এক.
- তোমার অফিসে জব করবো ।
- আমার অফিসে ?!
- হ্যা ।তোমার অফিসে আমাকে জব দাও ।
- আমার অফিস কি আর আমার কথা মতো চলে ! কিন্তু হঠাৎ জব করতে চাইছো, তাও আবার আমার অফিসে ?
- হুম তোমার অফিসে ।
- আমার টীমে ?
- হুম তোমার টীমে ।
- আচ্ছা তাই ?!
- হ্যা তাই । তুমি প্রতিদিন আট-দশ ঘন্টা অফিস করো । আর আমার সাথে তোমার দেখা হয় সপ্তাহে একবার । তাও কখনো দুই-তিনঘন্টার বেশি না । এসব একদম ভাল্লাগেনা আমার । তোমার অফিসে জব নিয়ে আমি তোমাকে প্রতিদিন প্রতিদিন দেখতে পাবো । যা বিজি মানুষ আপনি ! এছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না ।
- ওরে দুষ্টু এই প্ল্যান তোমার ?! তুমি আমার অফিসে জব নিলে আমার কি আর অফিসের কাজ করা হবে শুনি !
ভীষণ শীতের একটা ছুটির সন্ধ্যায় কনকনে হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে হুডখোলা রিকশায় ক্রমাগত বাড়তে থাকে ওদের খুনসুটি,মান অভিমান । আর একই চাদরে মুড়িয়ে উষ্ণতা ভাগাভাগি করতে করতে কখন যেন একসাথে বোনা হয়ে যায় স্বপ্নটাও ।
ওরা দুজন । একজন পুরুষ । একজন নারী । একজন আদম । আরেকজন ঈভ ।
দুই.
-আবারো জানালার পাশে বসেছো ? কদিন ধরে কিন্তু শীতটা বেড়েছে । এতো করে বলি খোলা জানালার কাছে বোসো না তোমার ঠান্ডার ধাঁচ, কথাই শোনো না । কাশিটা বুকে বসে গেলে খুব ভালো লাগবে তাইনা ? ওঠো । এদিকটায় এসে বসো ।
একটা হাত ধরে থামালাম মিরাকে । কাছে টেনে এনে বললাম ,"তোমার হাতদুটো তো ভীষণ ঠান্ডা হয়ে আছে । কই, এখন তো আর আমার কাছে উষ্ণতা চাও না তুমি ? বলো তো মিরা, আমি কি আগের তুলনায় শীতল হয়ে পড়েছি ?"
চোখভরা অভিমান নিয়ে চাইলাম আমার মিরার দিকে । ঠিক অভিমান না । আমি জানি আমার এই ধরণের প্রশ্নে মিরা কষ্ট পায় । অসহায় বোধ করে । কখনো বোধহয় আমাকে লুকিয়ে চোখের কোল মুছে নিতেও দেরি হয়না । এবং তারপরই ওর দুকূল ছাপিয়ে আসা ভালোবাসা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় যেন তীব্র কোন আক্ষেপের প্রায়শ্চিত্তে । আমি আছড়ে পড়ি তীরে, পরমুহূর্তেই ভেসে যাই আবারো । মিরা আমাকে বলে, স্যাডিস্ট । কিন্তু তার বুকের ছোট্ট কুঠুরিতে যে অতলান্তিক সমুদ্রটি সে ধারণ করে আছে, সেই অথৈ সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে ভেসে বেড়াবার মতো পরম নির্ভরতা আমি যে আর কোথাও পাইনি ! আমি যে আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে সেই গভীরতায় ডুবে গেছি প্রতিদিন, একটু একটু করে ! এ আমি কেমন করে তাকে বুঝাবো ! এ ক্ষমতা স্রষ্টা যে আমাকে দেননি । তবে বুঝে নেয়ার ক্ষমতাটুকু কি স্রষ্টা দেননি তাকে !
-কেন এতো ভাবো আমাকে নিয়ে মিরা ? এখনো এতোকিছু কী করে খেয়াল রাখো ? শোনো ডাক্তার বলেছে এইটুকু কাশিতে কিছু হবেনা আমার । জানালার পাশে থাকতে ভালো লাগছে । থাকি কিছুক্ষণ ?
-ডাক্তার বলেছে না ? এমন কথা কোন ছাইপাশ ডাক্তার বলেছে শুনি ?
-শোনো তুমি আমার ডাক্তারকে একদম ছাইপাশ বলবে না কিন্তু !
- একশোবার বলবো । ছাইপাশ ডাক্তার তোমাকে ছাইপাশ বলেছে হু ।
-মোটেই না । আমার বউ পৃথিবীর সেরা ডাক্তার ।
-বউ কেন? তুমি তো তোমার ডাক্তারের কথা বলছো । যাও ডাক্তারের কাছেই যাও ।
-হু ডাক্তারের কাছেই তো আছি পুরোটা জীবন । দেখি তো ডাক্তার, এদিকে আসুন তো ! আপনার শীতল হাতদুটোর স্পর্শে উষ্ণ হই !
আমার মনে পড়ে, এমনই হিমহিম এক রাতে আমি মিরাকে বলেছিলাম - "কোন এক কনকনে শীতের সন্ধ্যায় তোমার সাথে এক চাদরের নীচে বসে ধোঁয়া ওঠা গুড়ের চা খেতে খেতে গল্প করতে চাওয়াটা ইদানিং এক বুক হাহাকারে রূপ নিয়েছে !" আমার সেই কথাটা ইথার তরঙ্গে কতটুকু অনুভূতি বয়ে নিয়ে গিয়েছিলো, কিংবা কতখানি আক্ষেপ মিরাকে ছুঁয়ে গিয়েছিলো আমি সে হিসেব রাখিনি ।
ঠিক যেমন আমি হিসেব রাখিনি এর ঠিক কতোদিন পর থেকে আমি আর মিরা একই চাদরের নীচে বসে প্রতিটি হিমরাত্রি থেকে কুয়াশামাখা ভোরের রূপান্তর দেখতে শুরু করেছি ।
মিরা এখন প্রতিটি সন্ধ্যায় আমার বুকে মাথা রেখে কুয়াশা দেখে । শীতবুড়ির সাথে গল্প করে পৌষের প্রহরগুলোয় । উত্তুরে কনকনে হাওয়া যখন আলতো করে ছুঁয়ে যায় চোখ,নাক,ঠোঁট, মিরা তখন আরেকটু সেঁধিয়ে যায় আমার বুকে । তখন আমার বুকের খাঁচার ভেতরে একজন মিরা, খাঁচার বাইরে একজন মিরা ।
আমি ঠিক জানি, আত্মার জগত থেকেই মিরা ঠিক এভাবেই মিশে আছে আমার সমগ্র সত্তায়, সমগ্র অস্তিত্বের প্রতিটি পলে ।
আমরা দুজন । আমি আদম । মিরা, আমার ঈভ ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:০৬