বারবার ঢোক গিলছি, কথাই বলতে পারছি না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে “হ্যাঁ-হু” উত্তর দিচ্ছি , এর বেশি কিছু বের হয় না মুখ থেকে... সন্ধ্যার পর থেকেই এমনটি হচ্ছে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কেন... কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না, দুপুরেও খাইনি কিছু। চিন্তা করলাম, রাতেও কিছু না খেলে মা কষ্ট পাবে, মা সেই সকাল থেকেই কি সব জানি রান্না করছে , মা এরই মধ্যে তিনবার ডেকে গেছে খাওয়ার জন্য। ডাইনিং টেবিলের দিকে যেতেই খেয়াল করলাম সবই আমার পছন্দের খাবার। অনেক অনিচ্ছা সত্তেও খেলাম, না জানি আবার কবে এই রান্না খেতে পারব!
মায়ের দিকে তাকাতেই পারছি না, তাকালেই কেমন জানি লাগছে, বুকের মধ্যে কেমন জানি একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে... রাত ১২টায় ট্রেন, চিটাগাং যাচ্ছি আমি...
চুয়েটে ভর্তির সময় একবারও চিন্তা করিনি এই মাকে ছাড়া থাকব কিভাবে! তবে আজ এমন কেন হচ্ছে?
ফ্রেশ হয়ে রুমের দরজা লক করে চুপচাপ বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। কত কিছু ভেবে চলেছে আমার মন!
দরজায় হঠাৎ নক করার শব্দে সম্বিৎ ফিরল আমার, মায়ের কণ্ঠ।
“লাগেজ গুছিয়েছিস?”
“উঁহু”
“কোন কোন শার্ট-প্যান্ট নিবি?”
কিছু প্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট দেখিয়ে দিলাম, মা ওগুলো প্যাক করতে থাকল। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ... নিঃশ্বাস আমার ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে... মাথার ভেতর ১০১ টা ভাবনা...
“থাকবো কিভাবে এই মাকে ছেড়ে, ছোট বোনটাকে ছেড়ে?”
আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে আমার অনেকগুলো কাজিন ইতোমধ্যে বাসায় হাজির হয়েছে, ওরা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বিভিন্ন ভাবে ডিসট্রাকড করার চেষ্টা করছে, কিন্তু লাভ হয়নি। “মা” কে ভোলানো এত সহজ?
এমনিতেই বাসার ফ্যামিলি মেম্বার কম, বড় বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে আগেই, বাবা তো সারাদিনই বাইরে বাইরে থাকে, আমি, মা আর ছোট বোনটা, এই আমাদের মিনিপ্যাক ফ্যামিলি... চিটাগাং চলে গেলে ছোট বোনটার জন্যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হবে, সারাদিন যে এত বকবক করতে থাকে পাগলিটা ... ওকে অনেক বেশি মিস করব...
আমি এমনিতেই রাতে দেরি করে ঘুমাই, ৪ তার দিকে, আর ও ঠিক ৭ তার সময় এসে বলবে, “ভাইয়া, এই অঙ্কটা একটু বুঝিয়ে দাও না... প্লিজ ভাইয়া, ওঠো”
আমি যেই বলব, “ কাল সারাদিন কি করেছিস?? কাল বলতে পারিস নি??!”
আর ও বলবে, “ ও ভাইয়া, তুমি অনেক ভাল, ওঠো না! দেরি হয়ে যাচ্ছে, ৭.৩০ এ স্কুল”
অগত্যা আমাকে উঠতে হয় কাচা ঘুম ভাঙিয়ে, আর এটা প্রায় রোজই ঘটে!
এমনি আরও কত শত ভাবনা ভাবতে ভাবতে কখন যে ১০.৩০ বেজে গেছে, টেরই পাইনি। ঘড়ির কাটাটা আজ বোধহয় একটু বেশিই দ্রুত ছুটছে! কোন ভাবেই কি সময়কে কিছু সময়ের জন্যে বেধে রাখা যায় না? আমার "মা" টাকে আরেকটু সময় ধরে দেখতাম!
গিটারটা কাধে নিয়ে লিফটের সামনে দাড়িয়েই মাকে জড়িয়ে ধরলাম, মা বললেন, “মন দিয়ে পড়াশোনা করিস, অন্য কোন দিকে খেয়াল দিবি না, রাজনীতির মধ্যে জড়াবি না, সময় মত খাওয়া দাওয়া করবি, তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন”
বললাম, “ আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনি ভাল থাকবেন”
অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রাখলাম, কিন্তু লিফট থেকে নেমে আর পারলাম না... চোখের কোণটা ভিজে উঠল ধীরে...