১।
কিছুদিন ধরেই ছবিরুদ্দিন শাহ্ এর মন মেজাজ ভালো নেই। সবার ছোট ছেলে হওয়ার পরও ছবিরুদ্দিন শাহ্ এর বাবা ছিলছিলা ফুরফুরায়ে পীর ইশতিয়াক শাহ্ যখন তাকে পীরের উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষনা দিলো তখন নিজেকে সে বিশেষ একটা কিছু ভাবছিলো। কিন্তু বাবা ইশতিয়াক শাহ্ যে ভেতরে ভেতরে সব সম্পত্তি তার অন্য দুই ছেলের নামে লিখে দেয়ার পরিকল্পনা করছে ছবিরুদ্দিন সেটা ভাবতেই পারেনি। যখন জানলো ছবিরুদ্দিনের মাথায় তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এ ব্যাপারে সে তার বাবার সাথে কথাও বলেছে। বাবা বলেছে,
'তোরে তো আমার সবচাইতে বড় জিনিষটা দিয়া গেলামরে বাবা, এই দিয়া তুই অনেক উপরে উঠতে পারবি নাম যশ সম্পদ করতে পারবি। কিন্তু তোর বাকী দুই ভাইয়ের তো কিছু রইলোনা তাই ওদের বাদবাকী সব দিয়া যাই।'
ছবিরুদ্দিন এটা শুনে কিছু উত্তর করেনি। ইশতিয়াক শাহ্ অত্র অঞ্চলের একজন নামকরা পীর। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অত্র এলাকার চেয়ারম্যান মেম্বার সহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ইশতিয়াক শাহ্ এর শিষ্য। ছবিরুদ্দিন বুদ্ধিমান, সে জানে তার বাবাকে এভাবে বলে কোন কাজ হবেনা। তাছাড়া দিনকাল যা পড়েছে তাতে এখন আর পীরদের দিনও আগের মতো নাই। দিনদিন মানুষের মধ্যে থেকে বিশ্বাস ভক্তি এগুলো সব উঠে যাচ্ছে।
এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ছগির উঠে দাঁড়ালো। রশির আড় থেকে পরিষ্কার একটা গেরুয়া আলখাল্লা পড়ে নিলো। অল্প তুলোর মধ্যে জাফরানি আতর লাগিয়ে কাপড়ে গলায় নাকে লাগিয়ে তুলোটুকো কানের লতির ফাঁকে গুঁজে বেড়িয়ে পড়লো। গন্তব্য জগলু মাতবরের বাড়ী।
২।
সকাল গড়িয়ে গেছে। কুসুমের এই সময় কাজের ব্যস্ততা থাকে সবচাইতে বেশী। রান্নার আয়োজনের সাথে সাথে আরো আনুসাঙ্গিক অনেক কাজে হাত লাগাতে হয়। স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ার পর হতে কুসুম এই বাড়ীতেই আছে। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পরও অসুখে প্রায় ঘরে পড়া সাহেবান যখন কাজে খুঁত ধরে গালিগালাজ করে তখন মনেহয় যেদিকে দু'চোখ যায় সেদিকে চলে যেতে। যাওয়ার কোন জায়গা থাকলে হয়তো চলেও যেতো। বাপ মা মরা কুসুম বড় হয়েছে চাচার কাছে। চাচীর বেধড়ক মারধরের কথা কুসুমের এখনও মনে আছে। চাচা হয়তো এর থেকে বাচানোর জন্যই তড়িঘড়ি করে এক বিদেশীর সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু সুখ বেশীদিন কপালে সইলোনা, স্বামী তার নিরুদ্দেশ হলো। যে গ্রামে তার স্বামীর বাড়ী ছিলো সেখানে চাচা খোঁজ নিয়েও কাউকে পায়নি। কপাল পুড়েছে কুসুমের, চাচার ঘরেও আর জায়গা হয়নি। জোয়ান মেয়ে কুসুম, পেটের ক্ষুধা আর নিরাপত্তার কথা ভেবে তারপর থেকে জগলু মাতবরের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে। পেটের ক্ষুধা মিটলেও নিরাপত্তা যে এখানেও খুব একটা আছে তা না। জগলু মাতবর প্রায়ই বিভিন্ন উছিলায় কুসুবের শরীর স্পর্শ করতে চায়। কাপড় চোপড় একটু বেখায়াল হলেই জগলু মাতবর তার শরীরের ভাঁজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কুসুমের মনে হয় আধ বুড়াকে একটু খুলে দেখিয়ে দেয়ার। ঘরে অসুখে বউ সাধ তো তারও আছে। এভাবেই কুসুমের দিন কাটে। রাতে ঘুমুতে গিয়ে হারিয়ে যায় স্বামী সোহাগের সেই দিনগুলোর ভাবনায়। ভাবতে ভাবতে শরীরের শিহরণে বিছানার এপাশ ওপাশ হয় কিন্তু সারাদিনের কর্মক্লান্ত এই শরীরই তাকে শিহরণ থেকে উদ্ধার করে। ঘুমিয়ে যায় কুসুম, আরেকটি দিনের মৃত্যু ঘটে।
৩।
"চাচা বাড়ী আছুইন?", ছবিরুদ্দিন হাঁক ছাড়ে।
"কেডা? ছবিরুদ্দিন নাকি? আসো ভিতরে আসো"
"তা এই সাত সকালে আমার বাড়ীতে যে? সব ভালা তো?" জগলু মাতবর জিজ্ঞাসা করে। যদিও জগলু মাতবর বুঝতে পারে ইদানিং ছবিরুদ্দিনের এই বাড়ী ঘনঘন আসার কারণ কি।
ছবিরুদ্দিন বলে "সকাল কই চাচা, দুপুর তো হইয়া আসলো প্রায়।"
"তা বলো কি উদ্দেশ্যে আমার এইখানে আসলা?"
"চাচা, বাবায় জমিজমার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিছে জানেন কিছু?"
ছবিরুদ্দিনের প্রশ্ন শুনিয়া জগলু মাতবর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো, "দেখো ভাতিজা তুমি জানো তোমার পিতা ইশতিয়াক শাহ্ আমার পীর। উনার হেদায়েতের কল্যাণেই আইজ আমার মত পাপী বান্দা কাবা শরিফ আর মদিনাতুল মোবারক সাক্ষাত দেখতে পায়। ছিলছিলা ফুরফুরা তরিকার যে পথ সেই পথে তোমার পিতাজি তোমারে উত্তরসূরি নির্বাচন করছে তাই একজন পীরজাদা হিসাবে তোমার প্রতিও যথেষ্ট সম্মান আর দায়িত্ববোধ আমার আছে। বিষয় সম্পত্তির চাইতে অন্য একটা কারণে যে তুমি এইখানে আসছো সেই ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্যও আমার কাছে আছে। তোমার স্ত্রী পরোলোক গত হইছে তাও অনেকদিন হইলো। তোমার ব্যাপারটাও আমি বুঝি, কিন্তু তুমি যে কুসুমের দিকে নজর দিছো তোমার পীরান্তি আর ছিলছিলা ফুরফুরা তরিকার স্বার্থে সেইদিক থিকা তোমার নজর সরাইতে হইবো। এমনিতেই তোমারে আর কুসুমরে নিয়া চারদিকে কানাকানি শুনতে পাই।"
"তাইলে চাচা আমার আর কুসুমের একটা বন্দোবস্ত কইরা দেন তাইলেই তো ঝামেলা শেষ হইয়া যায়।"
"দেখো ছবিরুদ্দিন তোমার বোঝাপড়ার মধ্যে এখনও মেলা ঘাটতি আছে। তোমার আরো ধৈর্য্য ধরা লাগবো। তুমি জানো কুসুমের স্বামী নিরুদ্দেশ। কুসুম না বিধবা, না তালাকপ্রাপ্তা। তার পক্ষে তো দ্বিতীয় বিবাহের জায়েজ নাই। "
"চাচা আপনে গ্রামের মাতবর, আমার বাবার প্রধান শিষ্যদের একজন। আপনে একটা সিদ্ধান্ত দিলে সেই সিদ্ধান্ত নিয়া কেউ উচ্চবাচ্য করতে পারবোনা।"
"দেখো ভাতিজা, আমি চাইলেই তো একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারিনা। সবকিছুরই একটা নিয়ম নীতি আছে। আইচ্ছা যাও এখন দেখি কি করতে পারি।"
"আসি তাইলে চাচা।" ছবিরুদ্দিন বিদায় নিলো।
জগুলু মাতবর ইজি চেয়ারে আয়শ করে গা এলিয়ে দিয়ে হুঁকার নলে টান দিয়েই হাঁক ছাড়লো,
"কুসুম এই কুসুম, কল্কেতে আগুন ভইরা দিয়া যা তো"
কুসুম যখন কল্কেতে আগুন ধরিয়ে দিতে আসে সে মুহুর্তটা জগলু মাতবরের অবশ অবশ লাগে কেমন যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। কল্কেতে কয়লা রেখে উপুর হয়ে ফুঁ দিয়ে যখন আগুনটা তাতিয়ে দেয় তখন জগলু মাদবরের চারদিকটা ঘোলাটে হয়ে যায়। কুসুমের শরীরের ঘামের গন্ধ আর দেহের ভাঁজ তাকে মাতাল করে তোলে। কুসুম চলে গেলে হুঁকা টানতে টানতে জগলু মাতবর ভাবে, তারই বা কি দোষ, ঘরের বউ বারোমেসে রোগী। একটা তাগড়া জোয়ান মাইয়া যদি তার সামনে ভরা যৌবন নিয়ে দাঁড়ায় তারই বা সাধ্যি কি ঐসব চিন্তা থেকে দূরে থাকার। আর কুসুম মাইয়াডাও কেমন বেলাজ, একজন মুরুব্বী মাইনসের সামনেও তার শরীরটা ঠিকমতো ঢাকার প্রয়োজন মনে করেনা। আচ্ছা, কুসুম কি সত্যিই বেখেয়ালে অমন থাকে! আগের দিনের রাজা বাদশারা রক্ষিতা রাখতো, ভালো কইরা খোঁজ নিতে হইবো তো এই ব্যাপারে।
৪।
জগলু মাতবরের বাড়ী থেকে ফিরেই ছবিরুদ্দিনের মনটা ভীষণ অস্থির। একদিকে সম্পত্তি সব বাকী দুইভাই পাচ্ছে এটা মনে হলেই তার মাথায় খুন চেপে যায়। তার বাবা তাকে উত্তরাধিকার দিয়েছে ঠিকই কিন্তু যতদিন তার বাবার জীবিত আছে ততদিন সেটা কোন কাজে লাগছেনা। এতকিছুর পরও ছবিরুদ্দিনের মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো কুসুমের ব্যাপারে জগলু মাতবরের সহযোগীতা সে পাবে। কিন্তু আজকে জগলু মাতবরের সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছে জগলু মাতবরের মতলব ভালোনা। নিয়ম নীতি সে যেভাবেই বোঝাক তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। সে যাই হোক ফেরার পথে কুসুমকে সে মধ্যরাতে মাতবর বাড়ীর গোলাঘরের পেছনে দেখা করতে বলতে পেরেছে।
"কি কও, এত রাইতে তুমি আমারে এইখানে ডাকছো ক্যান!"
"বিয়া করবি আমারে?"
"এহ মর্দের তেজ দেখো, বিয়া করবো! কই আমারে বিয়া করলে তোমার পিরান্তি শ্যাষ এইটা জানোনা?"
"খেতাপুড়ি আমার পিরান্তির, তরে যেইডা জিগাইলাম সেইটার উত্তর দে।"
"হেই সুখ কি আমার কপালে আছে, স্বামীটা নিরুদ্দেশ হইলো। তারপর থিকা খালি দেখি হগগল মর্দরা আমারে চোখে গিলা খাইতেছে। তুমিও আলাদা না।" কুসুম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
"হ আমিও আলাদা না, আমিও তর এই শরীরডারে চাই খালি তর শরীরডারেই, আর কারুডা না।" একরাশ বন্যতা নিয়ে ছবিরুদ্দিন তার এক হাত দিয়ে চুলের মুঠি ধরে কুসুমকে কাছে টানতে থাকে। শক্ত হাতের টানে মৃদু প্রতিবাদ পরাস্ত হয়ে দুটি মুখে দূরত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ এক টর্চের আলো, আলো থেকে চোখ বাঁচিয়ে ছবিরুদ্দিন দেখে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে জগলু মাতবর। ভয়ে আশংকায় আতঙ্কে স্তম্ভিত কুসুম।
"আমি আগেই ধারণা করছিলাম তুই আসবি এই বেশ্যা হারামজাদির কাছে।"
"চাচা তুমি যাও এখান থিকা, মাথায় কইলাম খুনের নেশা চাপছে।"
"কি কইলি, পীরের পোলা বইলা তরে আমি মেলা সহ্য করছি, আর না।"
"শেষ বারের মতো কইতেছি চাচা তুমি যাও এখান থিকা।"
"যদি না যাই কি... ..." জগলু মাতবরের কথা শেষ হলোনা, তার আগেই প্রচন্ড ভারী কিছু একটা তার মাথায় আছড়ে পড়লো। কোনরূপ শব্দ ছাড়াই মাটিয়ে গড়িয়ে পড়লো সে। তারপর একেরপরে এক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো জগলু মাতবরের মুখ, কিন্তু জগলু মাতবর সেটা টের পেলো কিনা বোঝা গেলোনা।
ক্লান্ত ছবিরুদ্দিন জগলু মাতবরের বুক থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের আস্ত ইটটার দিকে এক পলক তাকিয়ে সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। কাঁপা কাঁপা রক্তাক্ত হাত দিয়ে কুসুমের হাত ধরলো।
"চল আমার সাথে কুসুম।"
"কই যামু।"
"যেইদিকে দুইচোখ যায়, যেইখানে তরে আমারে কেউ চিনেনা। শহরে যামু রিক্সা চালামু কুলিগিরি করুম। তুই ভাবিস না"
দ্রুত ছুটতে গিয়ে সহসাই খেই হারিয়ে কুসুমের পা মচকে গেলো। সেই মচকানো পা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলতে কুসুমের কষ্ট হচ্ছিলো। ছবিরুদ্দিন সহসা দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো, পায়ে ব্যাথা নাকি কুসুম?"
"হ, ব্যথা"
"পিঠে চাপামু"
"পারবি ক্যান?"
"পারুম, আয়।"
ছবিরুদ্দিনের গলা জড়িয়ে ধরে কুসুম তার পিঠের উপর ঝুলে রইলো। তার দেহের ভারে সামনে ঝুঁকে ছবিরুদ্দিন জোরে জোরে পথ চলতে লাগলো। পথে দুদিকে ধানের ক্ষেত আবছা আলোয় নিঃসাড়ে পড়ে আছে। দূরে গ্রামের গাছপালার পিছন হতে নবমীর চাঁদ আকাশে উঠে এসেছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে শান্ত স্তব্ধতা।
হয়তো ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হতে সংগ্রহ করে দেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে ছবিরুদ্দিন ও কুসুম পৃথিবীতে এসেছিলো এবং যে অন্ধকার তারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রেখে যাবে তা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তার নাগাল পায়নি, কোনদিন পাবেও না।*
* গল্পের শেষাংশটুকু মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প "প্রাগৈতিহাসিক" থেকে নেয়া এবং মাঈনউদ্দিন মইনুল ভাইয়ের পরামর্শে চলিত ভাষায় রূপান্তরিত।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১১:২৭