তালেব মাস্টার
- আশরাফ সিদ্দিকী
তাল সোনাপুরের তালেব মাস্টার আমিঃ
আজ থেকে আরম্ভ করে চল্লিশ বছর দিবসযামী
যদিও করেছি লেন নয় শিক্ষার দেন
(মাফ করবেন ! নাম শুনেই চিনবেন)
এমন কথা কেমন করি বলি!
তবুও যখন ঝাড়তে বসি স্মৃতির থলি
মনে পড়ে অনেক কচি মুখ, চপল চোখঃ
শুনুনঃ গর্বের সাথে বলিঃ
তাদের ভেতর অনেকেই এখন বিখ্যাত লোক!
গ্রাম্য পাঠশালার দরিদ্র তালেব মাষ্টারকে
না চিনতে পারেন! কিন্তু তাদেরকে
নাম শুনেই জিনবেন!
(মুনাজাত করি! খোদা তাদের আরও বড় করেন।)
অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে আমার
পিঠ বেঁকে গিয়েছে আর
চোখেও ভাল দেখি না তেমন
তাই ভাবছিঃ সময় থাকতে থাকতে এখন
আত্মকাহিনীটা লিখে যাবো আমার!
রবিবাবু থেকে আরম্ভ করে আজকের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্রায়
আর কত সাহেব, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, রায়...
কত কাহিনীই আপনারা লিখে গেলেন।
কিন্তু মানিকবাবু! আপনি কি এমন একটি কাহিনী শুনেছেনঃ
কোথাও রোমাঞ্চ নেই! খাঁটি করুণ বাস্তবতা----
এবং এই বাংলাদেশেরই কথা!
নমস্কার।
আমিই সেই তালসোনাপুরের তালেব মাষ্টার!
আরম্ভটা শুধু সাধারণ। কারণ
রক্তস্নানে শুভ্র হয়ে সত্তর বছর পূর্বে যখন
প্রথম আলো দেখলাম, হাসলাম এবং বাড়লাম
তখন থেকেই ট্রাজিডি চলছে অবিরাম!
লেখাপড়ায় যদিও খুব ভাল ছাত্র ছিলাম
অষ্টম শ্রেণীতে উঠেই বন্ধ করে দিতে হল কারণ
পিতামাতার সংসারে নিদারুণ-অনটন!
জমিদার সাহেবের কৃপায় চাকুরি জুটে গেল একখানা
ডজন খানেক ছেলেমেয়ে পড়ানো; মাসিক বেতন
তিন টাকা আট আনা!
(তাদের মধ্যে একজন এখন ব্যারিস্টার!
জানি না তালেব মাষ্টারকে মনে আছে কিনা তার!)
পাঠশালা খুলেছে তারপর সুদীর্ঘ দিন ধরে বহু ঝঞ্ঝা ঝড়
বয়ে গেছে। ভলেছি
অক্লান্তভাবেই জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলেছি।
পানির মত বছর কেটে গেল
কত ছাত্র গেল, এল-
প্রমোশন পেল
কিন্তু দশ টাকার বেমী প্রমোশন হয়নি আমার!
কপালে করাঘাত করেছিলাম জীবনে প্রথম সেবার
যখন টাকার অভাবে একটি মাত্র ছেলের পড়া বন্ধ হল!
আক্রার বাজার। চাল-নুনেই কাবার!
কীই বা করার ছিল আমার!
ঘরে বৃদ্ধ মা-বাপ
পুরাতন জ্বরে ভুগে ভুগে তারাও যখন ছাড়ল শেষ হাঁফ
দুঃখ করে শুধু খোদাকে বলেছিলাম একবারঃ
এতো দরিদ্র এই তালেব মাষ্টার!
তবু ছাত্রদের বুঝাই প্রাণপণঃ
‘সকল ধনের সার বিদ্যা মহাধন’।
দেশে আসল কংগ্রেস, স্বদেশী আন্দোলন
মহাত্মার অনশন! দেশব্যাপী সে কী আলোড়ন
খিলাফতের ঝড় বইছে এলোমেলো
খড়ো ঘরে ছাত্র পড়াই আর ভাবিঃ এই সুদিন এল!
মন দিয়ে বুঝাই পলাশীর যুদ্ধ, জালিয়ানওয়ালার হত্যা
হজরত মোহাম্মদ, রাম-লক্ষণ আর বাদ্.সা সোলেমানের কথা
গুণ্ গুণ্ করে গান গাই ‘একবার বিদায় দাও
মাগো ঘুরে আসি
অভিরামের হয় দীপান্তর, ক্ষুদিরামের মাগো হয় ফাঁসি’!
আসল মোসলেম লীগ, কম্যুনিষ্ট বন্ধু
সকলের কথাই ভাল লগেঃ ভাবি এরাও বুঝে দেশের বন্ধু!
কোথায় শুনি ঝগড়া লেগেছে!
আগুন জ্বলেছে-জ্বলুক! ওরা
তবুত জেগেছে! ভায়ে ভায়ে ঝগড়া কদিন যাক!
নিভবেই! বলিঃ
লেজে যদি তোদের আগুন লেগেই থাকে তবে শত্রুর
স্বর্ণ-লঙ্কাই পোড়া।
ছেলেটি কাজ করে মহাজনী দোকানে
মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে! প্রাণে
তবুও বেঁচে আছি। আসল পঞ্চাশ সাল
ঘরে বাইরে হাটে-বাটে আকাল। ঘোর আকাল!
একশো টাকা চালের মণ পঞ্চাশ হায় পঞ্চাশ!
ঘরে বাইরে দিনের পর দিন উপাস হায় উপাস!
গ্রামের পর গ্রাম কাল-কলেরায় উজাড়!
নিরীহ তালেব মাষ্টারের বুকেও বজ্র পড়ল! কলেরায়
ছেলেটি মারা গেল বিনা পথ্যে বিনা শুশ্রুষায়!
কাফনের কাপড় জোটেনি তাই বিনা কাফনে
বাইশ বছরের বুকের মানিককে কবরে শুইয়ে দিয়েছি এখানে!
এই-ই শেষ নয়-- শুনুনঃ বলি
মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলাম পাশতলী
সেখানেও আকাল! মানুষে মানুষ খায়।
তিন দিনের উপবাসী আর লজ্জা বস্ত্রহীন হয়ে নিদারুন ব্যখায়
দড়ি কলসী বেঁধে পুকুরের জলে ডুবে মরেছিল একদিন সন্ধ্যায়
মানিকবাবু আমি জানিঃ প্রাণবান লেখনী আপনার
তালেব মাষ্টারের সাথে হয়ত আপনিও অশ্রু ফেলেছেন বেধনার
কিন্তু আশ্চর্য! আজও বেঁচে আছি আমি
এবং অক্লান্তভাবে দিবসযামী
তালসোনাপুরের প্রাইমারী পাঠশালায় বিলাই জ্ঞানালোকঃ
ছাত্রদের পড়াই ‘ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরে, বাঁধ বাঁধ বুক
যতদিকে দুঃখ আসুক আসুক.....’।
শুভাকাঙক্ষীরা সকলে আমায় বলে ‘বোকা মাষ্টার’
কারণ ঘরের খেয়ে যে বনের মোষ তাড়ায় তা ছাড়া
সে কি আর!
যুদ্ধ থেমে গেছে। আমরা তো স্বাধীন
কিন্তু তালেব মাষ্টারের তবু ফিরল না তো দিন!
স্ত্রী ছয় মাস অসুস্থা
আমারও সময় হয়ে এসেছেঃ এই তো শরীরের অবস্থা!
পাঁচ মাস হয়ে গেছে, শিক্ষাবোর্ডের বিল নাই
হয়ত এবারের টাকা আসতে আসতে শেষ হবে আয়ু! তাই
শতছিন্ন জামাটা কাঁধে ফেলে এখনো পাঠশালায় যাই
ক্ষীণ কন্ঠে পড়াইঃ
‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগোরে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে..’
মনে মনে বলিঃ
যদিই ফোটে একদিন আমার এই সব সূর্যমুখীর কলি।
ইতিহাস সবই লিখে রেখেছে। রাখবে---
কিন্তু এই তালেব মাষ্টারের কথা কি লেখা থাকবে?
আমি যেন সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা
আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে কিন্তু
নিজের জীবনই অন্ধকারমালা।
মানিকবাবু! অনেক বই পড়েছি আপনার
পদ্মানদীর মাঝির ব্যাথায় আমি কেঁদেছি বহু বার
খোদার কাছে মুনাজাত করিঃ তিনি আপনাকে
দীর্ঘজীবী করুন
আমার অনুরোধঃ আপনি আরও একটা বই লিখুন
আপনার সমস্ত দরদ দিয়ে তাকে তুলে ধরুন
আর, আমাকেই তার নায়ক করুন!
কোথাও রোমান্স নেই। খাঁটি করুণ-বাস্তবতা
এবং এই বাংলাদেশরেই কথা।
ঢাকা, মে ১৫ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- পুলিশের লাঠিপেটায় আহত এক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে শাহবাগে লাঠিপেটায় আহত আজিজুর রহমান (৬০) রাতে তার বাড়ি ফেরার পথে মারা যান বলে শিক্ষক নেতারা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে চাকরি সরকারি করার দাবির আন্দোলনে সোমবার থেকে শরিক ছিলেন আজিজুর।
মঙ্গলবার দুপুরে শাহবাগে পুলিশি লাঠিপেটার শিকার হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হন জামালপুরের মাদারগঞ্জের চর ভাটিয়ানি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজুর।
পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিক চিকিৎসায় কিছুটা সেরে ওঠার পর তিনি বাড়ি রওনা হয়েছিলেন। পথে তার মৃত্যু হয়।”
আজিজুর একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে জানান তিনি।
সন্ধ্যায় শহীদ মিনারে শিক্ষকদের অস্থায়ী মঞ্চ থেকে জানানো হয়, দুপুরে আজিজুরের বাড়ি মাদারগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।
আজিজুর রহমানের স্ত্রী হাজেরা খাতুন বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন।
চর ভাটিয়ান রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামাল হোসেন বলেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালে। আজিজুর রহমান প্রায় ১৮ বছর ধরে সেখানে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি মাদারগঞ্জ উপজেলা শাখার সহ-সভাপতিও ছিলেন তিনি।
আজিজুর রহমানের বাড়ি মেলান্দহের দক্ষিণ ঘোষেরপাড়া গ্রামে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তিনি পাশের মাদারগঞ্জ উপজেলার রায়গঞ্জ বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার স্ত্রী হাজেরা খাতুন মাদারগঞ্জের পশ্চিম পলিশা রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।