সাইবার ‘যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে উইকিলিকসের সমর্থকেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার কম্পিউটার হ্যাকারদের গোষ্ঠী ‘অ্যানোনিমাস’-এর এক সদস্য জানান, আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। হ্যাকারদের এই আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছে, ‘অপারেশন পে ব্যাক’।
উইকিলিকস ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এমন একাধিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে আক্রমণ করেছে হ্যাকাররা। এগুলো উইকিলিকসকে সেবা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি সুইডেনের সরকারি ওয়েবসাইট ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কার্যালয়ের ওয়েবসাইটেও আক্রমণ করে হ্যাকাররা। খবর বিবিসি, এএফপি ও এনডিটিভি অনলাইনের।
অ্যানোনিমাসের সদস্য ও ওই গোষ্ঠীর মুখপাত্র কোল্ডব্লাড (ছদ্মনাম) বলেন, ‘বটনেট টুল’ ডাউনলোডের হার বেড়েছে। এটি হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারা সফটওয়্যারের গুচ্ছ। ওয়েবসাইটে আক্রমণ চালানোর কাজে হ্যাকাররা এই বটনেট টুল ব্যবহার করে। ওয়েবসাইটে এই হামলা চালানোকে ‘তথ্যযুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করে কোল্ডব্লাড বলেন, ‘হাজার হাজার ইন্টারনেট ব্যবহারকারী স্বেচ্ছায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। আমরা ইন্টারনেটকে উন্মুক্ত ও স্বাধীন রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশের সরকার ইন্টারনেটে আমাদের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করছে।’
কোল্ডব্লাড বলেন, ‘আমাদের ধারণা, উইকিলিকস শুধু তথ্য ফাঁসের ওয়েবসাইট হিসেবে এখন আর নেই। বরং এটি একটি রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে, যেখানে লড়াই চলছে নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের।’
হ্যাকাররা গত মঙ্গলবার সুইডিশ তদন্ত কর্মকর্তার কার্যালয়ের ওয়েবসাইট এবং অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলাকারী দুই নারীর আইনজীবীদের ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেন। অনলাইনে আর্থিক লেনদেনের প্রতিষ্ঠান পেপ্যাল এবং সুইজারল্যান্ডের সুইস পোস্ট অফিস ব্যাংকের ওয়েবসাইটেও হামলা চালানো হয়। এ ছাড়া ‘অ্যানোন-অপারেশন’ নামের আরেকটি হ্যাক্টিভিস্ট গোষ্ঠী ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি মাস্টারকার্ডের ওয়েবসাইটে আক্রমণ করে। কোম্পানির মুখপাত্র জানিয়েছেন, হ্যাকাররা তাঁদের অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনা ও অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থায় কোনো বাধা সৃষ্টি করেননি। সর্বশেষ গত বুধবার আক্রান্ত হয় সুইডেন সরকারের ওয়েবসাইট এবং ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি ভিসার ওয়েবসাইট।
ভিসার ওয়েবসাইট অবশ্য পরে আবার চালু করা হয়েছে। কোম্পানির মুখপাত্র টেড কার বলেন, তাঁদের প্রক্রিয়াকরণ নেটওয়ার্ক, যা গ্রাহকদের লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করে, তা ঠিকভাবেই কাজ করছে।
উইকিলিকসের সমর্থক হ্যাকাররা আমাজন ডটকম এবং মার্কিন সিনেটর জো লিবারম্যানের ওয়েবসাইটেও আক্রমণ করেছেন। জো লিবারম্যান উইকিলিকসের কট্টর সমালোচক।
উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রেলীয় নাগরিক অ্যাসাঞ্জ গত মঙ্গলবার ব্রিটেনে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁকে সুইডেনে দুই নারীর দায়ের করা যৌন নিপীড়নের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। মঙ্গলবার লন্ডনে আদালতে নেওয়া হলে বিচারক অ্যাসাঞ্জকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন। বর্তমানে তিনি ব্রিটেনে পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।
দুই সপ্তাহ ধরে গোপন মার্কিন কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশ করে চলেছে উইকিলিকস। যুক্তরাষ্ট্র এই তথ্য ফাঁসের ঘটনাকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’ ও ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর হামলা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
এদিকে অপারেশন পে ব্যাক-এর ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে ওই দুটি ওয়েবসাইটের কর্তৃপক্ষ। টুইটার কর্তৃপক্ষের এক বার্তায় জানানো হয়েছে, ওই অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। হ্যাকাররা সাইবার আক্রমণের সমন্বয় করতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ওই দুটি সামাজিক নেটওয়ার্ক ওয়েবসাইট এবং অন্যান্য ‘চ্যাট রুম’ ব্যবহার করে আসছেন।
তবে হ্যাকাররা অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে যোগাযোগ শুরু করেছেন। পাশাপাশি তাঁরা টুইটারকে তাঁদের পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবেও ঘোষণা করেছেন। হ্যাকারদের অভিযোগ, টুইটার কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে আলোচিত শব্দের তালিকা থেকে উইকিলিকস শব্দটি সরিয়ে রেখেছে। তবে ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে টুইটার।
এ ব্যাপারে উইকিলিকসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা এ ধরনের আক্রমণকে সমর্থনও জানাচ্ছে না বা এর নিন্দাও করছে না। উইকিলিকসের সঙ্গে অ্যানোনিমাসের কোনো সংযোগ নেই। অ্যানোনিমাস স্বাধীনভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়াল-অব-সার্ভিস’ (ডিডিওএস) পদ্ধতিতে আক্রমণ চালাচ্ছেন হ্যাকাররা। এর অর্থ হচ্ছে হ্যাকাররা অনলাইনে একই সময়ে এত বেশি পাতা খোলার নির্দেশ দেন যে ওই নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটটির গতি ধীর হয়ে যায়। এর সেবা বিঘ্নিত হয়।
ইমপারভা নামের একটি সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন বিশ্লেষক নোয়া বার ইয়োসেফ বলেন, আক্রমণগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট। পরিচিতদের মধ্য থেকেই আক্রমণকারীদের বেছে নিচ্ছেন হ্যাকাররা।
অ্যাসাঞ্জের সমর্থনে সমাবেশ: অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন স্কয়ারে গতকাল উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে সমর্থন জানাতে সমাবেশের আয়োজন করেন তাঁর সমর্থকেরা। সোশ্যালিস্ট অল্টারনেটিভ নামের নাগরিক সংঘের সদস্য জেসিকা পেইন জানান, বিশ্বের যেসব দেশের সরকার অ্যাসাঞ্জের ‘কাটা মাথা’ দেখতে চাচ্ছে, তাদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সরকারের যোগ দেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, ‘অ্যাসাঞ্জের দোষ শুধু এটুকুই, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর কিছু মানুষের ভাবনা ও মন্তব্য প্রকাশ করে দিয়েছেন।’
তথ্য ফাঁস বেআইনি: অস্ট্রেলিয়া
উইকিলিকসে তথ্য ফাঁসের ঘটনাকে বেআইনি হিসেবে অভিহিত করেছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। এর ব্যাখ্যায় তারা বলেছে, অস্ট্রেলিয়ায় গোপনীয় তথ্য সংগ্রহে রাখা, অথবা তা পরিবেশন করা অবৈধ। গতকাল সে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট ম্যাকক্লেল্যান্ড বলেন, অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গোপন দলিল হস্তগত করা বা তার পরিবেশন এক ধরনের অপরাধ। সে অর্থে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ অপরাধ করেছেন কি না, তা জানতে চেয়েছেন তিনি।
অবশ্য এর আগে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেভিন রাড বলেছেন, তথ্য ফাঁসের মূল দায় যুক্তরাষ্ট্রেরই, উইকিলিকসের নয়।