somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সামনে সুসং দুর্গাপুর , পেছনে এক কবি

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ ভোর ৪:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[ উত্সর্গ: সেই কবিকে, যাঁর প্রবল নিষেধ সত্বেও আমি সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে ছেলেবেলা খুঁজতে সুসং দুর্গাপুরে গিয়েছিলাম আমার বড়বেলায়।


অফিসের সোশ্যালে এবারের বিশেষ আকর্ষন গারো ছেলে-মেয়েদের নাচ-গান। শিল্পীদের আনতে অফিসের দুই মাইক্রোবাস যাচ্ছে। গারো! শব্দটা যেন ছলকে উঠলো বুকের ভেতর। গারো মানে গারো পাহাড়ের কোলে, সোমেশ্বরী নদীর তীরে এক শান্ত জনগোষ্ঠী। গারো মানে সুসং দুর্গাপুর। আমার শৈশব স্মৃতির শুরু যেখানে। সুসং দুর্গাপুর মানে বিশাল মাঠ, মাঠের ধারে আমাদের বাসা, আব্বার অফিস। সামনে প্রকান্ড শিলকড়ই গাছ। দুর্গাপুর মানে খাঁচা খুলে টিয়া পাখী ছেড়ে দেওয়া। 'যাহ্, উড়ে গ্যালো'! আর সেই যে গুইসাপটা আমাদের মুরগির ঘরে বসে ডিম খাচ্ছিলো..। দুর্গাপুর মানে পিঠের ঝুলিতে সন্তান এবং মাথায় জ্বালানী কাঠের বোঝা কিম্বা কলসি কাঁখে নিয়ে কর্মঠ গারো নারীর বাজারে আসা। টিলার উপরে মিশন হাসপাতাল। চাঁদনি রাতে মেঘালয়ের উজান থেকে পাহাড়ী ঢলে সোমেশ্বরীতে নেমে আসে মহাশোল মাছ-সর্বরোগের ধন্বন্তরী বলে যার কিংবদন্তী। বিজয়পুর পাহাড়ের গা ঘেঁষে গরুর গাড়ীতে ক'রে যাওয়া। পথে বুনো বরইগাছের গাছে অনেক লাল বরই ছিলো। সোমেশ্বরীর বাঁকে এখনো কি পাওয়া যায় সেই সব রং বেরং-এর নুড়ি পাথর? আম্মার কাছে শুনেছি, এই সুসং দুর্গাপুরেই আব্বাকে (না)পাক আর্মির লোকেরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো একাত্তরের কোন এক রাতে। তিন দিন তিন রাত পরে আব্বা নাকি ফিরেছিলেন শতছিন্ন জামাকাপড় আর শরীরে- মনে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে-নেহায়েত ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন (সে এক ভিন্ন সত্যি গল্প) । বড়বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে জেনেছি সুসং দুর্গাপুরের আরো কাহিণী। হাজং বিদ্রোহ, টংক আন্দোলন, মণি সিং-এর জন্মস্হান এই জনপদ। এখানে পাওয়া যায় চিনেমাটি (চায়না ক্লে)। আহা! এতোদিন পরে যখন সুযোগ এলোই, মন চাইলো শৈশবের জায়গা ফিরে দেখতে।

মাঝে অনেক বছর চলে গেছে। আব্বা এর পরে আরও কত যায়গায় কর্মসুত্রে বদলী হয়েছেন, সাথে আমরাও। দুর্গাপুরে আর কখনো ফেরা হয়নি। আজ সুযোগ এসেছে যখন , আমি যাবো। ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব ক্যান্টিনে চা-বিরতি সেরে মাইক্রোবাসটা শহরের সীমানা পেরোতেই ধরতেই মনটা ধাঁই করে আবার ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গ্যালো। অতীত খননের উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপছি। বুঝতে পারছিলাম কিসের নেশায় পাঁড় প্রত্নতত্তবিদেরা নীলনদের অববাহিকায় পড়ে থাকে। ভবিষ্যতের মতো, অতীতেরও নিজস্ব মাদকতা আছে। যা হোক। যখন বিরিশিরি গারো উপজাতীয় সাংস্কৃতিক একাডেমী প্রাংগণে মাইক্রোবাস থামলো তখন সন্ধ্যা। কবি এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন। আমি জানালাম আমিও সাহিত্যমনা, কবির কিছু কবিতা আমিও পড়েছি।

কবি তখন সেই একাডেমীর পরিচালক পদে কর্মরত। ঢাকায় বউ-সংসার ফেলে এখানে জীবিকার টানে একাকী থাকতে হচ্ছে বলে স্পস্টত:ই কবির মন খারাপ। তো, পাঠক যখন একটা জুটেই গ্যাছে যে কিনা আবার সাহিত্যও ভালোবাসে, চলুক আড্ডা। কবি শ্রোতা পেয়ে কথক হয়ে ওঠেন। ক্যামন আছে এখন ঢাকা? যানেন, একটা সময়ে দেশ-বিদেশ থেকে আমার কাছে ফোন আসতো সাকুরায়? যুদ্ধ করেছি নিজের হাতে জানেন? বিয়ে করেছেন? করেন নি? হা-হা-হা, জীবনটাই বৃথা ভাই, আপনার। আমি দুই-দুইটা করে ফেল্লাম, আপনি একটাও করতে পারলেন না এখনো? এই দ্যাখেন, সুনীল গংগোপাধ্যায় আমাকে বই উত্সর্গ করেছে! আপনি সামশাদ বেগমের গান শুনেছেন কখনো? এইতো কিছুদিন আগে মারা গেলেন, কি গলা ছিলো রে ভাই! তো, আপনার এ্যাতো কষ্ট করে আসার দরকার ছিলো? শুধু মাইক্রোবাস পাঠালেই তো শিল্পীদেরকে নেয়া যেতো ঢাকায়। কি বল্লেন? শৈশব ফিরে দেখতে চান? আপনি ছোটবেলায় সুসং দুর্গাপুরে ছিলেন? ঐতো সামনে সোমেশ্বরী। শীতের শুকিয়ে যাওয়া এই একরত্তি নদী পরোলেই সুসং দুর্গাপুর। কালকে দেখে আসবেন। এই অহর্নিশ*, আমাদেরকে আরো চা-খাবার দিয়ে যাও, আমাকে আরো দু'টুকরা বরফ। এই অহর্নিশকে দিয়েই আনোয়ার ভাই-এর খোঁজও লাগানো হলো।

গল্পে গল্পে রাতের দ্বিতীয় প্রহর। আর আমি অপেক্ষা করছি কখন ভোর হবে, কখন আনোয়ার ভাই আসবে, কখন দুর্গাপুরের হ্রিদয় খুঁড়ে আমার শৈশব খুঁজে বের করবো। কবি বলেছেন, সামনে সোমেশ্বরী নদী। নদী পেরোলেই সুসং দুর্গাপুর...

রাতের তৃতীয় প্রহরে কবি মত বদলালেন। আচ্ছা, আপনি আমার একটা কথা রাখবেন? আপনি কাল এখান থেকে, সোমেশ্বরীর এপার থেকেই ঢাকায় ফিরে যান। আপনি কি জানেন, শৈশবের মিষ্টি স্মৃতি কতো দামি একটা জিনিস? এটাকে যক্ষের ধনের মতো, সারা জীবন আগলে রাখতে হয়। আপনি কি জানেন, সুনীল গাংগুলী মাদারীপুর সার্কিট হাউস পর্যন্ত এসেও শেযমেষ শিবচরে না গিয়েই ঢাকা হয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলো? কেন ফিরে গিয়েছিলো জানতে চাইলে সুনীল ব্যাখ্যাটা কি দিয়েছিলো আমাকে শুনবেন? ও আমাকে বলেছিলো: 'দ্যাখো, শিবচর আমার কল্পনার নিঁখুত আনন্দের স্বপ্নপুরী। সেখানে কোন গ্লানি নেই, দু:খ নেই। সেই এল ডোরাডো থেকে আমি প্রাণ রস সংগ্রহ করি, বেঁচে থাকার ফুয়েল নেই। আমার শৈশবের প্রমত্ত আড়িয়াল খাঁ নদের স্রোতে আমি আমার ভালোবাসার ব্যাটারি রি-চার্জড্ করে নেই মনে মনে। তা থেকেই প্রেরণা পাই, লিখি গল্প-কবিতা-উপন্যাস। এখন মুহুর্তের আবেগে ভেসে বড়বেলায় শিবচরে গিয়ে যদি আমার ছেলেবেলার অমল ধবল শিবচরকে হারাই , তবে আমার কলম দিয়ে আর লেখা বেরুবে না-।' আপনি কেন সেই ভুলটাই করবেন? আপনার কল্পনায় যেই অমল ধবল শৈশব দুর্গাপুর হ'য়ে আছে এ্যাতোগুলো বছর ধরে, আজ বাস্তবের রুখু জমিতে দাঁড়িয়ে, প্রাপ্তবয়স্ক চোখে সেটাকে খুজতে গেলে কি সেটা চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে না? বরং, আমার কথা শুনুন, কাল সকালে আপনি এখান থেকেই ঢাকায় ফিরে যান। দয়া করে সোমেশ্বরী পেরিয়ে কাল সকালে সুসং দুর্গাপুরে যাবেন না। চোখভরা পানি নিয়ে কবি আমার হাত দুটো ধরে ভীষণ আবেগ দিয়ে অনুরোধ জানান। আমি ভেবে দেখবো বলে আমার জন্য নির্ধারিত ঘরে এসে একটু একলা হতে চাই।

রাতের চতুর্থ প্রহরে আমার মনে দোলাচল। লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ। সত্যি কাল রাত পোহালে সোমেশ্বরী পেরিয়ে দুর্গাপুরে যাবো-নাকি এখান থেকেই ফিরে যাবো? আমার শৈশব স্মৃতির সেই ছায়া ঢাকা, পাখীডাকা সুসং দুর্গাপুরকে বড়বেলার এই বিশ্লেষনী চোখের সামনে উদোম করে লাভ কি?
আচ্ছা, ক্ষতিই বা কি? এতোটা পথ এসেছি। শৈশবের স্মৃতিঘেরা জায়গাগুলো-আম্মার কাছে শোনা গল্পের মানুষগুলো না দেখেই ফিরে যাবো? আমার কল্পনার সুসং দুর্গাপুর না হয় হারালোই বাস্তবতার কশাঘাতে। আমি তো আর সুনীল গাংগুলীর মতো পেশাদার লেখক নই, যে কল্পনার শিবচর-সৌধ ভেংগে পড়লে, কলম থেকে ফিকশন বেরুনো থেমে গেলে রুটি-রুজিতে টান পড়ার সাথে সাথে বাংলা সাহিত্যেরও বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে! এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাকি রাত কেটে যায়। সকালে দরজায় টোকা পড়লে খুলে দেখি চাদর গায়ে এক মানুষ। আনোয়ার ভাই, অহর্নিশের কাছে আমার কথা শুনে এসেছেন। শুনেছি ইনি কিশোর বয়সে আমাদের বাসায় কাজ-কর্মে সাহায্য করার জন্য এসেছিলেন নানাবাড়ির এলাকা থেকে, পরে দুর্গাপুরের এক 'দুর্গতিনাশিণী'র প্রেমে পড়ে এখানেই থেকে যান।
" ও, তুমি এ্যাতো বড় হয়্যা গেছো? তোমাক কতো কোলেত্ কর‌্যা লিয়া বেড়াইছি হামি..চলো তোমাক লিয়্যা দুর্গাপুর যাই।" কবির ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকালাম। নিশ্চ্য় ঘুমাচ্ছেন এখনও। সুনসান মফস্বলী সকাল, দুরে গারো পাহাড়ের হাতছাণি। আমি আনোয়ার ভাই-কে নিয়ে বালিয়াড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শীর্ণা সোমেশ্বরীর পাড়ে এসে দাঁড়াই। গারো ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে পড়তে আসছে ভোরের স্কুলে। আমাদের সামনে তখন সুসং দুর্গাপুর। পেছনে চোখে কান্না নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা এক কবি। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো আমাদের সামনেই এক পিছন!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ ভোর ৬:৩০
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×