তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বলতে আমরা বুঝি, যে প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা তথ্য পাই কিংবা যার দ্বারা আমরা যোগাযোগ করতে পারি। আর এই কাজগুলো আমরা করি কম্পিউটার, মোবাইল/টেলিফোন, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, রেডিও প্রভৃতি যন্ত্রের সাহায্যে। এই যন্ত্রগুলো ব্যবহার করে আমরা যেমন একদিকে আমাদের প্রিয় মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারি, তেমনি আবার পারি তথ্য সংগ্রহ করতে। আর যখনি এই কাজগুলো আমরা সঠিকভাবে করতে চাই কিন্তু পারি না, তখনই আমরা প্রবেশগম্যতার বাঁধার সম্মুখীন হই। অর্থাৎ ঐ কাজটি করার জন্য আমাদের যে প্রবেশাধীকার পাওয়ার কথা ছিল তা আমরা পাই না।
এক্সেসিবিলিটি ব্যাপারটা আসলে কি? এক্সেসিবিলিটি হচ্ছে কোন একটি পন্য অথবা সেবা যা সকল মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সামর্থ্যের কথা মাথায় রেখে ব্যবহার উপযোগী করে তৈরী করা। একজন ব্যাক্তির সাময়িক বা দীর্ঘ মেয়াদী কিংবা পরিবেশগত প্রতিবন্ধীগতা থাকা স্বত্বেও তার যতটুকু সক্ষমতা আছে তা দিয়ে সে যেন ঐ পন্য কিংবা ঐ সেবা থেকে প্রয়োজনীয় সুবিধা পেতে পারে। আর প্রযুক্তি যখন মানুষের এই ভিন্ন ভিন্ন সামর্থ্যের কথা মাথায় না রেখে প্রবেশাধীকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তখনই আমরা বাধার সন্মুখীন হই। যেমন় ধরুন যদি কোন ওয়েব সাইট এর কালার ধূসর আর লিখার কালার কালো হয় তবে লেখা দেখতে খুব কষ্ট হবে, তাই না! কিংবা বাটন গুলোর অবস্থান যদি খুব কাছাকাছি হয় তবে সেগুলোকে চিহ্নিত করতে মুশকিলে প`ড়তে হয়। অথচ খুব সহজেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়। এই ধরণের এক্সেসিবিলিটি নিশ্চিত না করার ফলে একদিকে যেমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ও স্বল্প দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শিখন প্রতিবন্ধী অথবা দূর্ঘটনার দরুণ সাময়িক ভাবে হাত নাড়তে পারে না কিংবা দেখতে পায় না, এমন কি যারা টেকনোলোজিক্যালি সাউন্ড নয় অথবা বয়স্ক ব্যাক্তি তারাও বিভিন্ন সময় বাধার সন্মুখীন হন। অথচ বিশ্বব্যাপি এক্সসেবিলিটির যে কয়েকটা গাইড লাইন আছে তাতে সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে যে, একজন ব্যবহারকারীর কথা মাথায় রেখেই প্রযুক্তি তৈরী করতে হবে। অর্থাৎ প্রযুক্তি সহজ ব্যবহারের মাধ্যমে সবাই যেন তার কাঙ্খিত ফলাফল পেতে পারে। বাটনগুলো সম্পর্কে যেন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকে এবং তা যেন একটু দূরে দূরে অবস্থান করে তাও নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়াও ভিন্ন মাত্রার সামর্থ্যবান মানুষেরা যেন খুব সহজে এই প্রযুক্তি চালনার নির্দেশনা বুঝতে পারে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফলাফল পেতে পারে তাও নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কোন ব্যাক্তি যদি প্রযুক্তির বর্তমান সেবা গুলো পেতে ব্যর্থ হয় তার জন্য যেন বিকল্প সেবার ব্যবস্থা থাকে। যেমন ধরা যাক, একটি ওয়েব সাইটে কৃষি বিষয়ক কিছু তথ্য আছে। একজন শিক্ষা প্রতিবন্ধী মানুষ চাচ্ছেন তা থেকে তথ্য পেতে। যদি ঐ ওয়েব সাইডে অডিওর কোন ব্যবস্থা না থাকে তাহলে কী ঐ মানুষটি সেই তথ্য পেতে পারবে? নিশ্চই না! আর যদি ওয়েব সাইটটিতে টেক্সের পাশাপাশি অডিও কন্টেন্ট থাকে তাহলে সেই ব্যক্তিটি খুব সহজেই তার কাঙ্খিত তথ্যটি পেতে পারবে। শুধু সেই ব্যক্তিই নয় একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও সেই তথ্যটি পেতে পারবে। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারবো সেই ওয়েব সাইটটি তৈরী করা হয়েছে সবার কথা মাথায় রেখে।
একটি প্রযুক্তির এক্সেসেবিলিটি যদি নিশ্চিত করা যায় তবে একদিকে যেমন ব্যবহারকারী উপকৃত হবে। অন্য দিকে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যারা এই সেবাটিকে জনগণের কাছে পৌছে দেয় তারাও লাভবান হবে। সর্বোপরি সমাজ উপকৃত হবে। যেমন় একজন ব্যবহারকারী যদি খুব সহজে ও স্বাধীন ভাবে প্রযুক্তিটি ব্যবহার করতে পারে তবে সে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারবে। আর এর ফলে দেশের মানুষের কাছে যেমন চাহিদা বাড়বে অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরী হবে। ফলে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন আর্থিক ভাবে লাভবান হবেন, অন্যদিকে লাভবান হবেন যারা সেই সেবাটি জনগণের কাছে পৌছে দিবে। ফলে যেমন কর্মদক্ষ লোকের পরিমান বাড়বে, তেমনি বেকারত্বের সংখ্যাও কমবে। আর এই সব কিছু ঘটবার ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সুসংহত হবে।
আমাদের দেশটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ডিজিটেলের পথে, কিন্তু সেই পথে আমরা কি সকলকে নিয়ে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারছি?আমরা কিছু মানুষকে বাদ দিয়েই শুধু ছুটছি সামনের দিকে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল সত্তর দশকের “এডুকেশন ফর অল” ঘোষণার বাস্তবায়নের বেলায়। আপনাদের হয় তো মনে আছে নব্বই দশকের প্রথম দিকে সরকার বলেছিল সকল শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সময় “প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতা মূলক” একটি আইনও পাস হয়েছিল।কিন্তু সেই আইনের একটি ধারায় বলা ছিল “কোন প্রধান শিক্ষক যদি মনে করে একজন প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষা গ্রহণে অযোগ্য তবে তিনি শিশুটিকে স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য নন।” আর এই অযু হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে হাজার হাজার প্রতিবন্ধী শিশুকে। বঞ্চিত করা হয়েছিল তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে। তারও কিছু বছর পর অর্থাৎ ২০০৯ সালে অবশ্য একটি পিএম ওয়াডার জারি হয় যে “কোন প্রধান শিক্ষক যদি প্রতিবন্ধী হবার কারণে কোন শিশুকে ফিরিয়ে দেয় তবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” আর ঠিক সেই সময়ের পর থেকেই শুরু হয় প্রাইমারী স্কুলগুলতে ঢালু পথ তৈরীর কাজ, পাশাপাশি দেয়া হয় অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। ফলে আজ প্রতিবন্ধী শিশুরা পাচ্ছে তাদের শিক্ষার অধিকার।
ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য যদি ডিজিটেল বাংলাদেশ গড়তে হয় তবে কিছু উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করা উচিৎ। তবে সব উদ্যোগ শুধু মাত্র সরকারকে নিলেই চলবে না, পাশাপাশি আমাদের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট সেকটর, সুশিল সমাজ সবাইকেই কিছু না কিছু দায়িত্ব নিতে হবে।
সরকারের প্রথম কাজ হবে সরকারী ও বেসরকারী ওয়েব সাইটগুলোকে এক্সেসেবল করার উদ্যোগ নেয়া। কারণ এই ওয়েব সাইট গুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তথ্য পায়। আমাদের দেশের ব্যাংক গুলো নানা রকম ডিজিটেল সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু তা শুধু শিক্ষিত আর অপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য। এইসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আর শিক্ষা হতে বঞ্চিত মানুষেরা। ধরা যাক এটিএম বুথেরই কথা। এটিএম বুথ গুলোতে টকিং সিসটেম না থাকার কারণে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও শিক্ষা প্রতিবন্ধী গোষ্ঠীর পক্ষে টাকা উত্তোলন একটা যুদ্ধের মত।কারণ টাকা উত্তোলনের জন্য অন্যের হাতে পায়ে ধরে সাহায্য নিতে হয়। আবার অন্যদিকে তারা প্রায়ই প্রত্যারণার সন্মূখীন হন। কারণ কত টাকা তোলা হল বা ব্যালেন্স কত আছে তা তারা জানতে পারেন না। আর হুইল চেয়ার ইউজ্যারদের কথা তো বাদই দিলাম, তাদের তো সেখানে যাবার অধিকারই দেয়া হয়নি। এখন আবার মোবাইল ব্যাংকিং চালু হয়েছে। আপনি প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র নিয়ে এজেন্ডের কাছে গেলে তারা আপনার একাউন্ট খুলে দিবে। কিন্তু সমস্যা হলো একাউন্ট খোলার প্রক্রীয়াতে! প্রক্রীয়ার এক পর্যায়ে ব্যাংকের আইটি থেকে একটা ফোন আসে এবং আপনাকে চারটি নম্বর প্রেস করতে বলে, এখানে একজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যাক্তি কিভাবে তা প্রেস করবে? অর্থাৎ তাকে সাহায্য নিতে হয় অন্যের। ফলে তার পাসওয়ার্ড প্রাইভেসি নষ্ট হয়। ব্যাংক গুলোকে এখনই এ বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয়া উচিৎ বলে মনে করি।
আমাদের দেশে বর্তমানে সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের এপলিকেশন সফ্টওয়ার। অথচ তা তো সব ধরণের মানুষ ব্যবহার করতে পারছে না। যদি এই সফ্টওয়ারগুলো তৈরী করার সময় এক্সেসিবিলিটি গাইড লাইন মেনে আর তা পরীক্ষা করে বাজার যাত করা হতো তবে একদিকে যেমন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ত, অন্যদিকে কর্মদক্ষ মানুষের সংখ্যাও বাড়ত। সব আইটি ফার্মগুলো যদি একজন/দুইজন দক্ষ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষকে এক্সেসিবিলিটি এডভাইজার পদে নিয়োগ দেয়, তবে খুব সহজেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
আবার মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন সার্ভিস আছে, যা শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়টা এক্কেবারে বাদ পরে গেছে। আর এসব কিছুই সম্ভব হবে যখন আমাদের দেশে একটি আই সি টি ইউনিভারসেল ডিজাইন গাইড লাইন থাকবে এবং সরকারের সকল আইন ও পলিসিতে তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে।
পরিশেষে এ কথাই বলতে চাই আমাদের দেশের তথ্য ও প্রযুক্তি যেন সব ধরণের মানুষের ভিন্নতার কথা মাথায় রেখে গড়ে উঠে। আইসিটি এর সুবিধা যেন পায় সব ধরণের মানুষ।
এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত
ডিজেবিলিটি একটিবিষ্ট
ইমেল- [email protected]
ফেস বুক- [email protected]
বিংদ্রঃ: এই লিখাটি বাংলাদেশের একমাত্র তৃমাসিক প্রতিবন্ধীতা বিষয়ক পত্রিকা ‘অপরাজেয়’ এর মার্চ মাসের সংখায় প্রকাশিত হয়।