ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার অনুমতি দিতে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপক চাপের মধ্যে রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা। বাংলাদেশ সরকার কোনো স্পষ্ট আশ্বাস না দিলেও এ বিষয়ে সংসদীয় সমর্থন তৈরি করতে রাজি হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। এ-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি গত মাসের শেষ ভাগে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে সুপারিশ করে।
জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা এবং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের কথা ওয়াশিংটনকে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। ঢাকা থেকে পাঠানো তাঁর সেই গোপন বার্তা প্রকাশ করে দিয়েছে উইকিলিকস। মরিয়ার্টির পাঠানো কয়েকটি বার্তা নিয়ে গত দুই দিনে তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান।
একটি বার্তা থেকে জানা যায়, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থাকলেও বাংলাদেশের এই এলিট ফোর্সকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। মরিয়ার্টি তাঁর সরকারকে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে র্যাব যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের মতো একটি সংস্থায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। অন্য একটি বার্তায় বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী আঞ্চলিক কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রম পরিবর্তনে একসঙ্গে কাজ করছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে 'ভারত-ঘনিষ্ঠতার' প্রচার সম্পর্কে ভারত যে সচেতন-সে বিষয়েও নিজের সরকারকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মরিয়ার্টি।
কয়লা খনি নিয়ে চাপ
গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির কয়লা প্রকল্প গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্টের (জিসিএম) বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভ হয়। সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে অন্তত তিনজন নিহত ও বহু লোক আহত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ওই খনি বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ফুলবাড়ী কয়লা খনি বন্ধ করে দেওয়ার পরও জিসিএম বাংলাদেশে বহাল তবিয়তে কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে এবং সরকারের ওপর-মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ফুলবাড়ী খনি আবার খুলে দিয়ে জিসিএমের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন চালানোর অনুমতি দিতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরাও।
একটি বার্তা থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গত বছর জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলাই সবচেয়ে ভালো হবে।
ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় মরিয়ার্টি লিখেছেন, ফুলবাড়ী কয়লা খনিতে সম্পৃক্ত এশিয়া এনার্জির ৬০ শতাংশ বিনিয়োগই যুক্তরাষ্ট্রের।
তারবার্তায় তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, নিপীড়িত ও অবহেলিত আদিবাসীদের এলাকায় অবস্থিত বলে ফুলবাড়ী কয়লা খনি রাজনৈতিকভাবে খুবই স্পর্শকাতর একটি ইস্যু। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বৈঠকে এ বিষয়ে মরিয়ার্টির সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেন এবং উন্মুক্ত পদ্ধতির পক্ষে সংসদীয় সমর্থন তৈরির ব্যাপারে সম্মতি দেন।
গার্ডিয়ান লিখেছে, ফুলবাড়ী প্রকল্পে কী পদ্ধতিতে খনন চলবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার এখনো স্পষ্ট কোনো আশ্বাস দেয়নি। তবে চলতি মাসের শুরুতে জিসিএমের চেয়ারম্যান স্টিভ বাইওয়াটার বলেন, বাংলাদেশের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য সুপারিশ করেছে। জিসিএম কর্মকর্তারা আশা করছেন, সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়ে দেবে।
র্যাবের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রশিক্ষণ
উইকিলিকসে প্রকাশ করা একটি বার্তায় বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তোপের মুখে থাকা র্যাবকে যুক্তরাজ্য সরকারের উদ্যোগে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
ওয়াশিংটনে মরিয়ার্টির পাঠানো ওই বার্তার ভিত্তিতে 'বাংলাদেশি ডেথ স্কোয়াড ট্রেইনড বাই ইউকে গভর্নমেন্ট’ শিরোনামের প্রতিবেদনে গার্ডিয়ান লিখেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিচারবহির্ভূতভাবে প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে র্যাবের বিরুদ্ধে। র্যাবের পক্ষ থেকে গত মার্চে জানানো হয়, বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে 'ক্রসফায়ারে' এ পর্যন্ত ৫৭৭ জন নিহত হয়েছে।
একটি তারবার্তায় দেখা যায়, মানবাধিকার ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে র্যাবকে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়নি ওয়াশিংটন। তারা মনে করে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। ফলে তাদের এ বাহিনীকে অন্য কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনের লঙ্ঘন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তাঁর সরকারকে জানিয়েছেন, তিনি র্যাব ভেঙে দেওয়ার পক্ষে নন।
চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি পাঠানো তারবার্তায় সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগ প্রসঙ্গে মরিয়ার্টি বলেন, বাংলাদেশে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। মরিয়ার্টি তাঁকে বলেছেন, সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের সময় গঠিত র্যাব ভেঙে দেওয়া শেখ হাসিনা সরকারের উচিত হবে না। পিনাক রঞ্জনও এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছেন।
র্যাবের ভূয়সী প্রশংসা করে মরিয়ার্টি ওই বার্তায় লিখেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে র্যাব যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের মতো একটি সংস্থায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে অন্য একটি বার্তায় মরিয়ার্টি তাঁর সরকারকে জানান, ব্রিটিশ পুলিশের বিশেষ বিভাগ ন্যাশনাল পুলিশিং ইমপ্রুভমেন্ট এজেন্সির (এনপিআইএ) কর্মকর্তারা ১৮ মাস ধরে র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা গার্ডিয়ানকে বলেন, মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি ছিল তাঁদের প্রশিক্ষণের বিষয়। তবে এ বিষয়ে র্যাবের প্রশিক্ষণবিষয়ক প্রধান মেসবাহউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, মানবাধিকার বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণের তথ্য তাঁর জানা নেই। তবে প্রশিক্ষণে সহায়তার বিষয়ে যুক্তরাজ্যে পররাষ্ট্র দপ্তরের বক্তব্য, তাদের দেশের আইন মেনেই সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার পরিবর্তনে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র
সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রম পরিবর্তনে একসঙ্গে কাজ করেছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ (ডিএফআইডি) মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রম পরিবর্তন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করে। এক তারবার্তায় জেমস এফ মরিয়ার্টি বলেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের অংশ হিসেবেই এ প্রকল্প পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশের অনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোর জন্য একটি 'মানসম্মত' পাঠক্রম তৈরি ও প্রয়োগের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কিভাবে দেওয়া হবে তা দুই দেশের সমন্বিত পরিকল্পনায় আছে বলেও মরিয়ার্টি তাঁর বার্তায় জানান। এর আগে একই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের একটি প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়।
শেখ হাসিনার 'ভারত-ঘনিষ্ঠতার'
প্রচার সম্পর্কে সতর্ক ভারত
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে 'ভারত-ঘনিষ্ঠতার' যে প্রচার রয়েছে, সে বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন ও সতর্ক ভারত সরকার। গত বছর ১৪ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি এক তারবার্তায় ওয়াশিংটনকে জানান, এই সতর্কতা থেকেই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথ টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে শেখ হাসিনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানায় ভারত।
মরিয়ার্টি তাঁর বার্তায় লিখেছেন, 'পিনাক (ভারতীয় হাইকমিশনার) বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথ টাস্কফোর্স গঠনে হাসিনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। ভারত দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড চায়। তবে বাংলাদেশ যে এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠনের আগ্রহ দেখাবে-ভারত সেটাও বোঝে। ...এর ফলে হাসিনার বিরুদ্ধে ভারত-ঘনিষ্ঠতার যে প্রচার রয়েছে, সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারবেন তিনি।'
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ে মরিয়ার্টির কাছে আনন্দ প্রকাশ করেন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। তিনি জানান, বাংলাদেশের নতুন (আওয়ামী লীগ) সরকারের সঙ্গে নিরাপত্তা ও অন্যান্য ইস্যুতে সম্পর্কের উন্নয়ন চায় ভারত।
ঐতিহাসিকভাবে নয়াদিল্লির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক রয়েছে বলেও তারবার্তায় উল্লেখ করেন মরিয়ার্টি।
সূত্র কালের কণ্ঠ ডেস্ক