তিনটা লেখা অর্ধেক লিখে এক যায়গায় এসে আটকে আছি। শেষটা কিভাবে করবো বুঝতে পারিনা তাই আর শেষ করা হয়ে উঠে না। নিজের ভেতরেও তাড়না বোধ করি কিছু লেখার। ব্লগে লেখক হয়ে কিছুটা একটিভ হওয়ার। সময় স্বল্পতায় তাও হয়ে উঠেনা। খারাপ লাগে নিজেরই। নিজেকে ব্লগার বলে দাবী করিনা কখনোই। লিখতে ভালবাসি বলে মাঝে মাঝে কিছু অর্থহীন কথা নিয়ে হাজির হই ব্লগে।
তবে আমার আজকের লেখা কিন্তু মোটেও অর্থহীন নয়। একটা কষ্ট একটা লজ্জা শেয়ার করতে এলাম আজ। প্রথম লজ্জা হল আমি এতো দেরী করে কেন বইটা পড়লাম আর পরের লজ্জাগুলো শেয়ার করছি পরবর্তীতে। বলছিলাম একটি বইয়ের কথা – নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা “আমি বীরাঙ্গনা বলছি”। সাতজন বীরাঙ্গনার ভাষ্য তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক কিছু ঘটনার বর্ণনা পড়তে পড়তে মাঝেই মাঝেই চোখ ভারি হয়ে উঠেছে, গলার কাছে দমবন্ধ অবস্থার অনুভূতি হয়েছে কয়েকবার। লেখক নিজেই লিখেছেন ভূমিকাতে। উনি লিখতে গিয়ে যেমন প্রচুর শারীরিক ও মানসিক চাপে পর্যুদস্ত হয়েছিলেন তেমন মানসিক চাপে পড়তে হয় পাঠককেও। একসাথে এতো মানসিক চাপ নিতে পারছিনা আমি তাই অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বইটি পড়ছি। এখনো একজন বীরাঙ্গনার কাহিনী পড়া বাকী আছে।
গতকাল পড়ছিলাম ফাতেমা নামের বীরাঙ্গনার কাহিনী। একটু ভাবুনতো আপনি প্রাণভয়ে পালাচ্ছেন শত্রুর ভয়ে, কোলে আপনার ছোট ভাই বা বোন। এক পর্যায়ে শত্রু আপনাকে ধরে ফেলে আপনার কোলে থাকা ছোট ভাইটিকে সজোরে ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে আর আপনাকে ধরে নিয়ে যায় আরও অতি মাত্রার নির্যাতনের জন্য। শিউরে উঠি আমি ফাতেমা নামক বীরাঙ্গনার জীবনের এই করুন অংশটুকু পড়ে –
“মিলিটারি আসছে। বিহারীরা শ্লোগান দিচ্ছে – নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর। সামনে যা পেলাম নিয়ে সবাই গ্রামমুখী হলাম। কিন্তু নাসির আলীর হাত থেকে মুক্তি পেলামনা আমি আর পোনা। পোনাকে নিয়ে আমি দৌড়চ্ছিলাম, তাই সবার পেছনে পড়েছিলাম। ধরে ফেললো আমাকে, আমার গায়ের জোরও কম না। ওর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছি দেখে হঠাৎ পোনাকে তুলে একটা আছাড় দিলো। ওর মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।"
এই অংশটা পড়ে ভাবছিলাম এটা কোন মানুষের কাজ হতে পারে? ফাতেমা নামের এই বীরাঙ্গনার জীবনের পরের কাহিনী গুলো আরও কষ্ট দায়ক। তবে ওনার জীবনের একটা পর্যায়ে এসে উনি স্বামী সন্তান নিয়ে সুন্দর একটা সংসার পেয়েছেন। কিন্তু সব বীরাঙ্গনার জীবনের শেষটা কিন্তু এমন হয়নি। অনেকে স্বামী সংসার পেলেও দেশ ছেড়ে চলে যেতে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন আমাদের তথাকথিত সমাজের রক্ষণশীল মনোভাবের জন্য।
যেমন দুর্ভাগ্যের স্বীকার হয়েছিলেন তারা ব্যানারজি যাকে নিজের নাম পরিচয় বিসর্জন দিয়ে শেষ পর্যন্ত মিসেস টি. নিয়েলসেন হয়ে বাঁচতে হয়। তারাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরের ঘটনা এরকম –
“প্রথম আমার উপর পাশবিক নির্যাতন করে একজন বাঙালি। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। অসুস্থ দেহ, দুর্বল যুদ্ধ করতে পারলাম না। লালাসিক্ত পশুর শিকার হলাম। ঐ রাতে কতজন আমার উপর অত্যাচার করেছিলো বলতে পারবোনা, তবে ছ’সাত জনের মত হবে। ”
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি এমন সব ঘটনা পড়ে। কোন কিছু চিন্তা করার বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলি যেন কিছুক্ষণের জন্য। নিজের সর্বস্ব হারানো এই মানুষগুলো দেশের মাটিতে জায়গা পর্যন্ত পাননি কেউ কেউ। আমার শুধু পড়েই এই অবস্থা। যারা এসব ঘটনার স্বীকার তাদের অবস্থা আমরা হয়তো অনুমানও করতে পারবোনা। দেশ একসময় স্বাধীন হয়েছে ঠিকই এই বীরাঙ্গনারা তাদের প্রাপ্য সম্মান পায়নি বরঞ্চ সমাজ ও পরিবারের কাছে নিগৃহীত হয়েছে বারবার। যেমনভাবে তারা অপেক্ষায় ছিলেন তার বাবা এসে তাকে নিয়ে যাবেন কিন্তু তার বাবা তাকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এই অজুহাতে যে ওনার বড় মেয়ে জামাই নিয়ে বেড়াতে এসেছে। ওরা গেলে তারপর উনি তারাকে বাড়ীতে নিতে আসবেন। তারার ভাই একধাপ এগিয়ে তারাকে নিষেধ করে যান যেন সে হুট করে বাড়ীতে গিয়ে না উঠে। নিজের সম্ভ্রম হারানো এই মানুষগুলো যখন তাদের শেষ ভরসা পরিবারের আশ্রয় টুকুও হারায় তাদের জীবনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা কি থাকে আমার মাথায় আসেনা। আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে এই অসিম সাহসী মহিলারা যার যার অবস্থানেই ঘুরে দাঁড়ায়। নতুন ভাবে বেঁচে থাকার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা এই যুদ্ধে সফল হয়। তারার জীবনের সফলতার কাহিনী জানতে হলেও বইটি পড়ুন।
এভাবে একে একে বলা হয়েছে মেহেরজানের জীবনের দুর্ভাগ্যের কাহিনী, যিনি সমাজ ও পরিবারের অবহেলার কথা ভেবে অসম্মানের ভয়ে এক পাকিস্তানি পাঠানকে বিয়ে করতে বাধ্য হন এবং তার সাথে দেশ ছেড়ে চলে যান।
আরো আছে রীনার জীবনের গল্প, শেফা নামের উচ্ছল মেয়েটির গল্প, ময়না নামের অদম্য সাহসী নারীর গল্প। এক এক জন মহীয়সী নারীর গল্প পড়েছি আর আমার মনে হয়েছে (সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি) আমরা কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে অভিযোগ করি অনুযোগ করি। কত কিছু পেতে মন চায় আমাদের। সামান্য কিছু শাড়ি গয়না না পেলে আমাদের মন খারাপ হয় কষ্ট পাই। এই মহীয়সী নারীরা বছরের পর বছর কি অসাধারণ মনোবল নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কারো কারো জীবনের এতটুকু আক্ষেপ ছিল যে তারা তাদের জীবনে নতুন প্রজন্ম বা কারো কাছ থেকে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। আমার এখন খুব ইচ্ছে হয় জীবনে কখনো কোনভাবে যদি এমন একজন বীরাঙ্গনার সাথে দেখা হয় আমার আমি তাকে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে আসবো। জানিনা আমার সে সৌভাগ্য হবে কিনা।
শেষ কথা – প্রতিটি বাঙ্গালীর এই বইটি পড়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়েছে। শ্রদ্ধা জানাই আমাদের সেই বীরাঙ্গনাদের প্রতি।
ডাউনলোড লিঙ্ক
এই বইটি নিয়ে লেখা আরেকজন ব্লগারের একটা পোস্ট খুঁজে পেলাম - Click This Link
সংযুক্তি - বীরাঙ্গনাদের নিয়ে ব্লগার প্রবাসী পাঠক ভাইয়ার পোস্ট - বীরাঙ্গনা - এক অবহেলিত - অনুচ্চারিত ইতিহাস।
ব্লগার রেজোয়ানা আপুর পোস্ট - "বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধ শিশু" এবং এক অসহায় অনুচ্চারিত ইতিহাস....সময় হবে কি দেখার?