প্রিয় পাঠককুলের প্রতি বিশেষ অনুরোধ
এই পোষ্টে ব্যবহৃত ছবিগুলির ভিতরে বেশ কিছু লেখা থাকায় সেগুলিকে একটু পরিস্কার ভাবে দেখার সুবিধার্থে ইমগুর (an American online image sharing and image hosting service )ব্যবহার করে একটু বড় করে দেখানো হয়েছে । যারা এই বড় ছবিগুলি দেখতে পারবেন না তারা http://www.imgur.org sign in গিয়ে তাদের নিয়ম অনুসরণ করে নিলে সুবিধা হবে । এছাড়া ছবিগুলিকে ছোট আকারে এই পোষ্টের নীচে ২১ নং মন্তব্যের ঘরে দেয়া হয়েছে । তাঁরা অনুগ্রহ করে পোষ্টের মূল লেখা অংশ পাঠের পর ছবিগুলি মন্তব্যের ঘরে দেখে নিতে পারবেন ।
ভুমিকা
দাওয়াতুল ইসলাম নামক একটি ইসলামি সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত শিশু কিশোরদের জন্য ধর্ম ও বিজ্ঞান বিষয়ক একটি সওয়াল -জবাব প্রতিযোগীতায় ( Quiz competition) একজন অতিথি বক্তা হিসাবে যোগদানের সৌভাগ্য হয়েছিল । সে সময় আমার বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রতিযোগীতায় আগত শিশু কিশোরদেরকে ধর্মীয় বিষয় ও কোরান শিক্ষা এবং পাঠের সময় তাতে থাকা ধর্মীয় বিষয়ের সাথে মানুষের দৈনন্দিন ইহলৌকিক জীবন যাপন , প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে পবিত্র কোরানে থাকা প্রকৃতি ও পরিবেশ , চন্দ্র , সুর্য , তারা ও মহাগাগতিক বিষয়াবলী নিয়ে যা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে আরো বিশদ জানার জন্য সমসাময়িক বিজ্ঞান কি কথা বলে ,তাদের বিচরণভুমি কি, বিজ্ঞান সাধনা পদ্ধতি সে সাথে বিজ্ঞানের মুল লক্ষ্য ও অর্জনগুলি নিয়ে পড়াশুনা করলে কোরানের বাণী গুলি আরো ভাল ভাবে বুঝতে ও মানবজীবনে প্রয়োগ করতে সহায়ক হবে মর্মে কিছু কথা বলি ।
সে সময় কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম মহাকাশ বিজ্ঞানীগন চন্দ্র বিজয় তো সেই অর্ধ শতক পুর্বেই করে ফেলেছেন এখন ২০২৪ সালের শেষ ভাগে ডিসেম্বর মাসে তারা আমাদের কাছের নক্ষত্র সূর্যে অবতরণ করতে যাচ্ছে, এবং এখন পর্যন্ত তাদের তৈরী মহাকাশযান সূর্যের বেশ কাছাকাছি পৌঁছে গেছে । এ কথা শুনে শ্রোতা শিশু কিশোরগন অবাক বিস্ময়ে এবিষয়ে বিষদ বিবরণ জানার জন্য উৎসোক হয়ে পড়ে । তাদের আগ্রহের প্রেক্ষিতে পরবর্তী সেশনে বিষয়টি সচিত্র আকারে তাদের কাছে উপস্থাপন করার জন্য অঙ্গিকার করি । এরই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সনে সূর্য পৃষ্ট স্পর্শ করার জন্য আমিরিকার মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নাসার মিশন আউট লাইন টু টাচ সান সম্পর্কে তাদের ওয়েব সাইট হতে কিছু তথ্য ও চিত্র নিয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেনটেশন প্রনয়ন করে উপস্থাপনে প্রয়াসী হই ।
সেই প্রণীত মেটেরিয়েলস হতেই কিছু তথ্য চিত্র আমার অতি প্রিয় বাংলা ব্লগ সামুতে পরিবেশনের ইচ্ছা পোষণ করি । আমি নিশ্চিত সামুর বিজ্ঞ ব্লগারদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে বিশ্বের তাবত মাস মিডিয়ায় প্রচারিত এই সংবাদটি অবহিত হয়েছেন । তার পরেও ইংরেজী নববর্ষের শুরুতে বিজ্ঞানীদের এই মহামুল্যবান বিস্ময়কর সাফল্য সামুর অগনিত ব্লগারদের সাথে শেয়ার করে বলতে চাই নতুন বছরটিতে সুর্যকে স্পর্শ করার মিশনের মতই আমাদের জাগতিক বিষয়ে মানব হিতকর অসম্ভবকে জয় করার দৃঢ় প্রত্যয়ে ভরপুর হোক সকলের দেহ মন । যাহোক ,এবার ফিরা যাক সূর্যকে স্পর্শ করার বিষয়ে মুল কথায় ।
এই লেখাটি দুটি পর্বে প্রকাশ করা হবে । প্রথম পর্বে থাকবে শুরু হতে নিয়ে এখন পর্যন্ত সুর্যের প্রতি ধবামান মহাকাশটির সাফল্য ও অর্জন । দ্বিতীয় পর্বে থাকবে মহাকাশযান পার্কার সোলার প্রোব সূর্যের কাছাকাছি গিয়ে কি কি দেখছে তার সচিত্র বিবরণ ।
১ম পর্ব
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মহাকাশযান সূর্যকে স্পর্শ করেছে। নাসার পার্কার সোলার প্রোব এখন সূর্যের উপরের বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে - করোনা - এবং সেখানকার চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে উড়ে গেছে , এমন সংবাদই দিয়েছে নাসা ।
নতুন মাইলফলকটি পার্কার সোলার প্রোবের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ এবং সৌর বিজ্ঞানের জন্য একটি বিশাল অর্জনকে চিহ্নিত করে৷ চাঁদে অবতরণ যেমন বিজ্ঞানীদের বুঝাতে পেরেছিল যে সেটি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তেমনি এই অভিযানটি দিয়ে সূর্য কি উপাদানে তৈরি তা সূর্যকে স্পর্শ করে বিজ্ঞানীদের কাছে সৌরজগতের উপর এই নক্ষত্রটির প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উন্মোচন করতে সহায়তা করবে।
আজ হতে এক বছর পর, ২৪শে ডিসেম্বর, নাসার পার্কার সোলার প্রোব সূর্যকে অতিক্রম করবে ১৯৫ কিমি/সেকেন্ড বা প্রতি ঘন্টায় 435,000 মাইল গতিবেগে । কোনো মানব-সৃষ্ট বস্তু এর আগে এত দ্রুত না হয়েছে অগ্রসর আর না গিয়েছে আমাদের কাছের নক্ষত্র সুর্যের এত কাছে - সূর্য "পৃষ্ঠ" থেকে এটা এখন মাত্র ৬.১ মিলিয়ন কিমি বা ৩.৮ মিলিয়ন মাইল দুরে অবস্থান করছে।
নাসা পরিচালিত পার্কার সোলার প্রোব প্রকল্পের বিজ্ঞানী ডঃ নুর রাওফি বলেন, "আমরা মূলত একটি নক্ষত্রের উপর অবতরণ করতে যাচ্ছি।"
জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী বলেছেন, "এটি সমস্ত মানবতার জন্য একটি স্মরণীয় অর্জন হবে। এটি ১৯৬৯ সালে চাঁদে অবতরণের সমতুল্য।" পার্কারের গতি সূর্যের কাছাকাছি হওয়ার সাথে সাথে উদভুত মহাকর্ষীয় টান থেকে এর গতি আরো বাড়বে। এটি মাত্র ৩০ সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যে নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনে উড়ে যাওয়ার মতো হবে।
ওয়াশিংটনে নাসা সদর দফতরের বিজ্ঞান মিশন অধিদপ্তরের সহযোগী প্রশাসক টমাস জুরবুচেন বলেছেন, "এই মাইলফলকটি কেবল আমাদের সূর্যের বিবর্তন এবং আমাদের সৌরজগতের উপর এর প্রভাবগুলির গভীর অন্তর্দৃষ্টিই শুধু দিবেনা, উরূপ্ত আমরা আমাদের নিজের কাছের নক্ষত্র সম্পর্কে যা শিখব তা আমাদের মহাবিশ্বের বাকি নক্ষত্র সম্পর্কে আরও কিছু শেখাবে।"
অন্যান্য মহাকাশযান গুলি অনেক দুর থেকে দেখে যখন সুর্য সম্পর্কে তথ্য দিতেছিল সেখানে এই পার্কার সোলার প্রোব সৌর পৃষ্টের কাছাকাছি সৌর বায়ুর মধ্য থেকে সুর্য কণার প্রবাহ, যা আমাদের পৃথিবীকে প্রভাবিত করতে পারে সে সম্পর্কে তথ্য প্রেরণে সক্ষম ।
২০১৯ সালে, পার্কার আবিষ্কার করে যে সৌর বায়ুতে রয়েছে চৌম্বকীয় জিক-জ্যাক কাঠামো, যাকে সুইচব্যাক বলা হয়, তা প্রচুর পরিমানে সূর্যের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে । কিন্তু তারা কোথায় এবং কিভাবে গঠিত হয় তা একটি রহস্যই থেকে যায়। তারপর থেকে সূর্যের অর্ধেক দুরত্ব পার হয়ে, পার্কার সোলার প্রোব তা সনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট কাছাকাছি অবস্থানে চলে গেছে । এই পার্কার সোলার প্রোব করোনার মধ্য দিয়ে তার লক্ষ্যমাত্রার দিকে ছুটে চলার সময় - যাত্রা পথে দেখা বিষয়াবলী অধ্যয়ন করে বিস্ময়কর ঘটনাগুলির তথ্য সরবরাহ করতে থাকবে।
আসুন শুরু থেকে অধ্যাবধি পরিচালিত এই অভিযানের অর্জিত সাফল্যগুলি নাসার বিজ্ঞানীদের তৈরী করা সিচিত্র তথ্য বিবরনী হতে সংক্ষেপে অবলোকন করি ।
১. সূর্যকে ষ্পর্শ করার জন্য ফ্লোরিডার কেপ ক্যনাবেল হতে ২০১৮ সালে সোলার পার্কার প্রোব
ধারণ করে শক্তিশালী ডেল্টা IV হেভি রকেট উতক্ষেপন
২. কয়েক বছর দ্রুত গতিতে পথ চলার পর এটা সূর্যের কাছাকাছি গমন করে
৩ অবশেষে মহাকাশযানটি সূর্য়ের ৮ম কক্ষপথে এসে পৌঁছায়
৪. এই মিশন প্রকল্পের বিজ্ঞানী নূর রোফি বলেন আশ্চর্যজনক, পার্কার সোলার প্রোব সূর্যকে স্পর্শ করছে
৫.ক্যরিয়ারের শুরু হতেই তিনি এই মহুর্তটির জন্য অপেক্ষমান ছিলেন
৬. পার্কার সোলার প্রোবের অন্যতম প্রধান লক্ষ ছিল সৌর করোনার মাধ্যমে উড়ে গিয়ে সূর্যকে
ষ্পর্শ করা যা এখন সাধিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো সুর্যকে স্পর্শ করা বলতে কি বুঝায় ?
৭. এটা জানতে হলে তাকাতে হবে সুর্য়ের স্ট্রাকচারের দিকে
৮. পৃথিবীর মত সূর্যের পৃষ্ঠদেশে সলিড কিছু নেই
৯. এটি হট প্লাজমার দৈত্যাকার বল, যা নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা একত্রিত হয়
১০. এই সারফেস হতেই সৌর মেটেরিয়েল প্রবাহিত হয়
১১. তবে এটি সূর্যের চারপাশে, সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ এবং চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা আবদ্ধ
১২ এই উপাদানটি সূর্যের বায়ুমণ্ডল গঠন করে – যা করোনা(Corona) নামে অভিহিত
১৩. অবশেষে একটা সময়ে গরম এবং দ্রুত ধাবমান সৌর উপাদানের প্রভাবে সূর্যের টান থেকে রক্ষা পায়
১৪. এবং এটা তখন সৌর বায়ু হিসাবে মহাকাশে প্রবাহিত হয়
১৫. এই অবস্থাকে Alfven critical surface হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে
১৬. এই ক্রিটিক্যাল সারফেসের সীমানা ঠিক কোথায় তা বিজ্ঞানীরা জানতোনা
১৭. কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথম মহাকাশজানটি একে অতিক্রম করে করোনায় ( Corona ) প্রবেশ করেছে
১৮. পার্কার সোলার প্রোব করোনায় প্রবেশ করে তার অনুসন্ধান শুরু করেছে
১৯. সৌর উপাদান স্পর্শ করে সূর্যের সাথেই আবদ্ধ রয়েছে
২০. পাতলা (উইস্পি) করোনা স্তরটি বেশির ভাগ সময় দেখতে খুব ক্ষীণ
২১. তবে এটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় বেশ ভাল ভাবেই প্রকাশ পায়
২২. সূর্যগ্রহণের সময় সুর্যের বায়ুমণ্ডল নিয়ে শতাব্দিকাল ধরেই বিজ্ঞানিগন গবেষনা করে আসছিল
২৩. কারণ সুর্য কিভাবে সৌরজগতে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে তা জানা খুবই জররী
২৪. কিন্তু করোনার অনেক কিছুই থেকে গেছে রহস্যাবৃত
২৫. প্রকল্পটির বিজ্ঞানি বলেন জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি
চ্যালেঞ্জিং রহস্যই এমন একটি অঞ্চলে ঘটে যাকে আমরা সৌর করোনা বলি
২৬. প্রথম রহস্যটি হলো এর উত্তাপ সংক্রান্ত
২৭. ফটোস্ফিয়ারের চেয়ে করোনা প্রায় ৩০০ গুণ বেশি গরম
২৮. নীচে দৃশ্যমান সূর্য পৃষ্ঠা
২৯. দ্বিতীয়ত সূর্য থেকে প্রবাহিত কণার একটি ধ্রুবক প্রবাহ রয়েছে যা সৌর বায়ু নামে পরিচিত
৩০ এগুলি করোনা থেকে প্রতি ঘন্টায় মিলিলিয়ন মিলিয়ন মাইল বেগে ত্বরান্বিত হয় এবং জানা যায়নি এটা কিভাবে হয়
৩১. সৌর বায়ু আমাদের উপগ্রহ এবং প্রযুক্তিকে ব্যাহত করতে পারে
৩২. তাই তাদের আরও ভালভাবে সুরক্ষা দেয়ার জন্য বিজ্ঞানীদেরকে যেতে হবে যেখানে সৌর বায়ু শুরু হয়
৩৩. তাই ক্ষনকালের জন্য নাসার মূল লক্ষ্য হয়েছিল সেখানে যাওয়ার
৩৪. নাসা প্রথম ১৯৫৮ সালে সূর্যের কাছে একটি মহাকাশযান পাঠানোর ধারণাটির প্রস্তাব করেছিল
৩৫. উচ্চ তাপমাত্রায় টিকে থাকার মত প্রযুক্তি ২০০০সাল পর্যন্ত নাসার কাছে ছিল না
৩৬.সেই প্রযুক্তি অর্জনের পর ২০১৮ সালে লাঞ্চ হওয়ার পর থেকে পার্কার সূর্যের দিকে যাচ্ছে
এখানে ক্লিক করে দেখুন সূর্যের কাছাকাছি গিয়েও মাত্রারিক্ত সৌর তাপে মহাকাশযানটি কেন গলে যায়নি?
৩৭. তারপর ২০২১ সালের এপ্রিলে পার্কারের সূর্যের চারপাশে অষ্টম কক্ষপথে অবস্থান
৩৮. মহাকাশযানটি সূর্যের পৃষ্ঠা থেকে প্রায় ২০ সোলার radii বা ৮ মিলিয়ন মাইল দূরে
৩৯. যখন এটি করোনায় প্রবেশ করেছে
৪০ এটি একটি বিশাল মাইলফলক যা বিজ্ঞানীদেরকে এই বিন্দুতে আসতে ৬ দশকেরও বেশি সময় লাগিয়েছে
৪১. পার্কার সোলার প্রোব মহাকাশযানটি এখন পর্যন্ত সূর্যের দিকে যে পথ পারি দিয়েছে তার একটি চিত্র
এতক্ষন ধৈর্য ধরে সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। পরের শেষ পর্ব দেখার জন্য আমন্ত্রন রইল ।
তথ্য ও ছবি সুত্র : ১) নাসার অফিসিয়েল ওয়ে্ব সাইট Click This Link
২) বিবিসি নিউজ Click This Link