জনাব,
শুভেচ্ছা জানবেন। কিছুদিন পুর্বে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ওয়ার্ল্ড হিউম্যানিস্ট কংগ্রেসে যোগদান কালে আপনার সাথে কবি ও সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনের আলাপচারিতার একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রেক্ষিতে আপনার নিকট এই পত্র লেখা।
আপনি জানেন বন্যা খরা উপকূলীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর্সেনিক সহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত আপনার আমার এই বাংলাদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ১৬ কোটি জনসংখ্যার চাপ নিতে গেলে বিশ্বের যেকোন দেশ ভেঙ্গে পড়তো, কিন্তু আমরা পড়িনি। আপনি জানেন এদেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্মীয় উৎসবে (দুই ঈদ) বাড়ী ফেরার যে যাত্রা শুরু হয় আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন সে চাপ সামাল দিতে গেলে বিশ্বের যেকোন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তো, কিন্তু আমাদের দেশে অস্থায়ী জ্যাম তৈরী হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েনা। গ্রাম বাংলার সাধারণ খেটে খাওয়া একটি পরিবারের দৈনন্দিন কাজ যদি আপনি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন কি ভীষণ পরিশ্রমী এদেশের নারী পুরুষ। এদেশে তৃণমূল সমাজে প্রচলিত বিচ্ছেদ বাউল মুর্শিদ শুনে দেখুন, কতটা শক্তিশালী তাদের দর্শন। সাহিত্য সংস্কৃতি গল্প কবিতা নাচ গান দেখুন, সব মিলিয়ে আমাদের বাংলা একটি পরিপূর্ণ ভাষা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন দেখুন, প্রয়োজনে কৃষক শ্রমিক জনতা লাঙ্গল ফেলে হাতুড়ি ফেলে কলম ফেলে অস্ত্র হাতে হয়ে যায় একেকজন বীর যোদ্ধা। চলতি পথে বাসে ট্রেনে লঞ্চের ভীড়ে গাদাগাদি করে চলা মানুষদের দেখুন, কি ভীষণ সহনশীল এদেশের মানুষ। প্রায় ৮০০ বছর বয়সী বর্তমান বিশ্বে বিদ্যাশিক্ষার অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠানের একটি আয়োজনে এমন একটি জাতির প্রতিনিধিত্ব করায় আপনাকে অভিনন্দন।
বিপরীত চিত্রটা বলে আর পাতা ভারী করলাম না। যেহেতু আমরা অভাবী তাই মানিক বাবুর গল্পের চরিত্র পাঁচির মতো ক্ষত দেখিয়ে সাহায্য আনতে বা সহমর্মিতা পেতে বিপরীত চিত্রগুলোর গল্প হর হামেশাই বলতে হয়।
আপনাদের আলাপচারিতায় শ্রদ্ধেয় তসলিমা নাসরিনের একটি কথা মন ভরিয়ে দিয়েছে। এদেশ যেমন ধর্মীয় মৌলবাদী তৈরী করে তেমনই আসিফ মহিউদ্দিনদেরও তৈরী করে। এবং এই অঞ্চলের এই প্রগতিশীলতার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। হাজার হাজার বছর আগের নাস্তিক মতবাদের বৌদ্ধ দর্শনের জন্ম ও বিস্তার হিমালয়ের এই পাদদেশ। হাজার হাজার বছর পরেও যেই দর্শনের অনুসারী বিশ্বে শতকোটি। অথবা বর্তমান সময়ের প্রয়াত ডঃ আহমদ শরীফ যিনি তাঁর পারিপার্শিক বিশ্বাসের বিপরীতে স্বীয় বিশ্বাসে অটল থেকে নাস্তিকতা চর্চা গেছেন আপনা মনে। কিন্তু দেখুন সে সময় পর্যন্ত ধর্মীয় মৌলবাদীদের কটুক্তি ব্যতীত একটি ফেরারী জীবন বেছে নেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী হয়নি। যদিও বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। নাস্তিকতা বা ইসলাম বিরোধী প্রচারের জন্য আপনাকে প্রায় মৃত্যু থেকে বেঁচে আসতে হয়েছে। অন্যদিকে রাজীব হায়দার নামে একজনকে হতে হয়েছে নিহত। আপনি সহ আরো কয়েকজনের কারাবরণ করতে হয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানের পাশাপাশি হয়তো এখন সবারই ভুলত্রুটি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। কেননা আদর্শবাদের চাইতে আমাদের বড় বেশী প্রয়োজন নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত মানুষদের একটা সার্বিক ঐক্য। আর ছোট্ট স্থানে এত বেশী মানুষের সহাবস্থানের মধ্যে ঐক্য স্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা খুব স্বাভাবিক ভাবেই অত্যন্ত কঠিন। যার জন্য ধর্মীয় মানুষদের যেমন সহনশীল হতে হবে তেমনি হয়তো সহনশীল হতে হবে প্রগতিশীল মুক্তমনাদের।
কথাগুলো আপনাকেই বললাম কারণ ইসলামিস্টদের অনুভূতির অন্যতম স্থান কোরআনের উপর থেকে কফির মগ সরিয়ে ম্যাটের উপর যেখানে রেখে কফি পানের আরামপ্রদ স্থান সেখানে রেখেছেন এবং যা করেছেন প্রায় আধঘন্টা চলা ভিডিওর শুরুর ৫ মিনিটের মধ্যেই। এটাই বাঙ্গালীয়ানা, এটাই একজন প্রকৃত বাংলাভাষীর কাজ। সঠিক স্থানে সঠিক জিনিষ প্রয়োগের শিক্ষাটাই আমাদের শিক্ষা। তাঁর আদর্শ বিশ্বাস অনুভূতি হয়তো ভুল কিন্তু লালনের "মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি" শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাংলাভাষী হিসেবে শিখেছি মানুষকে শ্রদ্ধা করার। শিখেছি "মানুষ গুরু ক্ষ্যাপা হলে পথ হারাবি" তাই মানুষের অনুভূতি বিশ্বাস তা যত ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠীরই হোক তারা যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ খেয়াল রেখে নিজের আদর্শ প্রচার। রবিঠাকুরের "আনন্দলোকের মঙ্গলালয়কে বিরাজ সত্য সুন্দর" শিক্ষায় আমরা পেয়েছি সত্য সুন্দরের পথে যাত্রার প্রেরণা। "পিরিতি নগরে বসত করিয়া পিরিত বসন লবো" শ্রী চৈতন্যের শিক্ষায় আমরা জেনেছি ভালোবাসা দিয়ে নিজেকে আবৃত করা।
সংস্কৃতে একটি কথা আছে, সত্যম-শিবম-সুন্দরম। যাহা সত্য তাহাই শিব, যাহা শিব তাহাই সুন্দর, যাহা সুন্দর তাহাই সত্য। সনাতনী মতে যেখানে ঈশ্বরের আরেক নাম শিব। ঈশ্বর আছে কি নেই সেটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু সত্য বলা সুপথে চলার যে বাণী আমাদের আদি ভাষা, লালনের গান ইত্যাদিতে রয়েছে সেটা সেটা একজন খাঁটি বাংলাভাষী ধারণ করবেই। সত্য সুন্দরের আলোকে ভালোবাসার চাদর জড়িয়ে মানুষগুরুকে ভজন করাই আমাদের বাংলা সাহিত্য কবিতা সঙ্গীত এবং দর্শনের শিক্ষা।
পরিশেষে একটা ব্যক্তিগত মতামত জানাই। ধর্মের চাইতেও এদেশে অনেক বেশী জরুরী বোধহয় মোল্লাতন্ত্রের পতন। প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লাতন্ত্র, প্রগতিশীল মোল্লাতন্ত্র, রাবীন্দ্রিক মোল্লাতন্ত্র সহ সব ধরনের মোল্লাতন্ত্রের অবসান হোক। অধ্যাপক আবু সায়ীদ স্যারের ভাষায় যারা অদার্শনিক, অমননশীল একমাত্রিক মানুষ। বুদ্ধি ও চিন্তার সামনে হতবুদ্ধি হওয়া তেড়িয়া মানুষ। অকর্ষিত, কঠোর, ত্বকসর্বস্ব, জল্লাদ মানুষ। বোকা, অপ্রস্তুত, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন উপস্থিত মানুষ। অবিকশিত অসহায় করুণাযোগ্য মানুষ।
বিশ্বমানব হওয়ার পথ চলার আবারো শুভেচ্ছা রইলো। সত্য সুন্দরের আলোকিত শিক্ষায় শিক্ষিত যে বাংলাভাষী আপনার মাধ্যমে তার আলো পৌঁছে যাক বিশ্বদরবারে। প্রচারিত হোক বাঙ্গালীর গৌরবগাঁথা।
ইতি,
*কুনোব্যাঙ*
দ্রষ্টব্যঃ চিঠির ভাষাগত দুর্বলতা মার্জনীয়