতা!
এবং পরের পঙক্তি-
'গঙ্গাজলে ভেসে যেতে দিও ওকে মুক্ত, স্বেচ্ছাচারি...'
ওকে পুড়িও না, হে অগ্নি, বরং গঙ্গাজলে ওকে ভেসে যেতে দাও- মুক্ত, স্বেচ্চাচারি। শেষের ডটচিহ্নগুলোও লক্ষ্য করবার মতো। এই ভেসে যাওয়ার মুক্ততা ও স্বেচ্ছাচারিতা যেন অনন্ত হয়, যেন অনন্তকাল ধরে 'প্রিয় করস্পর্শ' নিয়ে ওই ফুলমালা ভেসে যেতে পারে...
মাঝে মাঝে ভাবি, শেষ বয়সে এসেও এই কবির মধ্যে এমন তুমুল রোমান্টিকতা আসতো কোত্থেকে?
[উৎসর্গ : প্রিয় নিতির, তোমার সবকিছুর জন্য...]