পর্ব - ০৩
প্রথম কাজ : সৃজনশীল ভাবনা গল্পের তরে
ভাবনা হবে সৃজনশীল। মানে সৃজন করার জন্য। সৃজন করতে হলে ভাবতে হবে। সেই ভাবনা এলোমেলো হলে হবে না। হতে হবে গুছানো। হতে হবে পরিকল্পিত। হবে হবে সেই মাধ্যমের উপযোগী যেই মাধ্যমে সৃজনশীল কাজটি হবে।
আপনি চলচ্চিত্র বানাবেন। তার জন্য গল্প লিখবেন। সেই গল্প হতে হবে চলচ্চিত্রের উপযোগী। নচেৎ সেই গল্পের কোন মূল্য নাই।
চলচ্চিত্রের গল্প কেমন হয় ? চলচ্চিত্রে আমরা কতগুলো চলমান দৃশ্য দেখি। আর শুনি কিছু শব্দ। তাই গল্পের মধ্যে থাকতে হবে কিছু দৃশ্য বা ছবি এবং কিছু শব্দ। যেই গল্পই বানান না কেন সেটাকে দৃশ্যে এবং শব্দে প্রকাশ হবে।
কিভাবে বানাবেন চলচ্চিত্রের গল্প ?
পৃথিবীর সব গল্প বানানোর একটা সহজ নিয়ম আছে।
এই সহজ নিয়মের জন্য দরকার মগজের ঝড়। ইংরেজিতে যেটাকে বলে ব্রেইন স্টর্মিং - সেটার সোজা বাংলা মগজের ঝড় বলাই ভালো।
যাই হোক, মগজের ঝড় কিভাবে তুলবেন এবং সেটাকে কিভাবে আপনার গল্প বানাতে ব্যবহার করবেন সেটাই হল আলোচ্য বিষয়। এই মগজের ঝড় তোলার নানা কায়দা আছে। অত বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে আমরা সহজ করে বুঝি।
প্রথমে ভাবুন একটা মূল বক্তব্য নিয়ে। কী বলতে চান আপনি এই চলচ্চিত্রের দিয়ে ? যেমন, আপনি বলতে পারেন :
০১) মানুষ মানুষের জন্য।
এই সহজ কথাটি বোঝানোর জন্য আপনি একটি গল্প তৈরি করতে পারেন । সেই গল্পে কোন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে অন্য মানুষের জন্য জীবন বিলিয়ে দেবে। অপর জন তার এই বিলিয়ে দেয়ার কথা প্রথমে জানবে না। যখন জানবে তখন আর প্রতিদান দেয়ার সময় নাই।
অথবা
০২) প্রেম নয়, টাকাই বড়।
একটি প্রেমের গল্প। গল্পের শেষে দেখা গেল কেবল টাকার জন্য নায়ক / নায়িকা অপর জনকে ছেড়ে গেল। অপরজন তার এই দুঃখে তার জীবন বিসর্জন দিল ।
অথবা
০৩) টাকা নয়, প্রেমই বড়।
এইটিও একটি প্রেমের গল্প। এই গল্পে গল্পের নায়ক টাকার মোহ ছেড়ে তার প্রেমাস্পদকেই বড় করে দেখবে। টাকা বা সম্পদের হাতছানি এড়িয়ে সে তার প্রেমের জন্য একের পর এক ত্যাগ করতে লাগল। কিন্তু তার এই প্রেমের মূল্য দিতে গিয়ে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হল।
আরেকটা কথা, গল্পের এই মূল বক্তব্যটা গোপন রাখতে হবে। কোথাও প্রকাশ্যে বলা যাবে না। যত গোপন রাখা যাবে, যত কৌশলী হওয়া যাবে, ততই গল্পটা শৈল্পিক হয়ে উঠবে । কিন্তু সে জন্য গল্পটি জটিল করা যাবে না, গল্পটি হবে সহজবোধ্য, যুক্তিসঙ্গত, অদ্বিতীয় ও স্বাভাবিক সম্ভাব্য ঘটনায় ভরপুর। এমন কোন ঘটনা থাকবে না, যেটা খাপ খায় না, অস্বাভাবিক লাগে। তেমন কোন ঘটনা জুড়ে দেয়ার লোভ দমন করতে হবে, আবেগ সংযত করে সেই অংশটুকু নিষ্ঠুরের মতো বাদ দিয়ে দিতে হবে।
এবার মগজের ঝড় বিষয়টা বোঝার জন্য একটা অনুশীলনী করা যাক।
অনুশীলনী :
০১) এক টুকরো সাদা কাগজ ও কলম নিন।
০২) একটি শব্দে একটি বিষয় বেছে নিন। শব্দটি কাগজের মাঝখানে লিখুন। মনে করুন, এটি একটি বীজ। এই বীজ থেকে একটি চারা গাছ জন্মাবে। এই চারাগাছটিই আমাদের নির্মিয়মান চলচ্চিত্রটি। যেমন : শব্দ হল - ঈর্ষা।
০৩) এবার সেই শব্দটি থেকে একটি বাক্য রচনা করার চেষ্টা করুন। বাক্যটি চারাগাছটি কত বড় হবে সেটা নির্ধারণ করে দেবে। যেমন : ঈর্ষা মানুষের সর্বনাশ করে।
০৪) এই বাক্যটি এমন হবে যেন গল্পের শুরু, মধ্য ও শেষ বিষয়ে একটা আভাস দেয়। যেমন : ঈর্ষা মানুষের সর্বনাশ করে - এই বাক্যে একটা গল্প শুরু হবে ঈর্ষা দিয়ে এবং মধ্যভাবে ঈর্ষার মাধ্যমে কেউ কারো ক্ষতি করবে এবং গল্পের শেষে তার হবে সর্বনাশ। তার মানে হল এই বাক্যটি এমন যে, এই বাক্যটি থেকে এমন একটি গল্প তৈরি করা সম্ভব - যার শুরু, মধ্য ও শেষ আছে।
০৫) এই বাক্যের চারপাশে সাদা কাগজের মধ্যে ঈর্ষা ও সর্বনাশ সংক্রান্ত যত শব্দ মনে পড়ে সবগুলো শব্দ লিখে ফেলুন। প্রত্যেকটি শব্দ দিয়ে একটি করে ঘটনা তৈরি করার চেষ্টা করুন। কিন্তু এই ঘটনাগুলো মূল বাক্যের বিপরীত কোন বক্তব্য প্রকাশ করবে না।
যেমন : লিখুন, ক্ষতি করা, চুরি করা, আগুন লাগানো, এসিড মারা, কান ভাঙ্গানি দেয়া - এই প্রতিটি কাজ ঈর্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত ।
আবার সর্বনাশের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দ হতে পারে - মারামারি হওয়া, সংঘর্ষ হওয়া, দাঙ্গা লাগা, টাকা হারানো, মামলা -মোকদ্দমায় জড়ানো, লুট হওয়া, ভাংচুর হওয়া, অসুস্থ হওয়া ইত্যাদি।
০৬) এই ভাবে শব্দ লিখে লিখে কাগজটি ভরে ফেলুন। যত বেশি শব্দ লেখা যায়, ততই ভালো। তবে শব্দগুলির মধ্যে দেখার ও শোনার উপাদান থাকলে ভালো হয়। কেননা চলচ্চিত্র তো দেখা ও শোনার মাধ্যম। কিন্তু এমন কোন শব্দ লেখবেন না যেটা এই মূল বক্তব্য বা বাক্যটির সাথে সম্পর্কিত নয়।
০৭) বীজ থেকে পুরো বৃক্ষ হতে যেমন নানা দুর্যোগ পেরুতে হয়, তেমনি অনেক বাধা বিঘ্ন ঘটার মতো ঘটনার কথা লিখুন। তবে সেই সব ঘটনা এই কাগজে নয়, অন্য কোন কাগজে লিপিবদ্ধ করুন।
০৮) তার মানে দাঁড়াল এই, আপনি মূল বক্তব্যটি দিয়ে এমন একটি বাক্য রচনা করবেন যেটা গল্পের শেষ, মধ্য ও শুরু প্রকাশ করবে। বিশেষ করে গল্পের শেষটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গল্পের শেষ কিভাবে হবে সেটাই আগে নির্ধারণ করে নিন।
এই যে কাজটা করলাম, এটাই হল মগজের ঝড় বা ব্রেইন স্টর্মিং। একটা ভালো গল্প লেখার জন্য মগজে ঝড় তুলে বিষয়টা আগে বুঝে নিতে হবে। এটা হল সহজ পন্থায় মগজের ঝড়। নানাভাবে মগজের ঝড় তোলা যায়। এই কাজটি নতুনদের জন্য খুবই জরুরী। যারা অভিজ্ঞ তাদের জন্য এই রকম মগজের ঝড় না তুললেও চলবে।
(অফ টপিক : আমার লেখা "কিভাবে আপনার প্রথম চলচ্চিত্রটি বানাবেন ? " নামের একটি অপ্রকাশিত বই থেকে লেখাটি দেয়া।)
পর্ব - ০১
পর্ব - ০৩
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ১২:৩২