প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসটা এলেই মনটা যেন কেমন করে উঠে। বিকেলের পর মনটাকে কোন ভাবেই কাজে ধরে রাখতে পারি না। মনটা ছুটে যেতে চায় বই মেলার প্রাঙ্গনে। নতুন বইয়ের সুবাস নিতে চায় প্রাণ ভরে। তাই প্রতি বছর কতবার যে বই মেলাতে যাওয়া হয় তার ঠিক নেই। কিন্তু সেই বছরটা ছিল অন্য রকম। শুধু অন্য রকম বল্লে হয়তো ভূল হবে। একটু বেশিই অন্য রকম। হ্যাঁ, আমি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের কথা বলছি।
সেদিন ৫ই ফেব্রুয়ারী। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর পরই মনটা কেন যেন এক দুসংবাদের আসংকায় কু করে উঠেছিল। তারপর থেকেই কোন কাজেই মনটা ঠিক মত বসাতে পারছিলাম না। সকালের নাস্তা না করেই বাসা হতে বের হয়ে পরি। এলোমেলো চিন্তা করতে করতে এক সময় বাড্ডায় আমার অফিসে গিয়ে হাজির হই। এখানে বলে রাখা ভাল সেই সময় আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের একটি সংগঠনে সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি। অফিসে পৌছেই হেডফোনটাকে কানে দিয়ে মোবাইলের রেডিওটাকে চালু করে দিলাম। অফিসে কাজের চাপ না থাকায় অনলাইন পত্রিকা গুলো থেকে খবর পড়া শুরু করলাম। তবুও কিছুতেই সস্তি পাচ্ছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল, আচ্ছা যদি এমন হয়, অপরাধ প্রমাণিত হলো, কিন্তু কোন কারণে মাননীয় ট্রাইব্যুনাল যদি মৃত্যুদন্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন বা অন্য কোন শাস্তি দেয়? তাহলে কি হবে? আর ১৯৭৩ সালের আইনটির আপীলের বিধানটি আমার কাছে সবসময়ই অপূর্ণ মনে হতো।
এক সময় খুব অস্থির লাগা শুরু হল। যখন আর সহ্য করতে পারছিলাম না, তখন অফিসের সামনের চায়ের দোকানটিতে গিয়ে বসলাম। ঠিক সেই সময় ৭১ টিভিতে তৎকালিন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক তুরিন আফরোজের লাইভ প্রোগ্রাম চলছে। কাপের পর কাপ চা খেতে খেতে শুনছিলাম সেই লাইভ প্রোগ্রামটি। একটু করে রিপোর্ট, একটু করে খবর, একটু করে পর্যালোচনা আর মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপন বিরতি চলছিল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজনের রায় নিয়ে প্রত্যাশার কথাও জানাচ্ছিল। একজন সাংবাদিক লাইভে রিপোর্ট করলো মাননীয় ট্রাইব্যুনাল রায় পাঠ করা শুরু করেছে। কানটাকে সজাগ করে বসলাম আর রায় শোনার অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষার পালা শেষে সেই সাংবাদিকের কন্ঠেই শুনলাম শাস্তির লিস্ট। কিন্তু এ কী! অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও শাস্তির যে লিস্ট বলছে তাতে তো মৃত্যুদন্ড নেই। আমি হতভম্ব। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অফিসে ফিরে এলাম। কি করব? আমার জায়গা থেকে কি করা উচিৎ? কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। মাথাটা খালি খালি লাগছিল। মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরে গেলাম। আর নিউজ শুনতে ইচ্ছে করছিলো না বলে টিভির সামনেও বসা হয় নি।
রাত প্রায় ১১ টা থেকে ১১:৩০ মধ্যবর্তী কোন এক সময় এক বড় ভাই মোবাইলে জানাল শাহবাগে বিপ্লব হচ্ছে, আমরা মানববন্ধন করেছি। আমরা রায় মানব না। আমরা রাজপথেই থাকব।
পরের দিন অর্থাত ৬ই ফেব্রুয়ারী, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই অফিসে। কিন্তু কাজে মন বসল না। মনটা ছুটে যাচ্ছিল শাহবাগে। সারাদিনই বিভিন্ন অনলাইন নিউজে শাহবাগের খবর দেখতে লাগলাম। খবর দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলাম শাহবাগে তো যাবই। তবে একাই যাব না কাউকে নিয়ে যাব। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম একাই যাব। আরও সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায়ও জানাব না। মনে আসঙ্কা ছিল যদি যেতে বাঁধা দেয়।
বিকেলে অফিস থেকে বোর হয়ে একাই রওনা দিলাম। সঙ্গে সাদাছড়ি। শাহবাগে পৌছে দেখি এক জনসমূদ্র। রাজাকারের ফাঁসীর দাবীতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে স্লোগান চলছে। আমিও স্লোগানে মিশে গেলাম। এক হাতে সাদাছড়ি, অন্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করে স্লোগান দিলাম ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই’, ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙ্গালী বাঙ্গালী’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ আরও কত মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান।
এরপর সাহবাগে যাওয়াটা নেশার মত হয়ে গেল। সময়-অসময়ে, কখনও পরিচিত মানুষের সাথে, কখনও সঙ্গিনীকে নিয়ে আবার কখনও একাই। বেশির ভাগ সময়ই বাসায় জানিয়ে যেতাম না। কারণ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীতার কারণে বাবা-মা আর স্ত্রী যেতে বাঁধা দেয়, দূচিন্তা করে। একদিন খবর পেলাম রাজিব ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। শেষ করে দেওয়ার চেষ্ঠা করা হচ্ছে গণমানুষের এই আন্দোলনকে। অনুভব করলাম রাজিব ভাই শহীদ হয়ে দায়িত্ব যেন আরও বাড়িয়ে দিল। আর সেই কারণেই হয়তো বাসায় না জানিয়েই সাহবাগে যাবার পরিমাণ আরও বেড়ে গেল।
শাহবাগের এই আন্দোলনের ফলেই সরকার আইন বদলাতে বাধ্য হয়েছিল। আগের আইনে আপিল করার সুযোগ ছিল শুধু দন্ডিতের। কিন্তু নতুন আইনে আপিল করার সুযোগ পেল প্রসিকিউশনও, যদি প্রসিকিউশন মনে করে অপরাধের তুলনায় শাস্তি যথেষ্ট হয়নি। এই আইনের বলেই গণমানুষের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঘৃণ্য কাদের মোল্লাকে সেই ভছর’ই ফাঁসিতে লটকানো সম্ভব হয়েছিল।
আজ গণমানুষের আন্দোলনের তৃতীয় বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এখনও আমরা সবগুলো নর্দমার কীটকে ফাসিতে ঝুলাতে পারি নি। পক্ষান্তরে আমাদের হারাতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কয়েকজন তরুণ যোদ্ধাকে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মাত্র তিন বছরের আন্দোলনেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ এক দীর্ঘ লড়াই। তবে আশার কথা এই বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম দেশ মাতৃকার ডাকে অতিতে যেমন বন্ধুর পথ ধরে হেটেছে, হাঁটছে এখনও। সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমাদের প্রত্যেকটি মানুষের ছোট ছোট উদ্দ্যোগই বাংলাদেশকে বিশ্বের মঞ্চে স্বগর্ভে মাথা তুলে দাড় করিয়ে দেবে। কোন অপোশক্তিই আমাদের রুখতে পারবে না। জয় আমাদের হবেই।
আশিকুর রহমান অমিত
ফেসবুক- https://facebook.com/ashiqur.rahmanamit.7
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৪