ইউক্রেইনের সাথে যুদ্ধের প্রধান কারণ ন্যাটো। ন্যাটো (নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অরগাইজেশন) গঠন করা হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। এটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিরুদ্ধের একটি সামারিক জোট। এর উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে এর প্রথম মহাসচিব লর্ড ইসমে বলেছিলেন, “এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো বিশ্বকে রাশিয়া থেকে দূরে রাখা, আমেরিকার নিকটে আনা এবং জার্মানদের দমিয়ে রাখা।”
প্রতিষ্ঠাকালে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১২। এখন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হবার পরই অধিক সংখ্যক দেশকে এর সদস্য করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এমনকি তাদের সামরিক জোট ওয়ারসের বিলুপ্তির পরও কি ন্যাটোর আর প্রয়োজন ছিল? পোল্যান্ডের ওয়ারশ-এ বসে রাশিয়ার নেতৃত্বে যে সামরিক জোট ওয়ারশ (ওয়ারপ্যাক) করা হয়েছিল সেই পোল্যান্ডই এখন ন্যাটোর সদস্য। শুধু পোল্যান্ড নয় পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশই এর সদস্য।
ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ থেমে থাকেনি। সোভিয়েত রাশিয়ার ভূত তাদের মাথা থেকে যায়নি, পুঁজিবাদী পথে হাঁটলেও। তাদেরকে সামরিক নিশানায় রাখতে দরজায় চলে আসার উপক্রম ন্যাটোর নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্রের। তখন নিশ্চয়ই রাশিয়ার চুপ করে থাকার কথা নয়। যে কোনও ক্ষমতাধর পরাশক্তিই তা করবে না, তাই না?
১৯৬০ সালে কেনেডি ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে হত্যা ও কিউবার ক্ষমতা দখল করতে সেখানে ‘বে অব বিগস’ নামে একটা সশস্ত্র দল পাঠিয়েছিলেন। তারা সফল হয়নি। ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে হত্যা ও কিউবার পতন ঘটাতে আমেরিকা অনেক বার চেষ্টা করেছে। যা আজ গোপন নয়। কিউবা থেকে আমেরিকার দূরত্ব ৯০ মাইল। কিউবা সে সময় তাদের নিরাপত্তার জন্য সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরির অনুরোধ করেন।
১৯৬২ সালে সোভিয়েত শাসক নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিউবার অনুরোধে সেখানে একটি সামারিক ঘাঁটি গড়ার ঘোষণা দেন। রাশিয়ার এ সিদ্ধান্ত শোনার পর তখন মার্কিন শাসক কেনেডি বলেছিলেন সেটা করা হলে, তিনি মস্কোতে মিসাইল হামলা করে গুড়িয়ে দেবেন। পরে রাশিয়া সেখান থেকে পিছিয়ে আসে। কিন্তু ১৯৬২ আর ২০২২ সালের বাস্তবতা এক নয়।
ইউক্রেইন এতটা বেপরোয়া হতো না, তাদেরকে নিয়ে তোপের মুখে ফেলেছে মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি। এ জন্য তারা বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, সে তথ্য কংগ্রেসে প্রকাশিত। ‘নীল চোখ, ব্লন্ড হেয়ার, সাদা চামড়া, ইউক্রেনিয় ও ইউরোপিয় যারা নয়, তাদের সাথে চলে না’- এরা এমন শ্বেতাঙ্গবাদ ঢুকিয়ে, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও ক্যুর মাধ্যমে শাসকের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কারণ পূর্বের শাসক মার্কিনিদের ফাঁদে ও ফর্মুলায় পা দেয়নি।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দুনিয়াতে যত যুদ্ধ, রক্তপাত, বর্বরতা ঘটেছে তার ৮১ ভাগই করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাকি ১৯ ভাগ করেছে অন্যান্য দেশ। বিগত ২০ বছরের হিসেব এর সাথে যুক্ত করলে তাদের বর্বরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পারদ উঠবে আরো উপরে। তারাই কিনা আজ চিৎকার করে রাশিয়ার আগ্রাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছে! এর চেয়ে প্রহসন আর কী হতে পারে?
রাশিয়া যদি ইউক্রেইন দখলই করবে, তাহলে ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা দিল কেন? ১৯২২ সালে ইউক্রেইনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে তারাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয়েছিল। রাশিয়া কোনভাবেই তাদের দখল করেনি, জোর করে ধরেও রাখেনি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে সব অঞ্চল দখল করার অভিযোগ করা হচ্ছে, আসলেই কি তারা সেগুলো দখল করেছে? না সেগুলো তদের অতীত ভূখণ্ডের অংশ ছিল? রাজনৈতিক কারণে ইতিহাস-ভূগোল ভিন্নভাবে আঁকা-লেখা হতে পারে কিন্তু তাতে সত্য ও ন্যায্যতার দাবি মিথ্যা হয়ে যায় না।
১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ক্রিমিয়া রাশিয়ার অংশ ছিল। নিকিতা ক্রুশ্চেভ যখন রাশিয়ার নেতা তখন সে ক্রিমিয়ার এ অংশকে ইউক্রেনকে সীমান্ত অঞ্চল হিসেবে তাদেরকে দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ভেঙ্গে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তা রাশিয়ার অংশ হবার কথা। ইউক্রেইনের সাথে রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে ২০১৪ সালে রাশিয়া সে তাদের অঞ্চলের দখল নিয়েছে। তারা ইউক্রেইনের কোন ভূখণ্ড দখল করেনি। কিন্তু পশ্চিমা ক্রমাগত এ নিয়ে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে।
ইউক্রেইনের ন্যাটোতে যোগ দিতে চাওয়ার কারণ কী? নিশ্চয়ই মার্কিনপক্ষকে খুশি করা। তাদের প্রতি অনুগত থাকা। কিন্তু এতে যে আরেক পরাশক্তি তার বৃহৎ প্রতিবেশী ক্ষিপ্ত হবে সেটা কি তাদের না বোঝার বিষয়? বৃহৎ ক্ষমতাধর প্রতিবেশীর সাথে রাজনৈতিক বোঝাপড়া না করে বৈরিতা নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা সহজ নয়।
রাশিয়া ইউক্রেইন আক্রমণ করেছে সেটা নিঃসন্দেহে অন্যায়। কিন্তু এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার নৈতিক অধিকার যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ-আমেরিকার নেই। কারণ তারা নিজেরাই রাশিয়ার চেয়ে অনেকগুণ বেশি এ অপরাধে অভিযুক্ত।
একটা গুলি খরচ না করেই শুধু যুদ্ধের গুটি চেলে, ব্রিটিশ-আমেরিকা কূটকৌশলে রাশিয়া ও ইউক্রেইনের মধ্যে এক ভয়ংকর ভাতৃঘাতি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলো। আর তাদের প্রপাগান্ডা মেশিন বিবিসি-সিএনএন-ফক্স-পোস্ট-টাইমস ক্রমাগত একতরফা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে।
মার্কিনের ইন্ধনেই ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ১৯৯০ সালে কুয়েত দখল করেছিল। কিন্তু তার পরিণতি কী হয়েছিল সেটাও সবার জানা। তাদের এই দ্বিমুখি নীতি ও কূটচালে অনেক সভ্যতা বিলীন হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে। মিথ্যাচার দিয়ে ২০০৩-এ ইরাক আক্রমণ করে ধ্বংস করে দিয়েছে। সাদ্দামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। একই কাজ লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ আরো অনেক দেশে করেছে।
মার্কিন চাপের মুখে ২০১০ সালে ইউক্রেইনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ বলেছিলেন, “ইউক্রেইন কখনো ন্যাটোতে যোগ দিবে না।’ সেই সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট মি. ওবামা তাদের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন, প্রলোভন দেখাতে থাকেন তাতেও কাজ হয় না। ইয়ানুকোভিচ জানতেন, ন্যাটোতে যোগ দিলে তাদেরকে রাশিয়ার তোপের মুখে পড়তে হবে।
মার্কিনিরা তখন সেখানে রেজিম চেঞ্জের কৌশল নেয়। ২০১৪ সালে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে রঙিন বিপ্লবের মাধ্যমে শাসকের পরিবর্তন ঘটান। তার ধারাবাহিকতায় ২০১৯-এ জেলেনস্কিও ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন ও তোড়জোর করতে থাকেন।
ন্যাটোর জন্মের কারণ আজ বিদ্যমান না থাকলেও মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি বিশ্বে তাদের একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে তাকে টিকিয়ে রেখেছে। শুধু টিকিয়েই রাখছে না চীন-রাশিয়াসহ সারা দুনিয়াকে হুমকি ও দুশ্চিন্তায় রাখতে তার সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের রাশিয়ার সাবেক মিত্রদেরও এক এক করে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ানো হয়েছে।
রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ইউক্রেইনের ওপর যখন মার্কিন পক্ষের হাত পড়েছে, তখন মার্কিন প্রতিপক্ষ ও পরাশক্তি হিসেবে নিশ্চয়ই তাদের চুপ করে থাকার কথা নয়। এমন ঘটনায় কি আমেরিকা চুপ থাকতো? কিউবার নিকট সোভিয়েত ঘাঁটির পরিকল্পনার সময় কি তারা চুপ ছিল? কেনেডির হুমকিতে ক্রুশ্চেভ সরে না আসলে হয়তো যুদ্ধের ইতিহাস হতো অন্যরকম।
ইউক্রেইন ন্যাটোতে যোগ দিলে আমেরিকা সেখানে তাদের সামরিক শক্তি সমাবেশ ঘটাতো। মিসাইল, নৌবহর, যুদ্ধবিমান, কামান, পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার দিকে তাক করে রাখতো। আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির সে উদ্দেশ্য কি নিরীহ কোন বিষয়?
মার্কিনিরা সেখানে সেবার উদ্দেশ্যে নয়, শক্তি প্রদর্শন ও সংহত করতে যেতে চায়। মধ্য আমেরিকার দেশে-দেশে তাদের অনুগত শাসকদের পতন হচ্ছে। সে অঞ্চলগুলো তাদের প্রভাব কর্তৃত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। তখন তাদের নজর পড়েছে সাবেক সোভিয়েত বলয় পূর্ব ইউরোপের দিকে। আর বিশ্বের শীর্ষ পরাশক্তি হিসেবে তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে হুমকিতে রেখে তাকে নিরবে মেনে নেবে, সেটা আশা করি কিভাবে?
ইউক্রেইনে আক্রমণের দিনই মার্কিন কংগ্রেস ম্যান তুলসি গ্যবার্ড তার টুইট বার্তায় বলেছেন, “এই যুদ্ধ-বিপর্যয় সহজেই এড়ানো যেতো, যদি বাইডেন প্রশাসন ও ন্যাটো রাশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে স্বীকার করতো। কারণ ইউক্রেইন ন্যাটের সদস্য হওয়া মানেই ন্যাটো রাশিয়ার সীমান্তে গিয়ে তাকে সর্বক্ষণ নজরে থাকবে।”
তুলসি গ্যবার্ড ফক্স টিভির এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “মার্কিনিদের এ যুদ্ধ আসলে একটা বাণিজ্য। এ যুদ্ধের ফলে তেল-গ্যাসের দাম বাড়বে, অস্ত্রের মজুত-চালান-বিক্রি বাড়বে তাতে ব্যবসায়ীদের লাভ হবে। এটা ছাড়া মার্কিনের বড়বড় অস্ত্র কারখানা ও তার ঠিকাদাররা মুনাফা করতে পারবেন না।’
এসব বাণিজ্যের সাথে যুক্ত আছে মার্কিনের বড়বড় সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা। মার্কিন যুদ্ধ বাণিজ্য বিষয়ক অনেক রিপোর্ট সে কথা প্রমাণ করে।
মঞ্জুরে খোদা-র লেখা থেকে।