আমাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করার অভ্যাস নাই। আমরা মনে করি, সামাজিক দায়িত্ব মানে হল দান করা বা ভিক্ষা দেয়া। দান বা ভিক্ষার বাইরেও সামাজিক দায়িত্ব আছে।
করোনা হওয়ার পর আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা আসলে কোন হাসপাতাল গড়িনি। ঢাকার বাইরে কোন হাসপাতালই করোনা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমরা আরও দেখলাম, বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলো মূলত হাসপাতাল নয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
করোনার মতো কোন জরুরী সমস্যা যদি শিক্ষাখাতে দেখা দেয়, আমরা দেখব, আমরা আসলে স্কুল কলেজও গড়িনি তেমন একটা। বেসরকারী খাতে যে স্কুল কলেজগুলো গড়া হয়েছ সেগুলোর বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়।
আগে মানুষ ধনী হলে এলাকার মানুষের জন্য স্কুল কলেজ বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করত। সম্পূর্ণ সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে মানুষের উপকারের জন্য ধনকুবেররা এই সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেন। এখন ধনকুবেররা দেশের বাইরে টাকা পাচার করেন। স্ত্রী বা বাচ্চাদের কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বা আমেরিকায় রাখেন। দেশ থেকে টাকা উপার্জন করেন এবং বিদেশে খরচ করেন।
এই রকম সামাজিক বাস্তবতায় আমাদের পর্যাপ্ত স্কুল কলেজ কখনও ছিল না, এখনও নেই। সরকারী স্কুল কলেজ আরও কম।
মূল প্রসঙ্গে আসি।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর স্কুল কলেজ বন্ধ। কবে খুলবে কেউ জানে না। স্কুল কলেজ বন্ধ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই স্কুল কলেজে ছাত্র বেতন দেয়াও বন্ধ। এবং আরও বেশি স্বাভাবিকভাবে সরকারী স্কুল কলেজ ছাড়া অন্যান্য স্কুল কলেজের শিক্ষকদের বেতনও বন্ধ।
আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত শ্রেণী হল স্কুল শিক্ষক। সামাজিকভাবে তাদের কোন সম্মান নাই। মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য আমরা বিসিএস অফিসার খুঁজি , স্কুল শিক্ষক খুঁজি না।
যাই হোক, একজন স্কুল শিক্ষকের আয় খুব সীমিত। এ কারণে স্কুলের বাইরেও তাকে টিউশনি করতে হয়। কেউ কেউ কোচিং সেন্টার চালান। কোচিং সেন্টার চালানোর মতো বিষয় সবাই পড়ান না। তাদের কোচিং থেকে আয় করার সুযোগ নাই।
করোনার কারণে স্কুল কলেজের পাশাপাশি টিউশনি বা কোচিংও বন্ধ। ফলে শিক্ষকদের আয় করার সব রাস্তা বন্ধ।
কোন কোন স্কুল কলেজ অনলাইনে ক্লাস চালু করেছে। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস নেয়াটাকে পছন্দ করেন না। অন্য দিকে, অনেক শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নিতে অভ্যস্ত নন। এমনকি অনেকে ভালোভাবে ফেসবুকও চালাতে পারেন না।
তবে বাঙালি সমাজের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য জানি। এরা অনলাইনে সানি লিওনের ভিডিও ঠিকই খুঁজে বের করতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনীয় কোন তথ্য গুগল করে বের করতে পারে না। হাতে স্মার্ট ফোন থাকলেও তারা নিজেরা এই জায়গায় স্মার্ট না।
যাই হোক, ছাত্র বেতন বন্ধ। শিক্ষকদের বেতনও বন্ধ। অন্য কোনভাবে আয়ের ব্যবস্থাও নাই। এই লোকগুলো কিভাবে বাড়ি ভাড়া দিবে ? খাবে কী ?
এই অবস্থায় অনেক বেসরকারী স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষকের চাকুরি চলে গেছে। আমরা দেখেছি, উপায় না পেয়ে অনেক শিক্ষক হকারি করতে শুরু করেছেন। পেশা বদল করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন অনেকে।
অভিভাবকদের সামাজিক দায়িত্ব এখানে ছিল। কিন্তু তারা সেই সামাজিক দায়িত্ব পালন করবেন না। তারা স্কুলের বেতন দেবেন না। বরং আমি পরিষ্কার জানি, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল বহু অভিভাবক স্কুল খোলার পর ছাত্র বেতন মওকুফ বা কমানোর জন্য দরখাস্ত করবেন। ফলে স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।
করোনা না হলে আমরা ঠিকই স্কুল কলেজের বেতন দিতাম। করোনার জন্য এখন বেশির ভাগ মানুষের আয় রোজগার বন্ধ নয়। কিন্তু কেউ স্কুলের বেতন দেবে না।
একটা স্কুল বা কলেজ গড়া সহজ নয়। আজ যদি আপনার সন্তানের স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায়, কয় দিন পর আপনিই বিপদে পড়বেন। ছেলে মেয়েদের পড়ানোর জন্য স্কুল কলেজ খুঁজে পাবেন না। সুতরাং আমরা ভিক্ষা বা দান নয়, নিজের দায়িত্বটা পালন করি। স্কুল কলেজের জমে থাকা বেতনগুলো আমরা পরিশোধ করে দিই। স্কুল কলেজগুলো টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। আমরা কি স্কুল শিক্ষকদের প্রতি আরও বেশি মানবিক হতে পারি না ?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:০২