যুদ্ধাপরাধের বিচারঅবস্থান পাল্টাচ্ছে বিএনপি! আবদুল্লাহ আল ফারুক
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান। এই বিচারের পক্ষে দলটি কখনো সোচ্চার না থাকলেও সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। কিন্তু ইদানীং দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তব্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। এ নিয়ে দলের ভেতরেও দেখা দিচ্ছে ব্যাপক মতবিরোধ। বিশেষ করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই বিরোধ জোরদার হয়েছে। বিএনপির মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, সরকার বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ফাঁদ পেতেছে। আর সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। সরকারের এই উদ্যোগে প্রথমেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে বিএনপি। এ নিয়ে অনেক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করবে না। তবে দল থেকে দাবি তোলা হয়, এই বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনসহ দলের প্রায় সব নেতাই এ ধরনের অভিমত দিয়ে বক্তব্য দেন। এমনকি চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ সিনিয়র পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পরও বিএনপি নীরব ছিল। কিন্তু গত ১৬ ডিসেম্বর ভোররাতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপি মহাসচিবসহ দলের কোনো কোনো নেতার বক্তব্যের ধরন পাল্টে গেছে। খোন্দকার দেলোয়ার বলেছেন, '৪০ বছর পর কেন এ বিচার? এর আগেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তখন বিচার করেনি। তারাই ১৯৫ জন মূল যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়েছিল। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিরোধী দলকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তারা। বিরোধী দলের নেতাদের মেরে ফেলার জন্য এই কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।' তাঁর এই বক্তব্য বিএনপির অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
খোন্দকার দেলোয়ারের ওই বক্তব্যের পর গত শুক্রবার দুপুরে তাঁরই সভাপতিত্বে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি যৌথ সভা করা হয়। সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সেই সভা থেকে চট্টগ্রামে ডাকা অর্ধদিবস হরতালকে পূর্ণদিবসে রূপ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ঢাকাসহ সারা দেশে দুদিনের বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপির বর্তমান অবস্থানকে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে মনে করেন কি না। জবাবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অবশ্যই তিনি মনে করেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে হবে। না হলে আইনের শাসন কায়েম হবে না। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তিনি রাজাকার। তিনি আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। বিএনপি যদি তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, হরতাল-বিক্ষোভ করে, তাহলে তো তাদের রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারি।'
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাকা চৌধুরীর মতো একজন আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ নিয়ে বিএনপি প্রমাণ করেছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপি বিচারের আগেই ট্রাইব্যুনাল ও বিচারকদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এতেও স্পষ্ট হয়, তারা এই বিচারপ্রক্রিয়াকে মানতে চাইছে না।' তিনি আরো বলেন, 'গোলাম আযম অনেক বড় রাজাকার। কিন্তু সেই সময় সাকা চৌধুরী ও তাঁর বাবা ফকা চৌধুরী গং অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। তারাই শান্তি কমিটি গঠন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি এসব অস্বীকার করে তার পক্ষ নিয়ে নিজেরাই বিচারক সাজছে।'
জানা গেছে, সাকা চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপির একাংশের তৎপরতা নিয়ে দলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সমালোচক অংশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে না যায়, তাহলে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করার পর এমন প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে কেন? জবাবে সাকা চৌধুরীর পক্ষের অংশটি বলছে, তাঁকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
বিএনপির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, মহাসচিবসহ একদল নেতা অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ঢাকায়ও হরতাল ডাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু দলের বড় একটি অংশ এর বিরোধিতা করায় সে চেষ্টা সফল হয়নি। এমনকি ওই নেতাদের চাপে পড়ে যাতে হরতাল ডাকতে না হয়, সে জন্য দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও চীন সফরে যাওয়ার আগে দুদিন গুলশানে তাঁর অফিসে যাননি। এ ক্ষেত্রেও সাকাবিরোধী গ্রুপের চেষ্টা ছিল।
এদিকে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গত রবিবার ঢাকার মুক্তাঙ্গনে যে সমাবেশ করা হয়েছে, সেখানে অনেক নেতা অংশ নেননি। অনেকে সমাবেশে এসে হাজিরা অথবা বক্তব্য দিয়েই চলে যান। বিএনপির এটা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলেও স্থায়ী কমিটির ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ প্রভাবশালী নেতারা অনুপস্থিত থাকেন। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ মহানগর নেতাদের অধিকাংশও ওই সমাবেশে ছিলেন না।
সূত্র জানায়, সাকা চৌধুরীকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করা নিয়েও প্রশ্ন আছে দলের ভেতরে। তাঁকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করার আগে অনেকে আপত্তি করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে কথা আসবে। তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে। তখন দলের চেয়ারপারসন বলেছিলেন, তাঁকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হবে না। কিন্তু রহস্যজনক কারণে হঠাৎ করেই তাঁকে সদস্য করা হয়। এর আগে তিনি দলের কোনো পদে ছিলেন না। দলের অনেকে মনে করেন, অদৃশ্য চাপে তাঁকে স্থায়ী কমিটির সদস্য বানানো হয়েছে।
এ ছাড়া বিএনপির গঠনতন্ত্রেও উল্লেখ আছে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার বিরোধী কোনো ব্যক্তিকে' সদস্যপদ দেওয়া হবে না।
বিএনপির বর্তমান অবস্থানকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বলে ব্যাখ্যা করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে বিএনপি মহাসচিব যে কথা বলেছেন, তাতে প্রমাণিত হয় তারা প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল করতে তারা ষড়যন্ত্র করছে।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসের আলোচনা সভায় বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে প্রতিষ্ঠা করাই বিরোধী দল বিএনপির প্রধান কাজ। তিনি বলেন, জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করছেন। তাদের দিয়ে খালেদা জিয়া হরতাল ডাকাচ্ছেন এবং তাতে সমর্থন দিচ্ছেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'স্পর্শকাতর এ বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কী ঘটছে তা সবাই দেখছেন।' তবে একটি রাজনৈতিক দলের নেতার সৌদি আরব ভ্রমণের পর থেকে তাঁর কাছে পরিস্থিতি ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। এই বিচার আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে তাঁর সংশয় দেখা দিচ্ছে। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা উচিত। কারণ এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে মানুষের মনোভাব খুব দ্রুত বদলায়।'
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, 'বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে তাঁরাই বলবেন। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সব দলেরই মেনে নেওয়া এবং সরকারকে সহায়তা করা উচিত।'
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে কি না বা সরকারের পাতা ফাঁদে বিএনপি পা দিচ্ছে কি না, জানতে চাওয়া হলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর গঠিত দল বিএনপি। এ দল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নয়। এর পরও আওয়ামী লীগের নেতারা বলে যাচ্ছেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। তাঁদের এ ধরনের কথা থেকেই বোঝা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়। বিরোধী দলকে ধ্বংস করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলে তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের কথা, এ বিচার যাতে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয়।
সংবাদ --কালের কন্ঠ