এক.
গল্পটা সত্যিকারের কোন রাজকন্যার গল্প নয়। নয় রাজপুত্রেরও। ঝাঁ চকচকে নতুন বিলাসী জীবনের গল্পও নয়। খুব চেনা একটা গল্প। দুটো নীলকন্ঠী পাখির গল্প। একটা লাল রঙে ছেয়ে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া গাছের গল্প। ভরদুপুরে ঝুমঝুম বৃষ্টি নামার গল্প। গল্পটা তোমার। গল্পটা আমার। গল্পটা আমাদের ।
দুই.
চৈত্রের উজ্জ্বল একটা দিনে তোমাকে প্রথম দেখি। চারপাশের বিচ্ছিন্ন কোলাহল এড়িয়ে স্নিগ্ধতা মাখা তোমার মুখটা দেখতে বেশ লাগছিলো। কিন্তু একরাশ ভয় আর জড়তা আমাকে তোমার সামনে যেতেই দিচ্ছিলো না !! তারপর যেই তুমি আমার দিকে চোখ তুলে তাকালে। ঠিক তখুনি কোথায় যেন একটা কোকিল তার মিহি সুরে গান গেয়ে উঠে। বে অফ বেঙ্গলে জন্ম নেয় দুটো নতুন ঢেউ। একটা নীল অপরাজিতা মাত্রই জীবনের সুর বুনতে শিখে যায় !! পৃথিবীটা এতো সুন্দর কেন বলতে পারো ?
আকাশটা গাঢ় নীল ছিল..একটু রোদ আর একটু ছায়ার মিশেল..আর তারমধ্যে আমার রাজপুত্র দাঁড়িয়ে- একাকী রাজকন্যাকে তার পরশপাথর ছুঁয়ে দিতে..সেদিন আমরা অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটলাম। তুমি হঠাত করেই বললে-"আমার খুব ইচ্ছে করে জানো?" আমি চোখ তুলে তাকালাম- তুমি কেমন স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে বললে-"তুমি আর আমি একটা রেললাইন ধরে হেঁটে যাবো-পাশে একটা নদী থাকবে স্বচ্ছ নীলাভ জলে ছায়া ফেলবে আকাশটা" । আমি হেসে ফেললাম "এই ইটকাঠের শহরে কোথায় পাবে এসব ?" তুমি আমার হাত ধরলে,বললে"আমার চোখের দিকে তাকাও" আমি পারছিলাম না - তাকালাম তোমার নাকের পেলব ডগায় কিন্তু তবুও তুমি বুঝে ফেললে-"উঁহু..ঠিকঠিক চোখে তাকাও" আমি তোমার চোখে চোখ রাখলাম সেই প্রথম!
একসেকেন্ড,দুইসেকেন্ড,পাঁচসেকেন্ড- আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম, ডুবে যেতে যেতে ভেসে উঠছিলাম । তুমি বলে চললে - "একটা আঁকাবাঁকা রেললাইন - কাছেই একটা শান্ত নদী - রুপোলি জল আর তীরঘেঁষে চিকচিক করছে রুপোলি বালি-দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ গাছের সারি- তাতে বড় বড় পাতার টোপর- তুমি আমার হাত ধরে হাঁটছো রেললাইনের উপর- উত্তাল হাওয়া তোমার উড়িয়ে নিচ্ছে - তুমি আর আমি হাঁটছি- হেঁটেই চলেছি"
আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমি আকুল হয়ে বললাম "আমি হাঁটবো- সেই রেললাইন ধরে-রুপোলি বালির উপর-টোপর পরা গাছের নিচে-আমায় নিয়ে যাবে ?" তুমি আমার হাত ধরে একটু হাসলে- একটুখানি স্পর্শ ! আমি নিমিষেই বুঝলাম- আমার এতদিনের অপেক্ষা, আমার রাজপুত্রের জন্য অপেক্ষা এবার ফুরোলো ।
কি ভীষণ স্বপ্ন দেখতে পারো তুমি ! টিএসসির ভেলপুরি থেকে পলাশীর চায়ের কাপ-প্রতিপলেই তোমার আর আমার স্বপ্নের রথ পাল্লা দিয়ে ছুটতেই থাকে-বিরামহীন। কিন্তু আমি যে অলক্ষুণে ! তাই ভীষণ ভয় হয়- তুমি থাকবে তো এমনি করে ! জীবনটা তো রূপকথা নয় বলো ! আমার অশ্রু গড়ায়। আর তুমি অপ্রস্তুত অনভ্যস্ত হাতে আমার চোখ মুছে দাও-" আচ্ছা পাগলি যাহোক, থাকবো বাবা, প্রমিজ !" তারপর আমার কানে কানে বলো " রাক্ষস খোক্কস যাই আসুক, আমার আছে জিয়নকাঠি,পরশপাথর ! ভুলে গেছো?"
আমি হেসে ফেলি। আর বুকের ভেতর ক্রমশ বাড়তে থাকা অতল জলের গভীরতা টের পাই! টলটলে স্বচ্ছ জলের গভীরতা !
তিন.
"আর কতক্ষণ ধরে তুমি ডায়েরিটা পড়বে বলো দেখি ?" রায়হান এসে বসেন মেঘলার সামনে রাখা বেতের চেয়ারটায়।
"প্রতিবারই তো নতুন মনে হয়। কি করবো ?" মেঘলা মৃদু হাসেন।
"অনেক দিন ছাদে যাওয়া হয়না। চলো আজ যাই"
"এই সময়ে ছাদে ! পাগল হলে ?"
"আহা চলোই না।প্রতিদিন কি যেতে চাই? অন্তত আজ তো ভিন্ন কিছু করতেই পারি ! "
রায়হান এবং মেঘলা যখন ছাদে উঠে এলেন তখন ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে আট । মেঘলাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ করেই কালো আকাশে ফুটে ওঠে শত শত বর্নিল আতশবাজির রেখা।
"তোমার জন্য... সারপ্রাইজ"
মেঘলা জলভরা চোখে তাকান-"এখনো এমন ছেলেমানুষি করা সাজে?"
রায়হান স্মিত হেসে জড়িয়ে নেন তাকে । আজ তাদের পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকী। একটু ছেলেমানুষি তো করাই যায় !
ছাদে দাঁড়িয়ে রায়হান এবং মেঘলা হারিয়ে যান এতোগুলো বছরের পুরনো সব স্মৃতির শহরে । আর আকাশ থেকে ঝরে পড়তে থাকে অজস্র আলোর ফুলঝুরি - ঠিক তাদের দুজনকে ঘিরে ...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৬:১৬