দু'দিন আগে একটা পোস্ট পড়লাম ব্লগে, ফেলনা জিনিষ থেকে কবিতা'। সেই পোস্ট নিয়ে আমার কোন বক্তব্য নাই। তার একটা কমেন্টে একজন লিখছিলেন, 'ভাল বলেছেন। তবে এটি মুক্তকছন্দের অন্তর্ভুক্ত। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে পারাটা একধরণের ক্রেডিট।' এইটা নিয়ে আমার কথা আছে। আই মিন আলাপ আছে।
আমাদের অনেকের মধ্যে এইধরণের ধারণা আছে। হয়ত যে বলছে তার কাছে এইটা সঠিক, তবে আমার কাছে এইটা ভ্রান্ত। ছন্দ একটা টুল। অনেকগুলো পোয়েটিক ডিকশনের একটা। ছন্দ নিয়ে এর আগে প্রচুর আলোচনা হইছে, এখনো কেউ সুযোগ পাইলে এই ব্যাপারে লম্বাচওড়া বক্তব্য পেশ করে দেয়। ছন্দ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। তবে এর সাথে আরো অনেক টুল আছে যেগুলো কবিতায় ছন্দের মতই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া কোন কিছু ছন্দের বাইরে না। সকল কিছুর নিজস্ব একটা ফ্লো আছে। সেইটাই তার ছন্দ। ২৯ আগস্ট ১৯৩৯ সালের শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত এক ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন— 'কাব্যভাষার একটা ওজন আছে, সংযম আছে; তাকেই বলে ছন্দ। যাহোক ছন্দ নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। আমার ব্যাপারে যদি জিজ্ঞেস করেন, তো এইটা সত্য আমি গদ্যছন্দে বেশি লিখছি। সব থেকে বেশি লিখছি প্রতিকবিতা। টানাগদ্যেও কিছু লিখছি। তবে প্রচলিত ছন্দে যে লিখিনি তা নয়, তবে কম। এই কম লেখার কারণ হল মূলত প্রয়োজনবোধ না করা।
কবিতায় ব্যবহৃত অপরাপর টুলগুলো নিয়ে ব্রিফলি আলাপ করার ইচ্ছা এই থেকেই। তার কারণে এই পোস্ট। এইটা ধারাবাহিকভাবে হইতে পারে। আবার নাও হইতে পারে। তবে আমার চালচরিত্র অবজার্ভ করলে যে কেউ প্রেডিক্ট করতে পারবে যে, এইটা আসলে দুই তিনিটা পর্বের পর বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকি এইটাই এর প্রথম ও শেষ পর্ব হইতে পারে। আশ্চর্য হবার কিছু নাই।
শুরুতে যেইটা নিয়ে আলাপ করার ইচ্ছা সেইটা হল প্যারাডক্স। র্যানডমলি নিছি। কোন কারণ নাই। প্যারাডক্স শব্দটা ল্যাটিন paradoxum থেকে উদ্ভূত। এর বাংলা কূটাভাস। এইটা দ্বারা প্রত্যাশিত এবং অধিষ্ঠিত কোন বিশ্বাস বা অর্থের বিপরীত ধারণাকে বোঝায়। স্পষ্টতরভাবে বললে, এইটা হল এমন এক বক্তব্য যা নিজের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। প্যারাডক্স সাধারণত দু’ধরণের হতে পারে। লিটারেরি প্যারাডক্স আর লজিকাল প্যারাডক্স। খুব প্রচলিত একটা উদাহরণ হল— ‘আমি মিথ্যে বলছি’- এইটা হল লজিক্যাল প্যারাডক্স। এর আরেকটা উদাহরণ— ‘আমি কেউ নই’। এরকম আরো একটা হল 'আমি কিছুই জানি না’— সক্রেটিসের উক্তি। তিনি বলছেন তিনি কিছুই জানেন না অথচ তিনি জানেন যে তিনি জানেন না। তাহলে এইটা তার বক্তব্যের সাথে কনফ্লিক্ট করে। এইসকলবক্তব্যই স্ববিরোধী। এই ধরণের বাক্যে পাঠক কন্ট্রাডিকশন ব্যতীত অন্যকিছু পায় না। এইটা আলোচ্য না। তবে পোয়েটিক ডিভাইস হিশেবে যে প্যারাডক্স ব্যবহৃত হয় সেইটা জানতে হলে লজিক্যাল প্যারাডক্স জানা জরুরি।
অন্যদিকে অস্কার ওয়াইল্ডের সেই বিখ্যাত লাইন আমাদের সবার জানা আছে— ‘Life is much too important to be taken seriously’, এইটা হল লিটারেরি প্যারাডক্স। এইটা পড়ে পাঠকের কন্ট্রাডিকটরি মনে হইতে পারে কারণ গুরুত্বপূর্ণ সকল কিছুকেই সিরিয়াসলি নে’য়ার একটা সাবলীল প্রবণতা আমাদের মধ্যে আছে। তবে আরও গভীরভাবে লাইনটারে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝবেন অস্কার মূলত বোঝাইতে চাইছেন, যে বিষয়াদি যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকে অধিক গুরুত্বের বিষয় হল, ওই বিষয়াদিরে কম গুরুত্বের সাথে নেওয়া।
আবার রালফ এলিসনের ‘ইনভিসিবল ম্যান’ এর সেই লাইনটা— ‘You will have freedom of action—and you will be under strict discipline to the committee’। যদিও আমার কাছে এই লাইনটারে একি সাথে স্যাটায়ারের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ মনে হইছে। এইখানে বিদ্রুপ প্রকাশ পাইছে। তবে সর্বাধিক যেইটা প্রকাশ পাইছে তা হল ‘সত্য’। স্বাধীনিতা একটা মিথ। এক সুনিয়ন্ত্রিত প্রসেস ফলো ক’রে আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ নিতে হয়। আমরা পরাধীন -এইটা মিথ্যা। আমরা স্বাধীন- এইটা সত্য নয়। এই যে সত্য আর মিথ্যার মধ্যবর্তী যে অবস্থান প্যারাডক্স ব্যতীত এত সাবলীলভাবে উপস্থাপন সম্ভব হয় না।
‘আমি নেই, আমার না থাকা আছে’— লাইনটায় কবি নিজের না থাকারে অস্বীকার করছেন। কত সহজ এই অস্বীকার। একজনের থাকা কিংবা না থাকার উপর অন্য কারো কাছে তার উপস্থিতি নির্ভর করে না। এইখানে কন্ট্রাডিকশনরে টপকায় গেছেন কবি। সত্য আর মিথ্যের মধ্যে একটা পাতলা সুতোর মত তিনি দাঁড়ায় আছেন। ফিজিক্যাল ব্যারিয়ার উতরে গেছেন। এইটা কেন করছেন? সোজাসাপটা বলেননি ক্যান? এইটা পাঠকরে মূলত অধিকমাত্রায় পাঠে ইনভলব করার একটা উপায়। চেনা পরিচিত আবহকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ করে দেওয়া। যেমন, ‘যে মানুষটার চোখ নেই; সেও অন্ধকার দেখতে পারে’— এইখানে অন্ধকার দেখতে পারা যতটা সত্য, তার দেখতে না পারাও ঠিক ততটাই সত্য। কিন্তু এই কন্ট্রাডিকশনের উর্ধ্বে যে সত্য, পাঠককে সেইখানে পৌঁছাতে হবে।
কবিতায় প্যারাডক্স একিসঙ্গে বৈপরীত্য এবং অনভিপ্রেত একটা অর্থ পাঠকের সামনে এনে দাঁড় করায়। প্যারাডক্স বৈপরীত্য, অস্বীকৃতি, দ্বিধা— এই সমস্ত কিছুকে অতিক্রম ক’রে যায়। প্যারাডক্স পাঠকরে পুনঃ পাঠে বাধ্য করে। সত্যের থেকে অধিক সত্যের খোঁজ দেয়। কোন অনভিপ্রেত বক্তব্যের অর্থহীনতারে দায়মুক্ত করে।
উল্লেখ্য, এইটা একপ্রকার আলাপ। কার সাথে? নিজের সাথে হয়তবা। আবার এমন যে কারো সাথেই না। হয়ত আপনাদের সাথে। এইটা তবুও কোনপ্রকার তাত্ত্বিক আলোচনা না, কারণ সেই প্রকার জ্ঞান আমার নাই। ভুলভ্রান্তি হলে ক্ষমার চোখে তাকাইতে হবে না, চোখে আঙুল দিয়ে ভুল ধরায় দিয়েন।
শুভ্র সরকার
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১১:৫১