পারিবারিক পরিচয়
১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিরাহীমপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মাহবুব আলী খান জন্মগ্রহণ করেন। মাহবুব আলী খানের বাবা প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান। যিনি ১৯০১ সালে ব্যারিস্টার হন। তিনি নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মাহবুব আলী খানের মা ছিলেন যুবাইদা খাতুন। দু’ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাহবুব আলী খান ছিলেন ছোট। সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার ৬৭ পুরানা পল্টন লাইনের বাড়িতে মাহবুব আলী খানের শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়। তিনি কলকাতা ও ঢাকাতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন কৃতী ছাত্র। তার কলেজ জীবনের শিক্ষা ঢাকা কলেজে।
পাকিস্তানে নৌবাহিনীর জীবন
মাহবুব আলী খান উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের ডার্টমাউথে রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন।
১৯৫২ সালে মাহবুব আলী খান ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীর নির্বাহী শাখায় যোগ দেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় সম্মিলিত বাহিনী স্কুল থেকে তিনি সম্মিলিত ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের ডার্টমাউথে রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর রণতরী ট্রায়ামপতে ১৯৫৪ সালে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। গ্রাজুয়েশন লাভের পর মাহবুব আলী খান ১৯৫৫ সালে, সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দু’কন্যা হয় - শাহিনা খান (বিন্দু) এবং জুবাইদা খান (বিনু)। ১৯৫৬ সালের ১ মে স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে কৃতী অফিসার হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক পুরস্কৃত হন। তিনি ১৯৬০ সালে পিএনএস (পাকিস্তান নেভী শীপ্) তুগ্রিলের গানারি অফিসার ছিলেন এবং ১৯৬৪ সালে পিএনএস টিপু সুলতানের টর্পেডো ও এন্টি সাবমেরিন অফিসার ছিলেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে জয়েন্ট চিফ সেক্রেটারিয়েট স্টাফ অফিসার (ট্রেনিং এবং মিলিটারি এসিস্ট্যান্স) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে পিএনএস হিমালয়ে টর্পেডো ও এন্টি সাবমেরিন স্কুলের অফিসার ইনচার্জ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে সিওয়ার্ড ডিফেন্স অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় (১৯৭১)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই মাহবুব আলী খান পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরিরত ছিলেন। তার স্ত্রী ও দু’কন্যাসহ মাহবুব আলী খান পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। যুদ্ধের সময় মাহবুব আলী খানের দেশপ্রেম উপলব্ধি করে পাকিস্তান বাহিনী পরিবারসহ তাকে গৃহবন্দি করে। দীর্ঘ ২ বছর বন্দিজীবন শেষে ১৯৭৩ সালে স্ত্রী ও দু’কন্যা বিন্দু ও বিনুসহ আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশে নৌবাহিনী জীবন
বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মাহবুব আলী খান চট্টগ্রামে মার্কেন্টাইল একাডেমীর প্রথম বাঙালি কমান্ড্যাট নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে নৌ-সদর দফতরে পার্সোনাল বিভাগের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি নৌবাহিনীর সহকারী স্টাফ প্রধান (অপারেশন ও পারসোনাল) নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভি কর্তৃক হস্তান্তরিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম ফ্রিগেট বিএনএস (বাংলাদেশ নেভী শীপ্) ওমর ফারুকের (প্রাক্তন এইচএমএস ন্যাভডকে) অধিনায়ক হন মাহবুব আলী খান। এ রণতরী গ্রহণের পর তিনি তা নিয়ে আলজেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, মিসর, সৌদি আরব এবং শ্রীলঙ্কার বন্দর গুলোয় শুভেচ্ছা সফরের পর দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর তিনি বাংলাদেশের নৌবাহিনী স্টাফ প্রধান নিযুক্ত হন এবং ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিয়ার অ্যাডমিরাল পদে উন্নীত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে বিশ্বমানের আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে মাহবুব আলী খান বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আইন তৈরি করেছেন। ১৯৮১ সালের ১১ মে ভারত সরকার তাদের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে পাঠিয়ে দ্বীপটিতে ভারতের পতাকা উত্তোলন করে। রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে ভারত সেখান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।এছাড়া বঙ্গোপসাগরে অনেক জলদস্যুর পতন এনেছেন মাহবুব আলী খান। মাহবুব আলী খান এছাড়া সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর বেতন ও পেনশন কমিটির চেয়ারম্যান, দেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জাতীয় বাস্তবায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশে উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তা ছিলেন।
রাজনীতিতে অংশগ্রহণ
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের পর জিয়াউর রহমানের সরকারের সময় নৌবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মাহবুব আলী খান তৎকালীন সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়া ‘জাগদল’-এর সদস্য ছিলেন। তিনি সরকারি চাকরিরত অবস্থায় জাগদল-এ দায়িত্বশীল পদে আসীন হননি। ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারি কালে অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সরকারের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
মাহবুব আলী খান রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সরকারের যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। এসময় তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবুজ ও কৃষি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে কাজ করেন। যোগাযোগ মন্ত্রী থাকায় তিনি দেশের রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেন। মাহবুব আলী খান গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, কৃষি বিপ্লব, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন।
রাজনীতিবিদের সঙ্গে সম্পর্ক
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিল মাহবুব আলী খানের ভালো সম্পর্ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় পাকিস্তানে গৃহবন্দি থেকে বাংলাদেশে ফেরার পর শেখ মুজিব তাকে নৌবাহিনী আধুনিক করতে বিশেষ দায়িত্ব দেন। জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে চাচাত ভাই হওয়ায় নৌবাহিনীর উন্নয়নে আরও বেশি কাজ করতে পেরেছেন মাহবুব আলী খান। জিয়াউর রহমানের বড় ভাই রেজাউর রহমান নৌবাহিনীতে মাহবুব আলী খানের সহকর্মী ছিলেন। সে সুবাদে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মাহবুব আলী খানেরও নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এর ফলে মাহবুব আলী খানের কনিষ্ঠ কন্যা জুবাইদা খান জিয়াউর রহমানের জেষ্ঠ্য পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
মৃত্যু
১৯৮৪ সালের ৬ আগস্ট সকালে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান ভূপাতিত হলে মাহবুব আলী খান সেই স্থান পরিদর্শনে যান। সে সময় তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে এ দেশপ্রেমিক মহান নায়কের জীবনাবসান হয়। তাকে ঢাকার বনানী অঞ্চলে দাফন করা হয়।
মাহবুব আলী খানের লাশ দেখে মনে হয়েছে এ মহান ব্যক্তির মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। পরে তার মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে একটি কমিটিও গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সে তদন্ত কমিটি আজও কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ১২:৫৭