বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলার সর্বদক্ষিণের উপজেলার নাম চরফ্যাশন। এই চরফ্যাশন উপজেলার একেবারে প্রান্ত সীমায় মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের সংযোগস্থলের ছোট্ট একটা দ্বীপের নাম ঢালচর। তিনদিক থেকে ভাঙ্গনের মুখে থাকা ছোট্ট এই দ্বীপটির জনবসতি প্রায় সম্পুর্ণই জেলে নির্ভর। নিসর্গ প্রেমিকদের কাছে এই দ্বীপের আরেকটি পরিচয় হলো কেওড়া বন ও তাড়ুয়া সমুদ্র সৈকতের মতো প্রাকৃতিক সৌন্ধর্য্যের লীলাভূমি এই ঢালচর।
প্রকৃতির এই সৌন্ধর্য্য উপভোগ করতে আমরাও কয়েকজন মিলে গিয়েছিলাম ঢালচর। প্রকৃতির কোলে রাত যাপন করে ফিরতি পথে ট্রলার ঘাটের এক রেস্তোরায় আমাদের কথা হলো ঢালচর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব আবুল কালাম পাটোয়ারীর সাথে তাঁর কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম স্থানীয় জেলেদের সমস্যা সম্ভাবনা ও চওয়া নিয়ে।
এবারের মৌসুমে কেমন মাছ পাচ্ছেন?
আলহামদুলিল্লাহ্ অন্যান্য বছরের চাইতে এবছর মাছ অনেক বেশি।
শোনা যায় স্থানীয় জেলেরা মাছের ন্যায্য দাম পায় না?
মাছ বিক্রির সাথে জেলেদের পাশাপাশি আরো অনেকে জড়িত। স্থানীয় জেলেদের মাছ যদি শুধু দেশের বাজারের চাহিদা মেটানোর কাজে ব্যবহৃত হয় তাহলে সেটা কারো জন্যই অতটা লাভজনক না।
তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন বিদেশে মাছ রপ্তানীর সুযোগ আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন?
জেলেদের ন্যায্য দাম দিতে হলে এর বিকল্প নাই। শুধু দেশের বাজারে আমাদের মাছ বিক্রি করে সেটা দিয়ে জেলেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব না।
বিদেশে মাছ রপ্তানির সুযোগ বেশি করলে দেশের বাজারে মাছ সংকট দেখা দিতে পারে?
না, যে পরিমাণ মাছ আহরিত হয় তাতে বিদেশে মাছ রপ্তানি আরো অনেক বাড়ালেও দেশের বাজারে মাছের কোন সংকট তৈরি হবে না।
এবার হয়তো মাছ বেশি ধরা পড়েছে বলে আপনি এটা বলছেন কিন্তু প্রতি বছর তো পর্যপ্ত মাছ আহরিত নাও হতে পারে?
মাছ ধরা না পড়লে রপ্তানি কতটুকু করা যাবে সেটা নাহয় পরে বিবেচনা করা গেলো কিন্তু যখন মাছ বেশি ধরা পড়ছে তখনও তো রপ্তানির সুযোগ সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না।
আপনি শুধু একটা সমস্যা চিহ্নিত করলেন। স্থানীয় জেলেদের মাছ ধরার পর্যাপ্ত উপকরণের সংকট কি নেই?
সেটা তো আছেই। সরকার থেকে জেলে প্রতি চাল দেয়া হয় ৩০ কেজি, জাল দেয়া হয় ২০ কেজি। তাও অল্প কিছু জেলেকে এটা দেয়া হয়। এটা দিয়ে তো একটা মাছ ধরার ট্রলার নামানো সম্ভব না। যার কারণে জেলেরা স্থানীয় মহাজনদের কাছে দাদনের স্মরণাপন্ন হয়। দেখা যায় একেকজন জেলের দাদন আছে চার লাখ পাঁচ লাখ।
তাতে তো বলা যায় জেলেরা মহাজনদের কাছে একপ্রকার জিম্মি?
বলা যায় আবার যায়ও না। একটা নৌকার পেছনে খরচ হয় ৫ লাখ ৭ লাখ টাকা, জাল লাগে ২০ থেকে ৩০ মণ। এখন তারা যদি দাদন না পায় তাহলে এ টাকা তারা সংগ্রহ করবে কোথা থেকে।
ঢালচরের জেলেদের কত শতাংশ সরকারী চাল আর জালের সুবিধা পায়?
এটা খুব বেশি না। এই ঢালচরে জেলে আছে ধরেন পাঁচ হাজারের মতো আর সরকারী চাল জাল এগুলো পাচ্ছে ৫০/১০০ জন।
জেলেদের দাদনের হাত থেকে বের করে আনা সম্ভব কীভাবে বলে মনে করেন?
জেলেদের নিজস্ব তো কোন টাকা পয়সা নাই। এখন সরকারীভাবে জেলেদের যদি মাছ ধরার উপকরণ দেয়া হয় তাহলে হতে পারে। কিন্তু এটাও তো অনেক টাকা সরকারে পক্ষে জেলে পিছু এত টাকা দেয়াও সম্ভব হবে কিনা!
এক কাজ করলে কেমন হয়। ধরেন ২০/৩০ জন জেলে নিয়ে সমবায় ভিত্তিতে জেলেদের মাছ ধরার পর্যাপ্ত জাল ও মাছ ধরার ট্রলার দিলে?
এটা হলে হতে পারে। তবে শুধু ট্রলার আর জাল দিলেই তো হবে না। তারা যে মাছ ধরে আনবে তাদের ন্যায্য দামটাও নিশ্চিত করতে হবে। যতদিন মাছের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা যাবে ততদিন কোনভাবেই জেলেদের ভাগ্যের উন্নয়ন করা সম্ভব না।
ঢালচরবাসী হিসেবে আপনাদের বর্তমান চাওয়া কি?
আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ঢালচরটা কীভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে। প্রতি বছর অনেক মানুষ ভিটেমাটি হারাচ্ছে। সরকার যদি কিছু ব্লক ফেলে ভাঙ্গনটা রোধ করার চেষ্টা করতো তাহলে আমাদের জন্য অনেক উপকার হতো। আর তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে যারা ভিটেমাটি হারাচ্ছে তাদেরকে নতুন জেগে উঠা চরগুলোতে বৈধভাবে বসবাসের অনুমোদন দিলেও আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে দিন যাপন করতে পারি।
ঢালচরের একটি বাজার
চলছে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা এই ফাঁকে জেলেরা ঠিক করে নিচ্ছে তাদের উপকরণ
ঢালচরের মেঠোপথ
কথা বলছেন সাবেক চেয়ারম্যান জনাব আবুল কালাম পাটোয়ারী (ছবি- জেরিফ)
নিসর্গ(ছবি- আমিনুর রহমান)
তাড়ুয়া সমুদ্র সৈকত
ভ্রমণ পিপাসুগণ প্রায়ই ছুটে যান দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে অনেক কারণেই মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোর নিয়মিত খবরাখবর নেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনা। তাই ট্রাভেলারগণ চাইলেই পারেন প্রকৃতির পাশাপাশি সেখানকার স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা চাওয়া পাওয়ার তথ্য তুলে আনতে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির এই মুক্ত গণমাধ্যমে এটি হয়ে উঠতে পারে নাগরিক সাংবাদিকতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত। যার মাধ্যমে বিকল্প গণমাধ্যমে উঠে আসবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষে জীবনযাত্রা, চাওয়া-পাওয়া ও সুখ-দুঃখের চিত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৪৮