উত্তরের যাত্রার ১ম ও ২য় পর্বের লিংক
১ম পর্ব - উত্তরের যাত্রা : মেরো জ্যোতি দর্শন
২য় পর্ব – উত্তরের যাত্রা : এস্কিমো দর্শন
উত্তরের যাত্রার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে উত্তরের বিস্ময় মেরু জ্যোতি ও এস্কিমোদের জীবনাচার নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে । উত্তরাংশে আরো একটি বিস্ময়কর জগত রয়েছে আর সেটা হল উত্তর গোলার্ধের সমগ্র উত্তরাংশ জুরে বিস্তৃত বিশাল বৈচিত্রময় বরিল বনভুমি । গ্রীক মিথ অনুযায়ী উত্তরের বায়ু দেবতা বরিয়াসের সামানুসারে বরিল ফরেস্টের নাম করণ হয়েছে । গ্রীক মিথলজিতে বিশ্বাস করা হয় দেবতা বরিয়াস পৃথিবীতে উত্তর হতে ঠান্ডা বায়ু ও শীত বয়ে আনে ।
বরিল বনাঞ্চল
বরিল ( Boreal ) বনভুমিকে কানাডায় বায়মি বা biome নামেও অভিহিত করা হয় কিন্ত এই বিশাল বনভুমি রাশিয়ান শব্দ তৈইগা(Taiga) নামেও পরিচিত । উত্তর আমেরিকা সহ অনেক লিটারেচারে এই বনাঞ্চলটি বরিল নামে বহুল ব্যবহৃত হয় বিধায় এই পোষ্টে একে বরিল বনাঞ্চল হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছে । বরিল পৃথিবীর বৃহত্তম বনাঞ্চল। বরিল বনাঞ্চল উত্তর আমেরিকার কানাডা এবং আলাস্কার ভূপৃষ্ঠজুড়ে বিস্তৃত। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর অংশেও বরিল বনাঞ্চল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এটি নর্থউড নামেও পরিচিত। বরিল বনাঞ্চল সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ের উত্তরাংশ, রাশিয়ার সাইবেরিয়া, কাজাখস্থানের উত্তরাংশ, মঙ্গোলিয়ার উত্তরাংশ এবং জাপানের উত্তরাংশ জুড়েও বিস্তৃত। পৃথিবীর মোট বনাঞ্চলের মধ্যে বরিল বরাঞ্চল এক তৃতিয়াংশ স্থান দখল করে আছে।
ছবি-১ : ম্যাপে উত্তর গোলার্ধে বরিল বনাঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান ( সবুজ চিহ্নিত অংশ)
বিশ্বের বনাঞ্চল গুলির মধ্যে বরিলের তাপমাত্রা সর্বনিম্ন। বরিল শীতপ্রধান অঞ্চল। এখানে গ্রীষ্ম এক থেকে তিন মাসের মত অবস্থান করে। সাধারণত তাপমাত্রা - ৫ °C থেকে ৫°C এর মধ্যে থাকে।তবে সাইবেরিয়ার পূর্বে ও আলাস্কার মধ্যাঞ্চলে বরিল বনাঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা - ১০C এ পৌঁছে । বরিল বনাঞ্চলে বৃষ্টি ও তুষারপাত তুলনামূলকভাবে কম। এখানে বার্ষিক গড় বৃস্টিপাতের পরিমান ২০০ মিমি । কোন কোন এলাকায় ৭৫০মিমি হতে ১০০০ মিমি পর্যন্ত হয় । শীতকালে তুষার এবং কুয়াশা পরে । নিম্নাঞ্চলের দিকে কুয়াশার পরিমাণ বেশি। গ্রীষ্মের সময়েও বরিলে সূর্যরশ্মির তীব্রতা খুব বেশী হয় না। বছরের অধিকাংশ সময় বাষ্পীভবনের পরিমাণ খুব কম, ফলে বর্ষণের পরিমাণ বাষ্পীভবনের চেয়েও বেশি হয় একারণে এখানে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিদ জন্মে ।
বরিলের মাটি তুলনামূলকভাবে কম পুষ্টিসমৃদ্ধ। বিষুবীয় অঞ্চলের বন সমূহ যে রকম উর্বর, বরিলে সেরকম পুষ্টিসমৃদ্ধ মাটি নেই। এছাড়াও এখানকার শীতপ্রধান জলবায়ু উদ্ভিদের বর্ধনকে বাধাপ্রাপ্ত করে । ঝরা পাতা এবং শৈবাল বরিলের মাটিতে দীর্ঘকাল পড়ে থাকে, ফলে তা মাটিতে শোষিত হতে পারে না এবং জৈবিক অবদান রাখতে পারে না। একারণে মাটি অম্লীয় হয়। তাই মাটিতে শুধু ছত্রাক এবং শৈবাল জন্মে। তবে বনের যেখানে গাছপালার পরিমাণ বেশি সেখানে উদ্ভিদের বৈচিত্র্যতা রয়েছে, তৃণগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের প্রাপ্যতা সেখানে বেশি।
এই পোষ্টে বরিলের জীব বৈচিত্রকে তিনিটি ভাগে যথা বরিলের উদ্ভিদ জগত , বন্য প্রাণী জগত ও সেখানকার আদিবাসি মানব জগতে ভাগ করে দেখানো হয়েছে ।
বরিলের উদ্ভিদ জগত
বরিল বনভুমিতে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ জন্মে, সেখানে ফার, লার্চ, মাউন্টেইন অ্যাশ ও ফায়ারউডের মতো বার্চ গাছ দেখা যায়। তবে বরিল বনভুমি এলাকায় বার্চ, উইলো, হিথ, লিঙ্গোনেবেরি, বাইবেরি, ব্লুবেরি, , কটনগ্রাস, লিঞ্চেন এবং মসেস নামের ঘাস দেখা যায়। তার মধ্যে কনিফার্স ( সুচালু পাতা )জাতীয় উদ্ভিদই প্রধান । তুষাড়ের মধ্যে এ গাছটি ভাল জন্মে কারন পাতা সুচালু ও পাতার গায়ে মোমের মত একটি প্রলেপ থাকায় এরা তুষাড়পাতের সাথে ভাল করে নীজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারে ।পাইন ও ফার বৃক্ষ এই কনিফারদের মধ্যে অন্যতম ।
ছবি -২ : ফার বৃক্ষ ( বায়ে) , পাইন ( ডানে ) ও সর্ব ডানেরটি পাইন গাছের কৌন সদৃশ্য বীজ , এই বীজ ফুটে অংকোরোদগম সে এক কঠীন ব্যপার ।
ছবি-৩ : বায়ের চিত্রটি মসেস , মাঝেরটি ব্রিটিস সোলজার্স নামে পরিচত লিচেন ও ডানেরটিও একটি লিচেন জাতীয় উদ্ভিদ
বরিলে প্রচুর পত্র ঝড়া বৃক্ষ রয়েছে । শীতের প্রকোপ শুরু হতেই এদের পাতা ঝড়ে যায় আবার গ্রীস্মের আগমনে পত্র পল্লিবিত হয়ে উঠে ।
ছবি - ৪: গ্রীস্মের বিদায় লগ্নে শীতের আগমনে বরিল বনভুমির বৃক্ষের পাতার রং পরিবর্দনের দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন হাজার হাজার হলুদ ফুল ফুটে আছে গাছে ।
ছবি –৫: শীতের আগমনে বরিলের পাহাড় চুড়াতেও দেখা যায় রংএর বাহারী মেখলা দৃশ্য
ছবি – ৬ : বরিল বনভুমে রয়েছে কিছু প্রকৃতির অপরূপ লিলা, যুক্তরাষ্টের ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক বনভুমে বাহারী রংগের ভুগঠনের দৃশ্য
গেসিয়ারের দেখা মিলে বেশী বরিল বনভুমির জলাধারে কিংবা নদীর কিনারে
গেসিয়ার (Geysers) হল একটি উষ্ণ প্রস্রবণ । এটা সৃস্টি হয় যেখানে জলাধারের পানি অবাদে ভুত্বকে প্রবাহে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ও তাপমাত্রার হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে ভুঅভ্যন্তরে কিংবা বাইরে । এর ফলে কোন গর্ত মুখ দিয়ে ( সেটা জলাধারের মধ্যে কিংবা তার তীরেও হতে পারে) প্রচুর স্টীম নির্গত হয় এবং একটি অগ্ন্যুত্পাত শুরু হয়ে উষ্ণ প্রস্রবণের সৃস্টি করে । এটা ঘন মেঘের মত কুন্ডলী পাকিয়ে ৩০০ হতে ৪০০ ফুট পর্যন্ত আকাশে উঠে যায় , সৃস্টি করে অপুর্ব এক দৃশ্যের । জলাধারের পানি নিশ্বেসিত কিংবা সিসটেমটা শিতল না হওয়া পর্যন্ত এটা চলতেই থাকে । সারা দুনিয়া জুরে প্রায় দুই হাজারের মত গেসিয়ার অছে বলে জানা যায় এর মধ্যে আমিরিকার ইয়েলোস্টন ন্যাশনাল পার্কেই প্রায় ১২৮৩ টা গেসিয়ারের জন্ম হয়েছে। ২০১৪ সনে শুরু স্টীমবোট গেসিয়ার নামে বিশ্বের সর্ববৃহত গেসিয়ারটি এখনো একটিভ আছে ।
এখানে CLICK করে ভিডিউটি দেখলে বুঝতে পারবেন , গেসিয়ারের খুব কাছ থেকে ছবি তোলা যায় ও এর উল্টা দিকে গেসিয়ারের জলিয় বাস্পের কারণে দিগন্ত জুরে রং ধনু দেখা যায় ।
ছবি-৭ : আমিরিকার উত্তরে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে কোন-টাইপ গেসিয়ার (Geyser) : এটা একটা রিভার সাইড গেসিয়ার
ছবি-৮ : গেসিয়ারের দৃশ্য দেখে মনে হবে আকাশের মেঘমালা যেন ধরার বুকে নেমে এসেছে ।
নীচে দেশে দেশে বরিল বনভুমির কিছু দৃশ্য তুলে ধরা হল ।
ছবি- ৯ : রাশিয়ার উত্তরে কলিমাতে বরিল তথা তৈগা বনভুমি
ছবি –১০ : আলাস্কা রেঞ্জের কাছে সপ্রসু গাছ সমৃদ্ধ বরিল বনভুমি
ছবি - ১১ : বরিল বনভুমিতে মাঝে মাঝে স্বচ্ছ পানির লেক একটি কমন ব্যপার : ফিনল্যান্ড এর Helvetinjärvi National Park
ছবি –১২ : নরওয়ের নাভরিক এর কাছে বরিল বনভুমি : সমুদ্রের সাথে একিভুত বরিলের এ অংশটি বরিলের অন্য অংশ হতে অনেক উষ্ণ
ছবি –১৩ : কানাডায় বরিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীগুলির একটি ইউকন রিভার ( ৩১৯০ কিলোমিটার)
ছবি -১৪ : বৈকাল হৃদের কুলে বরিল ফরেস্ট
ছবি – ১৫ : সুইডেনের বরিল বনভুমিতে বিখ্যাত পাইন ট্রি
ছবি – ১৬ : মার্কিন যুক্তরাষ্টের অহিওর ব্রাউন লেক বগে বরিল বনভুমিতে নর্দার্ন পিচার প্লান্ট ( ডানে)
ছবি – ১৭ : আমিরিকার বুথবে মেইন বরিল ফরেস্টে সারাসিনা পারপুরিয়া (Sarracenia purpurea )
ছবি –১৮ : আমিরিকার বুথবে মেইন বরিল ফরেস্টে Sarracenia purpurea –২
বরিলের বন্যপ্রাণী
বরিলের শীত প্রধান জলবায়ুর কারনে সেখানে বড় ধরনের জীব বৈচিত্র হতে পারেনা । তীব্র শিতের সাথে মানিয়ে নিতে পারা প্রাণীকুলই সেখানে বসবাস করে । বরিল বনভুমিতে বাস করা বন্য প্রানীর সচিত্র বিবরণ নীচে তুলে ধরা হল ।
বরিলের সরিসৃপ
খুব কম প্রজাতীর সরিসৃপ বরিলের বনভুমিতে দেখতে পাওয়া যায়, কারণ শীত ও বরফ তাদের বেচে থাকার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ । উত্তর আমিরিকা ও ইউরোপিয় অংশের বরিল রিজিয়নে রেড –সাইডেড গার্টার স্নেক ও ইউরোপিয়ান এডার স্নেক দেখতে পাওয়া যায় । মরে যাওয়ার ভয়ে সেখানকার সাপগুলি গাছের কোটরে কিংবা গভীর গর্তের ভিতরে শিতকালে ঘুমিয়ে কাটায় যাকে hibernate হিসাবেই অভিহিত করা হয়ে থাকে ।
ছবি – ১৯ : বরিল বনভুমি এলাকার রেড- সাইডেড গার্টার স্নেক
বরিলের উভচর প্রাণী
সরিসৃপের মত উভচর প্রাণীরও বরিলে বসবাস বেশ কষ্টকর । শুধুমাত্র কিছু প্রজাতীর ব্যাঙগ (নর্দার্ণ লিউপার্ড ফ্রগ, কানাডিয়ান টড, এবং সালামানডারস এর সাক্ষাত পাওয়া যায় বরিলের বনভুমিতে,তবে শীতের সময় তারাও কোটরে বা গর্তে থেকে দীর্ঘ দিন কাটায় ।
ছবি -২০ : বায়ে একটি ব্লু কোটেড সালামানডার ও ডানে একটি কানাডিয়ান টড
বরিলের মাছ
বরিলের জলাধারের পানিতে মাছেরও বিচরণ খুবই কম । বরিলের পানিতে যে সমস্ত সাধারণ মাছ পাওয়া যায় তার মধ্যে আলাস্কা ব্লেক ফিস , লেক এন্ড রাউন্ড হোয়াইট ফিস , ব্রোক ট্রাউট, সাইবেরিয়ান ট্রাইমেন, ওয়ালী, চুম সালামন , সিসকো , লেক চুব ও লেনক অন্যতম ।
ছবি-২১ : বরিলের জলাসয়ে বিচরণকারী চুম সালামন মাছ
ভোঁদড়
বরিলের আমিরিকান ও ইউরোপিয় অংশে ভোঁদর দেখতে পাওয়া যায় , এদের গায়ের পশম ও চামড়ায় ওয়াটার রিপিলেন্ট কোট রয়েছে যা তাদের ঠান্ডা প্রতিরোধে সক্ষমতা দেয় । এরা মাছ, ব্যাঙগ, পাখী , কাকরা সামুক প্রভৃতি খেয়ে জীবন ধারন করে।
ছবি - ২২ : বরিল বনভুমি এলাকার ভোঁদড়
বরিলের পক্ষিকুল
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী উত্তর আমিরিকার সকল পক্ষীকুলের শতকরা ৬০ ভাগ ররিল বনভুমিতে বিচরণ করে বলে জানা যায় । এর মধ্যে বেশী সংখ্যকই পারিজাত পাখি । শীতকালে এরা দলবেধে দক্ষীন পানে উড়াল দেয় । সাধারন প্রজাতিগুলির মধ্যে কমন গল্ডেনি, কমন লুন, কমন টার্ন, হেরিং গাল , বাফলহেড, স্প্রুস গ্রাউস (spruce grouse) উল্লেখযোগ্য পাখী ।
ছবি - ২৩ : স্প্রুস গ্রাউস (spruce grouse) তথা বন মোরগ (বায়ে) কমন গোল্ডেন ( ডানে)
ছবি – ২৪ : কমন লুন
ছবি- ২৫ : কমন টার্ন ( বায়ে) বাফলহেড ( ডানে)
তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণী এবং খরগোশ (Rodents And Rabbits)
বরিলের বনভুমি এলাকায় রয়েছে প্রচুর সংখ্যক তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণী এবং খরগোশের বসবাস । বরিল আবাসস্থলে বসবাসকারী তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণীদের কিছু হচ্ছে Beavers, কাঠবিড়ালি, voles, ইঁদুর, এবং মাউস । এই তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণীগুলি বরিলের মাংসাশী প্রাণী যথা weasels, minks, stoats, Lynx, Coyotes ও অন্যদের খাদ্য শৃঙ্খলে একটি গুরুত্বপুর্ণ খাদ্য উৎস হিসাবে কাজ করে । বরিলের খরগোস প্রজাতীর মধ্যে স্নোশু (snowshoe hare ) উল্লেখ যোগ্য । বরিলের আদিবাসী শিকারীদের কাছে খরগোস একটি অতি প্রিয় ভোজন প্রিয় প্রাণী ।
ছবি- ২৬ : বরিলে বসবাসকারী স্নোশু (snowshoe hare ) খরগোস )
ছবি – ২৭ এমেরিকান মারটেন তথা গাছ বিড়ালী , কানাডা ও আলাস্কার বরিল বন ভুমিতেও দেখতে পাওয়া যায়
ছবি-২৮ : ওয়াসেল (Weasel) তথা বেজী, এরা মাঝে মাঝে বরিল আদিবাসিদের মুরগী বা খরগোসের খোয়ারে আক্রমন করে ।ডানের ছবিটি মিংকের (Mink)
রবিল বনাঞ্চলের আলাস্কা এলাকায় Porcupine নামে এক প্রকার সজারুর মত দেখতে তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণীর সাক্ষাত পাওয়া যায় । নীচে ছবি দেখানো হল
ছবি- ২৯ : Porcupine এর ছবি ( বায়ে বেবি Porcupine) গায়ের কাটা শিকাড়ির হাত হতে নীজকে রক্ষা করে )
হরিণ প্রজাতি
মুঝ (Moose) হরিণ
হরিণ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের হল মুঝ হরিণ । বরিলে এক সময় বহুল পরিমানে বসবাস করলেও এখন শিকারী দের উপদ্রবে এদের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে ।
ছবি – ৩০ : ররিল বনভুমে বিচরণকারীএকটি মুঝ হরিণ
কাবিরু বা বল্গা হরিণ
বিভিন্ন প্রজাতীর কারিবু বলগা হরিন কিংবা রেইন ডিয়ারকে বরিল বনভুমিতে দেখতে পাওয়া যায় । এরা শৈবাল , বার্চের পাত ও ঘাস খায় ।
ছবি- ৩১ : কারিবু ( Caribou ) বা বল্গা হরিণ
এলক (Elk ) হরিন
এলক হরিন (Cervus Canadensis) উত্তর আমিরিকা ও পুর্ব এশিয়ায় বরিল বনভুমে বিচরণকারী অন্যতম বৃহত্তম স্থল প্রাণী । এরা বরিল বনভুমের উত্তরের দিকে আসে গ্রীস্মকালে এবং শীতকালে দক্ষীনে চলে যায় । এই এল্ক হরিণের শিঙকে পূর্ব এশিয়া অংশের দেশগুলিতে ঐতিহ্যগত ঔষধ প্রস্তুতির জন্য ব্যবহার করা হয় । শিকারীদের অত্যাচারে এরা বিলুপ্ত হতে চলেছে ।
ছবি –৩২ : এল্ক হরিণ ( বায়ের টি পুরুষ এবং ডানেরটি মেয়ে হরিণ)
নেকড়ে ও শিয়াল
ধুসর নেকড়ে (Canis lupus), কয়ট (Canis latrans), and লাল শিয়াল ( vulpes) বরিল বনভুতিতে দেখতে পাওয়া যায় ।
ছবি – ৩৩: বরিল বনাঞ্চলে বিচরণকারী লাল শিয়াল : এরা আকারে আমাদের দেশের শেয়াল হতে অনেক ছোট
ভাল্লুক ( খয়েরী/কাল/ মেরু)
খয়েরী ভাল্লুক, আমিরিকান ও এশিয়ান কাল ভাল্লুক এবং মেরু ভাল্লুক এর সবকটিকেই বরিল বনভুমিতে বসবাস করতে দেখা যায় । মেরু ভাল্লুক আর্কটিক জোনের সীমা লঙ্গণ করে মেরু কাছাকাছি এলাকাতেও চলে যায় ।
ছবি -৩৪ : একটি খয়েরী ভাল্লুক
ছবি – ৩৫: কানাডার মানিটুবা ওয়াপুস্ক ন্যাশনাল পার্ক নার্সারিতে মেরু ভাল্লুকের বংশ বিস্তারের একটি দৃশ্য ।
সাইবেরিয়ান টাইগার
বরিল তথা তৈগা বনাঞ্চলের সবচেয়ে প্রতিমাসংক্রান্ত ( Iconic) প্রজাতি তালিকার মধ্যে বিপন্ন সাইবেরিয়ান বাঘ (প্যান্থেরা altaica টাইগ্রিস ) উল্লেখযোগ্য় । একসময় এরা পূর্ব রাশিয়া, উত্তর-পূর্ব চীন, কোরিয়া, এবং পূর্ব মঙ্গোলিয়ায় তৈগা আবাসে বৃহৎ অংশ দখল করে থাকলেও বর্তমানে সাইবেরিয়ান বাঘের একটি ছোট জনসংখ্যা Primorye প্রদেশ এবং সুদূর পূর্ব রাশিয়ার মধ্য Sikhote Alin পর্বত অঞ্চলে অবশেষ রয়েছে বলে জানা যায় । বর্তমানে বরিল বনাঞ্চলে মাত্র ৩৫০-৪০০ মত এই সাইবেরিয়ান টাইগার আছে বলে জানা যায় । এই সাইবেরিয়ান টাইগার দেখতে অনেকটা আমাদের সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত দেখতে ।
ছবি -৩ ৬: বাচ্চা সহ সাইবেরিয়ান টাইগার
বরিল বনাঞ্চলে মানব বসতি
বরিল বনগুলোতে জটিল পরিবেশগত আবাসস্থলের কারণে মানুষ সম্প্রদায় , প্রাণী ও উদ্ভিদ জীবনে রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্রতা । প্রায় এক মিলিয়ন আদিবাসীদের বসবাস উত্তরের বরিল বনে । আদিবাসী অধিবাসীদের মধ্যে কানাডায় ক্রি এবং ডীন সম্প্রদায় , নরওয়ে , সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে সামি বা লেপল্যন্ডার সম্প্রদায় , উত্তর জাপানে আইনু, এবং সাইবেরিয়ায় নিনেট ,, ইয়াকুট, উডেজ , তাসতান প্রভৃতি উপজাতি হাজার হাজার বছর ধরে বনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে বসবাস করে আসছে ।
উল্লেখ্য যে বর্তমানে শুধুমাত্র কানাডার বরিল ফরেস্ট এলাকায় প্রায় ৬০০ বিভন্ন আদিবাসি সম্প্রদায় বসবাস করছে এবং তাদের জীবন ধারণের জন্য গতানুগতিক শিকাড় ও কৃষি কর্ম করছে । তবে কলোনিয়াল যুগ হতে তাদের জীবনে দু:খ দুর্দশা শুরু হতে থাকে । মাটিনাডুর পপলার নদীর তীরে কানাডার আদিবাসিরা প্রথম বসতি স্থাপন করে । পশুর চামড়ায় তৈরী তাবুরমত আবাসে অরোরা জ্যোতি নিত্য দিনই আলোকিত করত বলে জানা যায় ।
ছবি – ৩৭ : মাটিনাডুর পপলার নদীর তীরে কানাডার আদিবাসিদের বসতির উপরে মেরু জ্যোতির নাচানাচি
সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থার করুন হাল , বরিলের বৈচিত্রময় বন্য জীবনের কঠীন সংগ্রাম সকলই তাদের উপর দিয়ে চলে । অনেক আন্দোলন ও সংগ্রামের পরে কলোনিয়াল যুগে হারানো জায়গা জমি ফিরত পাওয়ার জন্য ২০১৩ সনে আদিবাসী ডীন সম্প্রদায় কানাডার ফেডারেল সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির ফলে তারা ৭.৫ মিলিয়ন একর জমি তাদের কাছে ফেরত নিয়ে এসে আদিবাসী কৃষ্টি , চাষাবাদ ও জীবনধারনের নিশ্চয়তা বিধান করে ।
ছবি - ৩৮ : হারানো জমি ফিরে পাওয়া উপলক্ষে কানাডার পপলার নদীর তীরে মানিটুবাতে ২০১৪ সনে প্রথম আদিবাসী ইনিশিয়েটিভ ইভেন্ট উদযাপন ।
বরিল বনভুমি এলাকায় আদিবাসিরা ছোট ছোট কাঠের ঘরে বসবাস করে । শীতকালে প্রকৃতি পরিবেশ বাড়ীঘর মোরে যায় বরফে।
ছবি – ৩৯ : বরিল বনের ভিতরে আদিবাসিদের বসবাসের জন্য ছোট ছোট কাঠের ঘর ।
বরিল বনভুমি এলাকা মোটামুটিভাবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলির অন্তর্ভুক্ত । তাদের ঘর বাড়ীতেও অধুনা এর কিছু ছোয়া লেগেছে, তাদের কাঠের বাড়ী একটু উন্নততর হচ্চে যা নীচের ছবিতে দেখানো হলো । এই বনের পোষ্টে বিচরণকারী পাঠকগন কিছুটা সময় এখানে অবলিলায় বিশ্রাম নিয়ে যেতে পানেন ।
ছবি-৪০ : বনের ভিতরে বসবাসের জন্য একটু উন্নতমানের কাঠের ঘর
ছবি - ৪১ : দোলনা হতেই আদিবাসী শিশুরা কাঠের ঘরে বসবাস করে পরিচিত হতে থাকে প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে ।
ছবি –৪২ : শীতকালে বরফে ঢাকা পথে যাতায়াত বড়ই কঠিন, বরফ ভেঙ্গে পথ চলার কিছু ব্যবস্থা স্থানীয় কতৃপক্ষ মাঝে মধ্যে করে ।
ছবি -৪৩ : বন হতে শীকাড় করা খরগোশ কাধে ঝুলিয়ে সেখানকার আদিবাসিরা বরফের উপর দিয়ে হেটে ঘরে ফিরে
ছবি -৪৪ : অন্যদিকে সাইবেরিয়ার বরিল বনভুমি এলাকার আদিবাসিরা বল্গা হরিণকে প্রথম পোষ মানিয়ে এমন করে মালামাল টানার কাজে নিয়োগ করে ।
রাশিয়ার বরিল বনাঞ্চলের আদিবাসী তাসতান সম্প্রদায় বল্গা হরিণকে তাদের জীবন জীবিকার সাথে বিবিধ উপায়ে সম্পৃক্ত করেছে । তারা শুধু হরিণ দিয়ে মালা্ই টানেনা তারা এই হরিণের দুধও পান করে। হরিণের এতসব গুণের কারণে তারা একে ধর্মীয় ভাবেও ভক্তি নিবেদন করে ।
ছবি- ৪৫ : রাশিয়ার বরিল বনাঞ্চলের আদিবাসী তাসতান সম্প্রদায় বল্গা হরিণ হতে দুগ্ধ আহরন করছে
বরিল এলাকার আদিবাসীরা মুলত উন্নত বিশ্বের দেশগুলির আদিবাসী নৃতাত্বিক জনগুষ্ঠি । তাই এখন তারা মোটামোটিভাবে আধুনিক বিশ্বের জীবন ধারণের অনেক সুযোগ সুবিধাই তাদের মত মানানসই করে উপভোগ করছে । সে সমস্ত দেশের সরকার ও আর্থ –সামাজিক ব্যবস্থা তাদেরকে যথাসম্ভবভাবে সহায়তা করছে । তাদের জীবন ততটা দৃর্বিসহ নয় যতটা আমাদের দেশের নৃতাত্বিক জনগুষ্ঠী ভোগ করছে ।
হুমকির মুখে বরিল বনভুমি
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বরিল অঞ্চলের মাটির নীচে থাকা গ্যাস ও তেল সম্পদ উত্তোলন কর্মসুচী এই বনভুমির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে । আলাস্কা হতে শুরু করে কানাডা ও রাশিয়া পর্যন্ত বরিল বনভুমি তলে রয়েছে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেল । এর উত্তোলন ব্যপকভাবে শুরু হলে বরিলের স্লো- গ্রোইং কনফেরাস বৃক্ষরাজির জন্য হবে তা মারাত্মক হুমকি ।
বৈশ্বিক জলবায়ুর উঞ্চতাও এই বনাঞ্চলের জন্য মারাত্বক হূমকি । বরিল অঞ্চলের উন্নত বিশ্বের কলকারখানা হতে নিশ্বারিত গ্যাসের কারণেও এর অনেক বিরূপ প্রভাব পড়বে বরিল বনভুমির উপরে বিভিন্ন প্রকারে । উদাহরনস্বরূপ বলা যায় বরিল এলাকায় রাশিয়ার রকেট, কৃত্রিম উপগ্রহ ও মিজাইল উৎক্ষেপন কেন্ত্র হতে নি:সারিত আগুনের ধুয়া বরিল বনভুমির গাছের ক্ষতি করছে ব্যপকভাবে । নীচের ছবিতে কিছুটা দেখা যেতে পারে ।
ছবি- ৪৬ : উৎক্ষেপিত রকেট, কৃত্রিম উপগ্রহ ও মিজাইল হতে আগুনের ঘুয়া নি:সরনে বনভুমির ক্ষতির দৃশ্য
শুধু কি তাই, বরিল বনভুমি এলাকায় বৃহদাকারের জল বিদ্যুত প্রকল্প গ্রহণের ফলে সে এলাকার বনভুমি ব্যপকভাবে প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । যেমনটি নীচে দেখা যাচ্ছে ।
ছবি –৪৭ : কানাডার কুইবেকে জলবিদ্যুত প্রকল্পের ফলে সেখানকার ব্যপক এলাকার বনভুমি জলে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য ।
বরিল বনভুমিতে মাঝে মাঝে দাবানলও ঘটে, পুড়ে যায় বনের ব্যপক এলাকার গাছ । এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সে এলাকার গাছ দাবানলে জলে গিয়ে প্রায় ২২৫ বিলিয়ন টন অতিরিক্ত কবর্ন বায়ুমন্ডলে নি:সরন করছে । এর ফলে বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধিও তরান্বিত হচ্ছে ।
বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আমাদের সুন্দর বনের উপরেও পড়ছে । জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের সুন্দরবনের গাছপালা ও জীববৈচিত্রের উপরেও হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব কতৃক সৃষ্ট বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর চিত্রা হরিণ সমৃদ্ধ বিশ্ব হেরিটেজ সুন্দরবন যেন বিপন্ন না হয় তার আবেদন জানাই বরিল বনভুমি সংলগ্ন উত্তর পশ্চিমের সভ্য নামদারী মানব সমাজের কাছে । আমাদের নীজেদেরও সচেতনতার প্রয়োজন আছে ।
ছবি –৪৮ : বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে উদ্ভিগ্ন ও চিন্তিত আমাদের সুন্দর বনের বিপন্ন প্রাণীকুল।
এটা অস্বিকার করার উপাই নাই জীব বৈচিত্রের সকল শাখাতেই আমাদের সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম বন । তাই আমাদের এ বন রক্ষার জন্য বরিল বনভুমির সংরক্ষনও একান্ত প্রয়োজন । উন্নত বিশ্ব নীজেদের স্বার্থে বরিল বনভুমিকে সংরক্ষনের জন্য তাদের ক্ষতিকর কর্মসুচীকে নিয়ন্ত্রন করলে তার সুদুর প্রসারী ফলাফল আমরাও ভোগ করব বিবিধ ভাবে ।
ধন্যবাদ এতক্ষন সাথে থেকে বরিল বনভুমে বিচরণ করার জন্য ।
তথ্য ও ছবিমুত্র : গুগল ইন্টার নেট
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ ভোর ৪:৩১