গত পহেলা জানুয়ারি একটা পুকুর ভিউ কফিশপে বসেছিলাম। কাছেই এক ভদ্রমহিলা ফোনে কথা বলছিলেন, কান পাততে না চাইলেও ভদ্রমহিলার কথাগুলো আপনা থেকেই আমার কানে চলে আসছিলো। যা বুঝলাম ভদ্রমহিলা একজন শিক্ষিকা এবং অপর প্রান্তে রয়েছে তাঁর এক ছাত্র যে কিনা থার্টি ফার্স্টের পার্টি করতে গিয়ে কোন অনলাইন ক্লাস বা এসাইনমেন্ট মিস করেছে। ভদ্রমহিলা তাঁর ছাত্রকে পাশ অথবা আরেকবার সুযোগ দিতে নাজার, এসব নিয়েই কথোপকথন। পুরো কথোপকথন হচ্ছিলো ইংরেজিতে। আমি যা বুঝলাম তা হলো ইংরেজি ভাষায় মধ্যে প্রচুর বাংলা শব্দ ঢুকে গেছে।
আজ সন্ধ্যার দিকে গিয়েছিলাম একটু ক্ষিলক্ষেত লেকসিটি কনকর্ডে। ফেরার সময় লেকসিটির একটু আগেই একটা ছোট রাস্তার পাশে দেখি কয়েকটি চিতই পিঠার দোকান, ভাবলাম সান্ধ্যকালীন খাবারটা এখানেই সেরে যাই। খেতে খেতেই দেখলাম আমাদের মতোই দেখতে কয়েকগ্রুপ ছেলেমেয়ে রাস্তাটা দিয়ে গেলো আসলো তারা সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ইংরেজিতে। কৌতুহলী হয়ে চিতই খালাকে জিজ্ঞাসা করলাম ঐদিকে কি কাশ্মীরী বা নেপালি স্টূডেন্টদের কোন হোস্টেল আছে বা বিদেশিরা থাকে এমন জায়গা আছে। খালা উত্তর দিলো, না। কেন জিজ্ঞাসা করেছি খালা সেটা বুঝতে পেরে আরো বলে, ওরা আমাদের মতোই এদেশীয়।
সিলেটের ডাউকি বর্ডার পার হলেই ওপারের সব খাসিয়ারা সবাই ইংরেজিতে কথা বলে এমনকি নিজেদের মধ্যেও। আপনি গেলে না চাইতেও কোন সুকন্ঠী গায়িকা আপনাকে দু'চারটি ইংরেজি গান শুনিয়ে দিতে পারে। সবার ঘরে বাইরে দোকানে অফিসে গাড়িতে ম্যানইউ চেলসি আর্সেনাল লিভারপুল ক্লাবের পতাকা সুভেনির জানান দিচ্ছে কে কোন দলের সাপোর্টার। নিজেদের ভাষার সাথে সাথে খাসিয়ারা তাদের নিজেদের সংস্কৃতিও প্রায় হারাতে বসেছে। আস্ত সুপারি দিয়ে পান খাওয়া ছাড়া তেমন কোন মৌলিক সংস্কৃতি খাসিয়াদের মধ্যে সেভাবে দেখা যায় না।
আমার বউ আমার বাচ্চাকে প্রমিত বাংলা শেখানোর চেষ্টা করছে খুব। আমি বলি দরকার কি! টাংগাইল গাজীপুরের টানে কথা বললে সমস্যা কোথায়, মাতৃভাষাই তো। তাছাড়া এখন আমরা যাকে প্রমিত বাংলা বলি এর আয়ু সম্ভবত এরইমধ্যে ফুরিয়ে এসেছে। কলিকাতা যখন বাংলা অঞ্চলের প্রধান শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো তখন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মিলনের আলাদা একটা ভাষা তৈরি হলো, চলিত ভাষায় সেখানেই গোড়াপত্তন যাকে বর্তমানে আমরা প্রমিত বাংলা বলেও চিনে থাকি। ঢাকা শহরেও বাংলার ব্যবহার ও উচ্চারণের আলাদা একটি ধরণ এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। মানি আর নাই মানি ভবিষ্যৎ বাংলার মূল স্রোত সম্ভবত এটাই। যদিও দু'একজন আপকামিং বুদ্ধিজীবী আলাদা ধরনের শব্দ ও উচ্চারণ ও বাক্য তৈরির চেষ্টা করছেন কিন্তু সেটা কোনভাবেই সাসটেইনেবল না। ভাষার গতি দু'চারজন বা দু'চারশ জনের উপর নির্ভর করে না। ভাষা লোকজ। বড়জোড় হিন্দি ভাষাতে ফার্সি অক্ষর জুড়ে দেয়া যায় শুধু!
ইচ্ছে ছিলো বা এখনও আছে আমার বাচ্চাকে বাংলা মধ্যমেই পড়াতে। কারণ বাংলা একটি পরিপূর্ণ ভাষা এবং মাতৃভাষা, অনুভূতি প্রকাশে মাতৃভাষার চাইতে ভালো কোন ভাষা হতেই পারেনা। তাছাড়া কাজ চালানোর জন্য কোন বিদেশি ভাষা শিখতে খুব বেশি সময়েরও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে এখনকার শিক্ষানীতি। এই শিক্ষানীতিটা দেখলেই এখানে এন্থনি গ্রামসির ছায় নয়, পুরো গ্রামসিকেই দেখতে পাই। গ্রামসির রাজনৈতিক দর্শন, সমাজ দর্শন, মুসোলিনীর ক্ষপড়ে পড়ে বেচারা জীবনটা জেলখানাতেই কাটিয়ে দিলো এর কারণে ব্যক্তি গ্রামসি ও তাঁর রাজনৈতিক এবং সমাজ দর্শনের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালোলাগা আছে। কিন্তু কি কারণে জানি একজন শিক্ষা দার্শনিক হিসেবে গ্রামসিকে আমার কোনভাবেই পছন্দ নয়। এখনকার শিক্ষানীতিটা যখন দেখি তখনই মনে হয় সেখান থেকে গ্রামসি ফিচকি হাসি দিয়ে আমাকে বলছে, দ্যাখ তুই আমার শিক্ষানীতি পছন্দ না করলে কি হইবো তোর বাচ্চার আমার দেখানো রাস্তাতেই পরাশুনা করতে হইবো। কেমন কেমন জানি লাগে!
যাইহোক, আমার নিজের ভাষা নিয়ে কোন ফ্যাসিনেশন নাই। ভাষা বহতা নদীর মতো, সময় ঠিক করবে তার গন্তব্য কোথায়। আমার সব ফ্যাসিনেশন সব আবেগ সব ভালোবাসা বর্ণমালাকে ঘিরে। একারণেই হয়তো নিজের পোস্ট বা বাংলা জানা কারো পোস্টের কমেন্টে ইংরেজি শব্দও লিখি বাংলা বর্ণমালা দিয়ে। বর্ণমালাই সার্বভৌমত্ব। বর্ণমালা সমৃদ্ধ জাতির উপর দীর্ঘমেয়াদী আগ্রাসন চালানো অত্যন্ত কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব।
দেশপ্রেম বোধ আমার আমার মধ্যে নেই। কেউ না মানলেও বা জায়গা দিতে না চাইলেও পুরো দুনিয়াটাকেই আমি আমার নিজের ঘরবাড়ি মনে করি। তারপরও আমার জাতিসত্তার যে জিনিষকে খুব গভীর থেকে অনুভব করতে পারি সেটি হলো আমার বর্ণমালা।
শামসুর রাহমান আমার বর্ণমালাকে 'দুঃখিনী' বলায় তাঁর উপর রাগটা আমার কোনদিন যাবে না!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ভোর ৪:১৩