★*★*★*★
রিক্সার পেছনে ঝুলে ঝুলে, ছেলেবেলায় যে বস্তির বাজারে বিশেষ ধরণের লম্বা আল ওয়ালা লাটিম কিনতে যেত, সে জায়গাটায় এখন বিশাল শপিং মল হয়েছে। আজ বছরগুলি গত হবার সমৃদ্ধ ইতিহাসকে বেশ ভারী মনে হয় শিহাবের। আটাশ বছর পার হয়েছে না? শেষ এই শহর ছাড়ার দিন থেকে আজ ফিরে আসা পর্যন্ত, কম-বেশী তা হয়েছে বৈকি।
ফিরে আসা.. শব্দটা কোথায় যেন টান দেয়। জ্বালা ধরায়। পোড়ায়। ফিরে আসার আগে চলে যাওয়া শব্দটির চিরে দেওয়া অনুভবেও কখনো কখনো সিক্ত হতে হয়। সব চলে যাওয়া- ই তো আর ফিরে আসার জন্য নয়। তাই কারো জীবন থেকে বিশেষ কেউ'র চলে যাওয়ায় প্রিয় শহর থেকে এক দীর্ঘমেয়াদী বিচ্ছেদ.. আশা নিরাশার বুকে বাসা বেধে অপেক্ষার প্রহর গুনেছে.. এভাবেই সময় পার হয়ে আজ এসেছে।
শপিং মলের কফি হাউসটা যেখানে, একসময় এখানে শীতের রাতে যাত্রার আয়োজন হত। মাফলার আর বিচিত্র রংগের মায়ের হাতে ঘরে বোনা কানটুপি পরা শিহাবের মত কলেজে উঠব উঠব, ছেলেদের অনেক ভীড় থাকত।
এস.এস.সি দিয়ে অলস সময়ের মজা নিচ্ছিল শিহাব। মিল অঞ্চল এদিকটা। শিল্পাঞ্চল বলে খ্যাত এ শহর। এমন এক যাত্রা দেখার রাতে চা খাবার সময়, সদ্য শেখা সিগ্রেট টানার বিদ্যে ঝালাইয়ের জন্য দূরের চা'র দোকানটা-ই সব সময় বেছে নিতো। প্রটেক্টর লাগানো সাদা-কালো রঙিন টিভিতে তখন সংশপ্তক ধারাবাহিক নাটক দেখাতো বিটিভি। কান কাটা রমজান খ্যাত হুমায়ুন ফরিদি, মিয়ার ব্যাটা খলিলুল্লাহ খান সহ সকলের প্রানবন্ত অভিনয় ঐ বয়সেই শিহাবের বেশ ভালো লাগত।
আর তখনকার সেনসেশন সুবর্ণা মোস্তফা! সকল বয়সী পুরুষের হৃদয়ে আবেদন তুলতে পারংগম ছিলেন।
সেদিন ও চা'র দোকানে সংশপ্তক চলছে। সুবর্ণা কে দেখে শিহাবের মনের গোপন কোনো কোনায় অন্য গোপন কেউ 'কিছু একটা' হয়ে উঠে। আজ বাসায় বলে এসেছে ফিরবে না। খালার বাসায় থাকবে।
কৈশোরের শেষ ধাপে পৌঁছে এক বালিকা সুবর্ণার রুপ ধরে ধরে কখন যেন বঁধু তে রুপ নিয়েছে। হৃদয়টা তাই বুঝি আজকাল বড্ড ভারী ভারী ঠেকে। অন্যের হৃদয় বহন করা ও তো বেশ হাল্কা কাজ নয়, তাই না?
বালিকা বঁধুর বৃত্তান্তে কাজ নেই। খুবই পরিচিত কাছের মানুষদের জগতের বিশেষ কেউ ছিল সে। হৃদয়কে হৃদয় বানিয়ে অনুভব করাটা শিহাবকে সে-ই শিখিয়েছিল।
শপিং মলের কফি হাউসে আজকের শিহাব শেষ চুমুক দিয়ে মগ রেখে দিতে দিতে সেদিনের সেই নাটক দেখা রাতে চা'র দোকানে ফিরে যায়।
সিগ্রেট টানার সময় দেহমন কাঁপছে.. হৃদয় নাচছে কোন সে প্রলয় আহবানে! আজ দেখা করার কথা। অনন্ত মাঝরাত পড়ে আছে। রোজকার মত বাসায় ফেরার তাড়া নেই।
শিহাবের বালিকা সে রাতে বাসায় একা ছিল। সবাই দূরে পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে। বালিকাকে দাদীর কাছে রেখে গেছে। অথর্ব এক অভিভাবক।
সে রাতে শিহাবের সেই বালিকা বঁধু হয়েছিল। বাইরে তখন গৃহত্যাগী জোছনার অনন্ত মাঝরাত দখলের প্রয়াস। সময় স্থির হয়ে লজ্জাবনত অনুভবে অন্য কোনো সময়ে 'শিহাব' হতে চেয়েছিল!
এরপর ক্রমশ: পতনের ইতিহাস। তলিয়ে যাবার অনুভবে প্রগলভ হতে হতে সময়কে অসময় হতে দেখা.. নিরন্তর তলিয়ে যেতে যেতে.. হারিয়ে যাওয়া।
এই সময়ে বসে ভিন্ন এক সময়ে হারানো শিহাব ওয়েটারের টিপস রাখতে রাখতে আনমনে দূরের কলোনির দিকে তাকায়। ওখানে এক বালিকা বঁধু হয়ে দাঁড়ালেও, সেই রাতের পরে সে আর কখনো ওর সামনে আসেনি।
সেই থেকে একজন বালিকা বঁধুর নারী হয়ে ওঠাটা, কখনোই শিহাবের আর অনুভব করা হয়নি।
আটাশ বছর পরে, প্রিয় শহরে সেদিনের এক কিশোর আজ কোনো এক বালিকা বঁধুর জন্য বড্ড উতলা হয়!
সেই বালিকার নারী রুপটি এই জীবনে তার আর জানা-ই হলো না!
★ মামুনের অণুগল্প
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৬ রাত ১০:৫৮