একটুখানি ভুমিকা
শকুন্তলা ছিলেন হিন্দু পুরাণে বর্ণিত রাজা দুষ্মন্তের স্ত্রী ও সম্রাট ভরতের মা। তাঁর উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে মহাভারতে। মহাকবি কালিদাস তাঁর অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকে এই কাহিনীটি নাট্যায়িত করেন মনোমুগ্ধকরভাবে । প্রায় ষোলশত বছর আগে সংস্কৃতে লিখা এ কাহিনীটিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ সালে প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন ।কালীদাসের শকুন্তলার উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে উপন্যাস , গীতি নাট্য , নৃত্যনাট্য , ও বিভিন্ন ভাষায় সিনেমা । একে ভারতীয় উপমহাদেশের সাহিত্য ও সিনেমার মাস্টার পিছ হিসাবে গন্য করা হয় । বিভিন্ন ভাষাতেও এর রয়েছে অনুবাদ । এদেশে এর বাংলা নাট্যরূপও হয়েছে । কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিন্মরূপ :
ঋষি বিশ্বামিত্রের ঔরসে অপ্সরা মেনকার গর্ভে শকুন্তলার জন্ম । দেবরাজ ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করতে মেনকাকে তাঁর নিকট প্রেরণ করেন। মেনকা তাঁর কাজে সফল হন। তাঁর রূপ ও লাবণ্যের মোহে বিশ্বামিত্র বিচলিত হন। সংযম হারিয়ে তিনি মেনকার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। দীর্ঘকাল এভাবে যৌনসংগম করার ফলে বিশ্বামিত্রের ঔরসে মেনকা গর্ভবতী হন। উভয়ের মিলনে একটি শিশুকন্যার জন্ম হয়। তপস্যার্জিত পুণ্যফল ক্ষয়ের জন্য ক্রদ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র মেনকা ও তাঁর কন্যাকে পরিত্যাগ করে চলে যান। এরপর মেনকাও তাঁর শিশুকন্যাকে একটি বনে পরিত্যাগ করে যান চলে । ঋষি কন্ব সেই কন্যাটিকে পক্ষীপরিবৃত অবস্থায় করেন উদ্ধার। তিনি মেয়েটির নামকরণ করেন শকুন্তলা। এরপর শকুন্তলাকে নিজ আশ্রমে এনে লালন পালন করতে থাকেন।
ছবি -১/১৫ :শকুন্তলার জন্ম - বিশ্বামিত্র কর্তৃক শিশুকন্যাকে প্রত্যাখ্যান, রাজা রবি বর্মা অঙ্কিত।
এর মধ্যে রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়ায় এসে একটি হরিণকে তাড়া করতে করতে কন্বের তপোবনে হন উপস্থিত, এখানেই শকুন্তলার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ । তাঁরা পরস্পরের প্রেমে পড়েন ও আশ্রমেই তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়।বিবাহের পরে তারা কিছুদিন একত্রে সহবাস করেন । এরপর জরুরি কাজে দুষ্মন্তকে রাজধানীতে যেতে হয় ফিরে। যাওয়ার কালে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে একটি রাজকীয় অঙ্গুরীয় দিয়ে কথা দেন আবার আসবেন ফিরে।
এরপর শকুন্তলা অহর্নিশি দুষ্মন্তের কথা ভাবতে থাকেন। একদিন কোপনস্বভাব ঋষি দুর্বাসা কন্বের আশ্রমে এলে শকুন্তলা পতিচিন্তায় মগ্ন হয়ে ঋষিসেবায় করেন অবহেলা । এতে দুর্বাসা ক্রদ্ধ হয়ে তাঁকে দেন শাপ , বলেন যাঁর কথা চিন্তা করতে করতে শকুন্তলা ঋষি সেবায় করেছে অবহেলা , সে শকুন্তলাকে হবে বিস্মৃত । শকুন্তলার সখীরা তাঁর হয়ে ক্ষমা চাইলে দুর্বাসা শান্ত হয়ে তাঁকে ক্ষমা করেন এবং বলেন যদি সেই ব্যক্তির দেয়া কোনো স্মৃতিচিহ্ন শকুন্তলা তাঁকে দেখায়, তবে আবার তিনি শকুন্তলাকে চিনতে পারবেন।
এদিকে দুষ্মন্ত ফিরে আসছেন না দেখে শকুন্তলা নিজেই দুষ্মন্তের রাজধানীর উদ্দেশ্যে করেন যাত্রা। পথে নদীতে স্নান করার কালে দুষ্মন্তের দেওয়া অঙ্গুরীয়টি তিনি হারিয়ে ফেলেন। এরপর অঙ্গুরীয় ছাড়াই দুষ্মন্তের রাজসভায় উপনীত হলে, দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পারেন না। অপমানিতা শকুন্তলা নিভৃত বনে চলে যান । সেখানে জন্ম দেন এক পুত্রসন্তানের। তাঁর নাম হয় ভরত। শৈশবেই ভরত হয়ে ওঠেন অকুতোভয় ও প্রবল পরাক্রমী। ছেলেবেলায় তাঁর খেলা ছিল সিংহকে হাঁ করিয়ে তার দাঁত কপাটি গোনা।
ছবি-২/১৫ : ভরত (সর্বদমন), শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের পুত্র. রবি বর্মা অঙ্কিত
ইতিমধ্যে এক জেলে মাছ ধরতে গিয়ে একটি মাছের পেট থেকে রাজার অঙ্গুরীয়টি উদ্ধার করে। সেটি দেখে দুষ্মন্তের শকুন্তলার কথা মনে পড়ে যায়। তিনি তাঁকে খুঁজতে বের হন। অনেক খুঁজে তিনি শেষে সিংহের সঙ্গে ক্রীড়ারত এক বালকের সন্ধান পান। নাম জিজ্ঞেস করতে ছেলেটি বলে সে দুষ্মন্তের পুত্র ভরত। এরপর ভরত দুষ্মন্তকে শকুন্তলার কাছে নিয়ে যায়। আবার সকলের মিলন ঘটে।
এবার শকুন্তলার নাটকীয় প্রনয়কাহিনীর উল্লেখযোগ্য কিছু অংশের কাব্যিক বিবরণ হলো শুরু ।
শকুন্তলা প্রণয় কাহিণী
পিতা যার ঋষি মাতা যার অপ্সরা
ব্রতভঙ্গে জন্ম আর তপোবনে পালন
সরলতা গভীরতর আর পবিত্রতায় বসবাস
বনের তরুলতা –পশুপাখী সনে তার বিকাশ ।
ছবি-৩/১৫:বনের টিয়াপাখী
চঞ্চল সৌন্দর্যময় তপোবনের পূর্বমিলন হতে
স্বর্গীয় প্রণয়ের আনন্দময় উত্তরমিলনে
এক লোক হতে অন্য লোকে
মঙ্গল সৌন্দর্যের অক্ষয় স্বর্গধামে ।
ফুলকে ফলে ফলায়ন
মর্তের সীমাকে করে লঙ্গন
মাঝে নেই কোন ব্যবধান
নেই বাসনার চিহ্ন বিদ্যমান ।
যৌবন মত্ততার হাবভাব-লীলাচাঞ্চল্য
পরম লজ্জার সহিত অসাধারণ
আত্ম প্রকাশেরই সংগ্রাম
সেখানে শুধু সরলতারই নিদর্শন ।
যুগল বাহু যেন কোমল শাখা
অধর কিসলয় রাঙিমা আঁকা
হৃদয়লোভনীয় কুসুম হেন
তনুতে যৌবন ফুটেছে যেন।
থাকেনা আপনাকে দমন
করে রাখার উপায় গোপন
সেইতো স্বাসত আদি
খাটি প্রেমের লক্ষন ।
যে হরিণী ব্যাধকে চেনে না
তার কি বিদ্ধ হতে বিলম্ব সয় ?
পঞ্চশরকে চিনতে না পারলে
মর্মস্থানতো অরক্ষিতই রয়।
ছবি-৪/১৫: আশঙ্কাহীন চিত্ত
যে ঘন অরণ্যে
সর্বদাই শিকার হয়
সেখানে নিরিহ হরিণীকে
আত্মগোপনতো করতেই হয় ।
যেখানে নর নারীর
সর্বদা সহজেই মিলন
সেখানে নিয়মচারিণীকে সাবধানে
পথ করেতো নিতেই হয় ।
দুষ্মন্তের প্রণয় শর নিক্ষেপ নিদারুণ
প্রণয়ব্যবসায়ে রাজা পরিপক্ক কঠিন
আশ্রম পালিতা বালিকার সরলতা
বড়ই সুকুমার ও সকরুণ।
অশঙ্কিত বনের হরিণীর মত
অসতর্ক শকুন্তলাকেও
পরাভব মেনে সহজেই
হতে হয় দুষ্মন্তে সমর্পিত ।
ছবি-৫/১৫: প্রেমের ভাবনায় সমর্পিত:
মৃগসনে করুণাবাক্য সমাপন
বল্কল-বসনা তাপসকন্যা
সখীসনে আলবালে জলপূরণ
তরু ভগিনীসনে দিবসযাপন ।
পরাভব মেনেও নিয়মচারিণীর
চরিত্রের নির্মল পবিত্রতায়
স্বাভাবিক অক্ষুন্ন সতীত্ব
অনায়াসে পরিস্ফুট ।
নিভৃত পুষ্পপল্লবের মাঝখানে
নিত্য আশ্রমধর্ম অতিথিসেবা
সখীস্নেহ ও বিশ্ববাৎসল্য এখন
শুধুই এক অখণ্ড আনন্দক্ষন ।
আশঙ্কা আঘাতে ভেঙে না যায়
দুষ্মন্তকে তাই সখীগনে কয়
বাণ মারিয়ো না মারিয়ো না
পরিপূর্ণ সৌন্দর্যটি ভাঙিয়ো না।
ছবি-৬/১৫ : বাণ মারিয়ো না
ক্রমে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রণয় প্রগাঢ়
অকস্মাৎ আর্তরব ‘ভো ভো তপস্বিগণ
মৃগয়াবিহারী রাজা দুষ্মন্ত প্রত্যাসন্ন
তপোবনবাসি শকুন্তলার হৃদয় হরণ ।
ছবি-৭/১৫:শকুন্তলার হৃদয় হরণ
দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রেমালাপ
আছে যা তা অতি সংক্ষিপ্ত
অধিকাংশই তাদের
আভাসে ইঙ্গিতেই ব্যক্ত ।
গৃহ কোণে কৃত্রিম
সজ্জিত ফুলের পর
নিত্যই ধুলা তার
না ঝাড়লে চলে না আর ।
বনফুলের ধুলা ঝাড়ার তরে
রাখতে হয় না কোন মালী
অনাবৃতই থাকে সে
ধুলাও লাগে তার গায় ।
নির্মল নিয়মচারিণীর
গায়ে ধুলাও যে লাগে
এ সাধারণ কথাটাও
জানতে পারে না সে ।
তবু সে সযতনে
নীজ অবয়বের
সুন্দর নির্মলতাকে
রক্ষা করেই চলে।
অরণ্যের সরলা মৃগীসম
নির্ঝরের জলধারার মতো
মলিনতার সংস্রবেও সে
অনায়াসেই থাকে নির্মল।
অন্তর মাঝে বিশ্বাসের সিংহাসন
তপোবনে গৃহধর্ম পালনে বিস্মরণ
পতিবিরহে উদাসমনে দুষ্মন্তপ্রতি
চিঠিলিখে করে দিবস যাপন ।
ছবি-৮/১৫ : শকুন্তলার পত্রলিখন
বিরহের কাল কাটেনা আর
তরুলতা-মৃগপক্ষীগনের নিকট
হতে বিদায় লয়ে কাঁদতে কাঁদতে
তপোবন ত্যাগে হয় উদ্ব্যত ।
মৃগের গলি' পড়ে মুখের তৃণ
ময়ূর নাচে না যে আর
খসে পড়ে পাতা লতিকা হতে
যেন সে আঁখিজলধার।
ছবি-৯/১৫: মৃগসাথে করুন হাল
শকুন্তের পতিগৃহে গমনকালে
পদে পদে আকর্ষণ মর্মমুলে
বনের সহিত বিচ্ছেদ বেদনা
মর্মান্তিক অতি সকরুণ ।
ছবি-১০/১৫ :হরিণী শকুন্তলাকে যেতে নাহি দিতে চায়
অপ্রগল্ভা দুঃখশীলা নিয়মচারিণী
সতীধর্মের আদর্শরূপিণী প্রণয়িনী
এক দিকে তরুলতা ফল পুষ্পের ন্যায়
আর দিকে স্বভাব ধর্মের অনুগতা হয় ।
একদিকে অন্তরতর নারীপ্রকৃতি আরদিকে
চরিত্রখানি তার বনছায়া ও মাধবীলতার
সংযত সহিষ্ণু একাগ্র পতিপরায়নতা
কল্যাণধর্মের শাসনে একান্ত নিয়ন্ত্রিতা ।
ছবি-১১/১৫: দুষ্মন্ত-শকুন্তলা প্রণয় লীলা
আদি প্রেমের প্রণয় লীলা
স্বভাব ও ধৈর্যের বাধন
নদী ও সাগর মোহনার
দিকে বেগে ধাবমান ।
ছবি-১২/১৫: দুষ্মন্তের দেয়া স্মৃতি আংটি
শকুন্তকে দেয়া দুষ্মন্তের স্মৃতি আংটি
হারায়ে শকুন্তলার হয় অশেষ দুর্গতি
ঋষি দুর্বাসার শাপে ঘটে অঘটন,বিস্মৃত
দুষ্মন্ত কতৃক শকুন্তলা হয় প্রত্যাক্ষাত ।
ছবি-১৩/১৫: শকুন্তলাকে ঋষি দুর্বাসার শাপ
এখানে হৃদয় অতি কঠিন
সমাজে প্রণয় বড় কুটিল
মিলনের পথও কন্টকাকীর্ণ
বনের সৌন্দর্যও ভাঙ্গে স্বপ্ন ।
দুষ্মন্ত গৃহে শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান
হংসপদিকার সরল করুণ গীত
ভেঙ্গে নামে শকুন্তলার মাথার পর
বাণাহত মৃগীসম বেদনা বিদুর ।
কোথায় তাত কণ্ব
কোথায় মাতা গৌতমী
কোথায় অনসূয়া-প্রিয়ংবদা
কোথায় সেই তরুলতা-পশুপক্ষীগন।
মুহূর্তের প্রলয়াভিঘাতে শকুন্তলার
সুন্দর শান্ত সেই নির্মল জীবন
সে আজ একাকিনী, বৃহৎ শূন্যতাই
হ’ল শকুন্তলার আপন ভুবন ।
ছবি-১৪/১৫ : একাকিনী শকুন্তলা
বিরহ বেদনা স্বভাব ও তপস্যা
সৌন্দর্য ও কঠিনতম সংযম
অশ্রুজলে কলঙ্কক্ষালন শেষে
দীর্ঘ প্রতিক্ষিত একত্র মিলন ।
ছবি-১৫/১৫ :আনন্দঘন মিলন
শকুন্তলায় আরম্ভের সৌন্দর্য তরুন
অত:পর দুঃখ দুর্দশা ধৈর্যে ও ক্ষমায়
মঙ্গলময় চরম পরিণতির সফলতায়
মর্তকে স্বর্গ সুধায় করে আস্বাদন ।
ছবিসুত্র : অন্তরজাল হতে সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০২১ সকাল ৮:২৮