ভারতে প্রচলিত ভাষাগুলি চারটি ভাষাবংশে ছড়ানো। সেগুলি হল - ১) অষ্ট্রিক ২) দ্রাবিড় ৩) ভোট চিনীয় বা সিনো টিবেটান ৪) ইন্দো ইউরোপীয়ান । এই ভাষাবংশগুলির মোট ভাষার সংখ্যা অবশ্য অসংখ্য, যার অধিকাংশই ভারতে প্রচলিত নয়।
১) অস্ট্রিক – অস্ট্রিক ভাষাবংশের ভাষাগুলি পৃথিবীর একটি বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রচলিত। এর বেশ কয়েকটি শাখা আছে। ভারতের আদিম অধিবাসী, যাদের আমরা আদিবাসী বলে জানি, তারা এরকম এক শাখার কয়েকটি ভাষায় কথা বলে। সাঁওতাল, মুণ্ডারী, হো, শবরদের ভাষা অস্ট্রিক ভাষাবংশের অন্তর্ভূক্ত।
অস্ট্রিক ভাষাবংশের প্রধান দুই শাখা হল অস্ট্রোনেশীয় (বা মালয়ী-পলিনেশীয়) এবং অস্ট্রো এশিয়াটিক। অস্ট্রোনেশীয় (বা মালয়ী পলিনেশীয়) শাখাটির ভাষাগুলির মধ্যে আছে বহির্ভারতের কিছু ভাষা – ইন্দোনেশীয়, মেলানেশীয়, মাইক্রোনেশীয়, পলিনেশীয়। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় প্রচলিত মালয় ভাষা, জাভার ভাষা, তাইওয়ানের ফরমোসান ভাষাগুলি এর উদাহরণ। মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলি জুড়ে এই শাখার ভাষাগুলি ছড়িয়ে আছে। অস্ট্রো এশিয়াটিক শাখার মধ্যে আছে তিনটি উপশাখা। ১) মুণ্ডা/কোল শাখা ২) মোন খমের শাখা ৩) আন্নামী মু অঙ শাখা।
আন্নামী মু অঙ শাখার ভাষা ভারতে পাওয়া যায় না। মোন খমের শাখার ভাষাগুলির মধ্যে ভারতে মূলত দুটি ভাষা প্রচলিত - ১) খাসি - আসাম মেঘালয় অঞ্চলে প্রচলিত। খাসির একটি উপভাষা হল জৈন্তিয়া। এই খাসি ভাষা আগে বাংলা হরফে লেখা হত, এখন রোমান হরফে লেখা হয়। ২) নিকোবরী – আন্দামান নিকোবর এর নিকোবরী দ্বীপপুঞ্জে প্রচলিত।
মুণ্ডা বা কোল শাখার ভাষাগুলির মধ্যে আছে – ১) সাঁওতালী ২) মুণ্ডারী ৩) হো ৪) শবর ৫) ভূমিজ ৬) কোরা ৭) কোরকু ৮) আসুরী ৯) খাড়িয়া ১০) গদবা। মূলত ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে, ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে এদের বাস। মনে রাখার বিষয় হল আরেকটি পরিচিত আদিবাসী সম্প্রদায় ওঁরাওদের বাস এই অঞ্চলে হলেও তাদের ভাষা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর নয়, ভোট চিনীয় গোষ্ঠীর।
মোন খমের শাখার ভাষা আর মুণ্ডারী শাখার ভাষার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক আছে। গীয়ার্সন তাঁর লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া লেখার সময় এই বিতর্ক সামনে এনেছিলেন খাসী ভাষার আলোচনার সময়। খাসী ভাষা একটি মোন খমের শাখার ভাষা। এটি মূলত মেঘালয়ের শিলং ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এবং বাংলাদেশের সিলেট ও কাছাড় অঞ্চলে প্রচলিত। এর সাথে মুণ্ডা ভাষাগুলির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। যেমন মোন খমের ভাষাগুলি মূলত মনোসিলেবিক বা এক দল বিশিষ্ট। অন্যদিকে মুণ্ডারী ভাষাগুলি পলিসিলেবিক বা বহুদল বিশিষ্ট। আবার মুণ্ডা ভাষাগুলির বাক্যগঠনে অন্বয় বা সিনট্যাক্স হল কর্তা - কর্ম – ক্রিয়া (বাংলার মতো, আমি বাড়ি যাই)। অন্যদিকে মোন খামের ভাষাগুলির বাক্যগঠনে অন্বয় বা সিনট্যাক্স হল কর্তা - ক্রিয়া - কর্ম (ইংরাজীর মতো, আই গো হোম)।
দ্রাবিড় – দ্রাবিড় ভাষাবংশের প্রধান চারটি ভাষা তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালয়লম ছাড়াও দ্রাবিড় ভাষাবংশের আরো অনেকগুলি ভাষা ভারতে প্রচলিত। দ্রাবিড় ভাষাবংশের ব্রাহুলি ভাষাটি ভারতের বর্তমান সীমার বাইরে পাকিস্থান ও বালুচিস্তানে প্রায় ৪২ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা। ভারতে প্রচলিত অন্যান্য দ্রাবিড় ভাষাগুলি হল ১) টুলু (প্রায় ১০ লক্ষ) ২) কোদাগু ৩) টোডা ৪) কোটা ৫) কুরুখ বা ওঁরাও (প্রায় ১২ লক্ষ) ৬) মাল্টো ৭) গোন্ডি (প্রায় ১৫ লক্ষ) ৮) কুই (প্রায় ৬ লক্ষ) ইত্যাদি। ছত্তিশগড়ের যে এলাকা মাওবাদীদের শক্তিশালী ঘাঁটি এবং যেখানে মাটির নীচের খনিজ সম্পদের জন্য নিরন্তর উচ্ছেদ চলছে, সেই আদিবাসীদের ভাষা গোণ্ডী দ্রাবিড় ভাষাবংশেরই একটি ভাষা।
সিনো টিবেটান বা ভোট চিনীয় –
সিনো টিবেটান ভাষাবংশের মূল দুটি শাখা। একটি তাই-চীনা এবং একটি ভোট-বর্মী। তাই–চীনা শাখার ভাষাগুলির মধ্যে আছে চীনা, তাই(শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ডের ভাষা) ইত্যাদি কিছু অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ ও জনবহুল বহির্ভারতীয় ভাষা। ভোট-বর্মী শাখার ভাষাগুলির মধ্যে আছে তিব্বতী, বিভিন্ন হিমালয়ী ভাষা, যেমন নেওয়ারী, লেপচা, কিরান্তী, ধিমাল এবং আসাম সহ উত্তর পূর্ব ভারত বা নেফা ভাষাগুলি, যার মধ্যে আছে – আকা, মিশমি, মিরি, বোড়ো, রাভা, কোচ, মেচ, গারো, টিপরা, কাবুইস, মিকি, নাগা (আও, ওঞামী, সেমা, তঙ্গখুল, লোথা, রেঙ্গমা), মণিপুরি বা মেইতেই, মিজো, আরাকানী।
পৃথিবীর প্রায় ৩০০০ ভাষাকে কয়েকটি ভাষাবংশে বিভক্ত করেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। ভাষাবংশগুলির মধ্যে আছে –
১) ইন্দো ইউরোপীয়ান
২) দ্রাবিড়
৩) অষ্ট্রিক
৪) ভোট চিনীয় বা সিনো টিবেটান
৫) সেমীয় হামীয়
৬) ফিন্নো উগ্রীয় বা উরালিয়
৭) আলতাইক
৮) জাপানী ও কোরিয়
৯) এস্কিমো
১০) ককেশীয়
১১) আইবেরীয় বাসক
১২) এশীয় বা প্রায় প্রাচ্য
১৩) প্রাচীন এশীয়
১৪) বুরুশাসকী
১৫) আন্দামানী
১৬) লাতি
১৭) মালয়ী পলিনেশীয়
১৮) পাপুয়ান
১৯) অস্ট্রেলিয়ান
২০) তাসমানীয়
২১) সুদানী গিনীয়
২২) বান্টু
২৩) হটেনটট বুশম্যান
২৪) উত্তর আমেরিকি
২৫) মধ্য আমেরিকি বা মেক্সীয়
২৬) দক্ষিণ আমেরিকি
ভারতীয় প্রেক্ষিতে প্রথম চারটি ভাষাবংশের গুরূত্ব বেশি। তবে পঞ্চম বা সেমীয় হামীয় শাখা বা সেমেটিক শাখাটির বিশেষ গুরূত্ব আছে, কারণ এর থেকেই এসেছে আরবী ভাষা, ইসলাম চর্চায় যা বিশেষ গুরূত্বপূর্ণ এবং এ চর্চা ভারতের এক ষষ্ঠাংশ মানুষের কাছেই শুধু পবিত্র ভাষা নয়, ভারতের ইতিহাস সংস্কৃতির অন্যতম স্তম্ভ।
ইনটারনেট