আকাশে চাঁদ নেই তাই তারাগুলো স্পষ্ট জ্বল জ্বল করছে। প্রত্যয় আর শিলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের তারা দেখছে। আকাশে চাঁদ খুঁজে না পেয়ে শিলা বলে উঠল
- আজ আকাশে চাঁদ উঠে নাই
- তোর চাঁদের কথা শুনে একটা মজার কথা মনে পড়েছে। ‘মুন যা বলবে তাই’ আড্ডা গ্রুপের সদস্যরা মিলে বুয়েটের ছাদে একরাতে শুকনা আর হুইস্কি খেয়েছিলাম।খেয়ে সবাই টাল। এরপর আমিন ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আকাশে এত বড় ঐটা কি?আমি বললাম-সূর্য। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-এত তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে গেল! তাহলে চারিদিকে এত অন্ধকার কেন? তিনি কনফিউজড হয়ে রনিকে জিজ্ঞেস করলেন সেও একই উত্তর দিল। বেচারা আমিন ভাই চাঁদ আর সূর্যের পার্থক্য করতে পারলো না, এতটাই টাল হয়েছিলেন।
- হা হা, তোরা বন্ধুরা মিলে আসলেই অনেক মজা করিস। তোর শুকনা আর হুইস্কির কথা শুনে খেতে মনে চাইছে। খাবি?
- এত রাতে এগুলো পাবি কোথায়?
- আমার কাছে আছে।
- এগুলো বাসায় রেখে দিস। বেশ ভালোই সুখে আছিস।
- হা হা, তুই ড্রয়িং রুমে যা আমি নিয়ে আসছি
প্রত্যয় ড্রয়িং রুমে বসে আছে। এর আগে মেয়ে বন্ধুদের সাথে সিগারেট খাওয়া হলেও হুইস্কি আর শুকনা কখনো একসাথে খাওয়া হয়নি। খেয়ে কি হয় কে জানে? এই পর্যন্ত যতবারই খেয়েছে তার কখনো মাতলামি আসেনি।সব সময় ছেলেবন্ধু সাথে ছিল আজ খালি বাসায় সুন্দরী ললনার সাথে খাবে। কোন কেলেঙ্কারি না ঘটলেই হল।সে না করবে কি করে? বিনে পয়সায় মদ কে খেতে দেয় আজকাল?
একটু পরেই শিলা চারটি স্টিক আর আধা বোতল ব্ল্যাক লেভেল নিয়ে এল। প্রত্যয় এর আগে কখনো ব্ল্যাক লেভেল খায়নি, এটা খাওয়ার পর কি হয় কে জানে।
- এগুলো খেয়ে বমি করার অভ্যাস আছে নাকি?
প্রত্যয় বেশ দৃঢ়তার সাথে বলল- আমার এত সহজে বমি হয় না। এই পর্যন্ত এগুলো খেয়ে মাত্র একবার বমি করেছিলাম।
- তাহলে ভালোই। দেখিস আবার ঘর নোংরা করিস না।
- ব্ল্যাক লেভেল! এর আগে কখনো খায় নাই। দাম নিশ্চয়ই ৫০০০ টাকা হবে?
- দাম বিষয় না। খেয়ে দেখ, ভালোই নেশা হবে।
বদ্ধ ঘর। শুকনার ধোঁয়া ঘরেই আঁটকে আছে এর উপর দুই পেগ ব্ল্যাক লেভেল পেটে চালান দেয়া হয়ে গেছে। একজন সুন্দরী মেয়ে তার সামনে বসে আছে, হাতে মদের গ্লাস আর চারদিকে শুকনার গুমোট গন্ধ। জীবনে আর কি চাওয়ার আছে। প্রত্যয় ওময় খৈয়াম এর একটি কবিতা আবৃতি করতে লাগলো-
এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর
প্রিয় সাকি, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার
জীর্ন আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সার্থ
এই যদি পাই চাইব নাকো তখত আমি শাহানশার।
- ভালোই কবিতা আবৃতি করিস
-I am so much happy. Feeling like I am in heaven
- আমি তো সুখে নেই দোস্ত। বিশাল দুঃখ চাপা দিতে এই নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছি
- তোর কিসের দুঃখ? আর তুই এক মাস ক্লাস করে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? তোকে কত খুঁজেছি!
- সব জিনিস যায়নারে বলা। কিছু জিনিস থাকনা গোপন
- তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। তোর চোখগুলো যেন মায়াবি হরিণ মন চাইছে একটু ছুয়ে দেখি। তোর উন্মুক্ত গলাকে মনে হচ্ছে কোলবালিশ মনে চাইছে একটু কামড় বসিয়ে দেই।
- থাম থাম, আর তুলনা দিতে হবে না। তোর ভালোই নেশা শুরু হয়ে গেছে।আমার কেমন যেন মাথা ধরেছে
- আমার কোলে মাথা রাখ আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই
শিলা প্রত্যয়ের কোলে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার কোন খেয়াল নেই আর প্রত্যয় মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কখন যে স্বপ্নের দেশে চলে গেছে তার কোন খেয়াল নেই। স্বপ্নে দেখছে সে আর শিলা একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করছে।তাদের মধ্যে নতুন প্রেম শুরু হয়েছে।ক্লাস শেষে তারা কার্জনের পুকুর পাড়ে বসে প্রেমের গল্প করছে। গল্পের এক পর্যায়ে তুমুল ঝগড়া। শিলা রাগ করে পুকুরে ঝাপ দিল। প্রত্যয় কি করবে বুঝতে না পেরে সেও পানিতে ঝাপ দিল আর তখনই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে জেগে দেখে শিলা তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।এরপর ঘড়ির দিকে তাকাতেই সে ওহ শিট বলে উঠল।সকাল দশটা বাজে তার সাড়ে এগারোটার দিকে ক্লাস আছে। শিলার বাসা থেকেই ফ্রেশ হয়ে সে শিলাকে ডাক দিতে লাগলো কিন্তু শিলার কোন হুশ নেই। সে মরার মত ঘুমাচ্ছে। তার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তার মুঠোফোনে একটা এসএমএস করে প্রত্যয় সেখান থেকে সরাসরি ক্যাম্পাসে চলে গেল।
সাইকেল চালানোর সময় তার বেশ ফুরফুরে লাগছিল। গতকালকের রাত আসলেই অনেক ঘটনাবহুল ছিল। এই রাতের কথা সে সহজেই ভুলতে পারবে না। এতদিন পর পুরোনো এক বন্ধুর খোঁজ সে পেয়েছে এই কথা ক্লাসে বন্ধুদের বললে তারা বেশ খুশি হবে। ক্লাসে ঢুকেই সে তার বান্ধবী মুনিয়াকে বলল
- জানিস গতকাল রাতে কার সাথে দেখা হয়েছিল?
- কার সাথে?
- শিলার সাথে
- কোন শিলা?
- তুই শিলাকে চিনছিস না, ঐ যে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে সে মেয়ে একমাস ক্লাস করে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।
মুনিয়া বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- তুই কি রাইসার কথা বলছিস?
- ও হ্যা, ভুলেই গেছি ওর ভালো নাম রাইসা রফিক।
মুনিয়া প্রত্যয় এর গায়ে চিমটি কাটলো এরপর নিজের গায়েও চিমটি কাটলো।
- এই তুই চিমটি কাটছিস কেন?
- দেখলাম কে স্বপ্নের জগতে আছে?
- শালী, স্বপ্ন হতে যাবে কেন? ওর সাথে রাতে একসাথে খেলাম
- তুই কি গাঁজা খেয়েছিস? কি সব গাজাখুরি কথা বলছিস। রাইসা আসবে কোথা থেকে?
- গাঁজা অবশ্য গতকাল খেয়েছি কিন্তু গাঁজাখুরি হতে যাবে কেন? রাইসা মানে শিলা এখন ঢাকায়
মুনিয়া তোতলাতে তোতলাতে বলল- তুই বুঝতেছিস না।
এবার প্রত্যয় বেশ বিরক্ত হয়ে বলল- এই তোর সমস্যা কিরে? পাঁচ বছর পর এক বন্ধুর সাথে দেখা কোথায় খুশি হবি, ও কেমন আছে জিজ্ঞেস করবি তা না করে প্যান প্যান করছিস।
মুনিয়া আবারো তোতলাতে তোতলাতে বলল- প্রত্যয়, শিলা তিন বছর আগেই মারা গেছে।
- হা হা, এবার মনে হচ্ছে তুই গাঁজাখুরি গল্প বলতেছিস।
- গাঁজাখুরি নয় প্রত্যয়। শিলা বিয়ে করে বিদেশে চলে গিয়েছিল সেখানেই সে আত্মহত্যা করে মারা যায়।
- থাম, থাম আর গাঁজাখুরি গল্প বলতে হবে না।শিলার কিছুই হয়নি। আর শিলা মারা গেলে আমি জানতাম না? তোরা জানিস মারা গেছে আর আমি জানি না
- ও যখন মারা যায় তখন তুই কুমিল্লায় ছিলি। তোকে কেও জানায়নি কারন সবাই জানত তুই শিলাকে পছন্দ করতি। ওর মৃত্যুর খবর শুনলে কষ্ট পাবি দেখে তোকে জানানো হয়নি। কিন্তু তুই যে শিলার ভূতের সাথে একসাথে নৈশভোজ করবি তা কে জানত।
- হয়েছে, আর লেইম গল্প বানাতে হবে না। আমি ফোন দিচ্ছি তুই শিলার সাথে কথা বল।
আমি যা বলছি সত্যি বলছি। শিলা আর নেই সে মারা গেছে। তোর ভুল ভাঙ্গানো দরকার। আচ্ছা ফোন দে, আমি কথা বলি।
প্রত্যয় ফোন বের করে শিলার নাম্বারে ফোন দিল। সাথে সাথে ঐপাশ থেকে শোনা গেল- আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এখন বন্ধ আছে।
- কাজের সময় মোবাইলে কাউকে পাওয়া যায় না। আসার সময় দেখে এসেছিলাম ঘুমাচ্ছে। মনে হয় এখনো ঘুমাচ্ছে আর মোবাইলে চার্জ নেই
- দেখে এসেছিলাম মানে?
- ওর বাসায় রাতে ছিলাম
মুনিয়া বুকে থু থু দিয়ে বলল- তুই এক ভূতের সাথে রাত কাটিয়েছিস। কিছু করিসনি তো আবার?
- দেখ সব সময় মজা ভালো লাগে না। ক্লাস শেষে আমার সাথে চল। শিলার বাসায় তোকে নিয়ে যাব।
- তারপরেও তুই আমার কথা বিশ্বাস করবি না? আচ্ছা ঠিক আছে তোর সাথে যাব
ক্লাস শেষে প্রত্যয় আর মুনিয়া চলল শিলার বাসায়। প্রত্যয় বেশ অবাক। সে চিন্তা করতে লাগলো মুনিয়া কি তাকে এপ্রিল ফুল বানাতে চাইছে কিনা? এটাতো মে মাস। এপ্রিল মাস অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। প্রত্যয় মনে মনে হাসলো- শিলাকে দেখে মুনিয়া বড় রকম ধাক্কা খাবে। শিলাকে প্রথম দেখায় চিনবে কিনা কে জানে? ওর অনেক পরিবর্তণ এসেছে। শিলা আর সেই লাজুক মেয়েটি নেই।
মিরপুর আরামবাগ আবাসিক এলাকার সেই ছয়তালা বাড়ির সামনে এসে প্রত্যয় একটু পরিবর্তণ দেখতে পেল। গতকাল বাড়ির গেইটে দারোয়ান ছিল না এমনকি আজ সকালেও দারোয়ান ছিল না। হঠাৎ করে দারোয়ান এর আবির্ভাব হল কি করে? বাড়ির গেইটের সামনে আসতেই দাড়োয়ান জিজ্ঞেস করলো
- আসসালামু আলাইকুম। কার কাছে যাবেন?
- চার তালায় যাব। শিলার কাছে
- চার তালায় কেউ তো থাকে না। ঐ ফ্লাট তালা দেয়া।
- মানে? আমি গিয়ে দেখতে চাই।
- না স্যার, অপরিচিত মানুষকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি নাই। আপনারা আসতে পারেন।
মুনিয়া প্রত্যয় এর কাছে এগিয়ে এসে বলল- এখান থেকে চল। এবার নিশ্চয়ই তোর ভুল ভেঙ্গেছে। তোর আবার মদ গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস আছে। সেখান থেকে হয়ত হেলুসিনেশন হয়েছে।
প্রত্যয় বেশ খেপে গেল- হোয়াট? হেলুসিনেশন? আমার সাথে মজা নিস?
প্রত্যয় আবারো শিলার নাম্বারে ফোন দিল আবারো সেই একই কথা শোনা গেল। সে ঘটনা মিলাতে পারছে না। গতকাল সে শিলার সাথে ব্ল্যাক লেভেল খেল, শুকনা খেল। ব্ল্যাক লেভেলের সেই স্বাদ তার এখনো মনে আছে। এরপর লেবু দিয়ে ইলিশ মাছের ডিম এর স্বাদ। সে তাহলে গতকাল কার বাসায় ছিল?
এভাবে দুইদিন কেটে যাবার পরেও সে এই ঘটনার কোন কূল কিনারা করতে পারেনি।কাউকে বলতেও পারছে না এই ঘটনা। সবাই শুনলে মুনিয়ার মত মজা নেয়া শুরু করবে। মামা, তুমি এক ভূতের সাথে রাত কাটাইছো। কি কি করলা তার সাথে? প্রত্যয় মুনিয়াকে হাত জোড় করে অনুরোধ করেছে এই ঘটনা কারো সাথে শেয়ার করতে না। না হলে সবাই মজা নেয়া শুরু করবে।
এভাবে আরও দুইদিন কেটে যাবার পর চতুর্থ দিনের মাথায় একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এল। প্রত্যয় নাম্বার এর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনটি রিসিভ করতেই ঐপাশ থেকে পরিচিত কন্ঠে ভেসে এল
- এই প্রত্যয় তুই আজ রাতে আমার বাসায় খা। রুই মাছের মুড়িঘণ্ট করছি আজকে।
প্রত্যয় ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল- শিলা তুই?
- হুম শিলা, তোর গলা কাঁপছে কেন?
- তুই নাকি মারা গেছিস?
- কি সব গাঁজাখুরি কথা বলছিস। আজ গাঁজা খেয়েছিস নাকি?
- না
- তাহলে? বাসায় আয়, তারপর তোর গাঁজাখুরি গল্প শুনবো।
প্রত্যয় এর শরীরে ঘাম ঝড়ছে। গত চারদিন সে আগের নাম্বারে ফোন করেও শিলাকে পায়নি আজ অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিল। কেন এটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে। আজ রাতে কি সে শিলার সাথে দেখা করতে যাবে? রুই মাছের মুড়িঘণ্ট দিয়ে কি ভাত খাবে? শিলা মারা গেছে এটা জানার পর থেকে তার ভেতর কেমন যেন ভয় ঢুঁকে গেছে। শিলাকে সে একসময় পছন্দ করত এটা সত্যি কিন্তু কোন ভূতের সাথে সে প্রেম করতে পারবে না। প্রত্যয় মোবাইল বন্ধ করে ফ্রিজ থেকে রুই মাছ বের করল। আজ সে নিজেই রুই মাছের মুড়িঘণ্ট রেঁধে খাবে।
------------- সমাপ্ত ------------
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৩