সাহেপ্রতাপ মোড়ের একটা রেষ্টুরেন্টে প্রতিদিন রাত দশটার পর রমিজ রাতের খাবার খেতে আসে। বাজারের শেষ মাথায় রমিজের অফিস। সেই অফিসের কম্পাউন্ডেই রমিজ থাকে। সাহেপ্রতাপ মোড়টা খুবই ব্যস্ততম একটা মোড়। মোড় থেকে পূব দিকে নরসিংদী শহরের দিকে একটা মহাসড়ক চলে গেছ এবং একটা উত্তর দিকে সিলেট অভিমুখে। ঢাকায় আসা যাওয়ার জন্য কিশোরগঞ্জ,সিলেট,বি-বাড়িয়া সহ অনেকগুলো জেলার গাড়ী এই পথ ব্যবহার করে। লোকাল রুটের অনেক যাত্রিবাহী বাস এখানে এসে থামে। তবে দুরপাল্লার বাস খুব প্রয়োজন না হলে এখানে থামে না। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা এই মোড়টায় পুলিশের ডিউটি থাকে।
এই রেষ্টুরেন্টের কারনেই হায়দার আলীর সাথে রমিজের পরিচয় বন্ধুত্ব সবকিছু। হায়দার আলী পুলিশের কনষ্টেবল। ভেলানগরে বাসা ভাড়া করে হায়দার আলী দুই ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে থাকে। কনষ্টেবল হলেও এ যাবৎ বদলী হওয়া সব কর্মস্থলেই পরিবার নিয়ে থেকেছে। সেসব ফেলে আসা কর্মস্থলে তার অনেক কড়া-মিঠা স্মৃতি রমিজের সাথে দেখা হলে শেয়ার করে হায়দার আলী। হায়দারের গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহনে। সেই ২০০৪ সাল থেকে রমিজের সাথে তার বন্ধুত্বের পথচলা।
রমিজ ২০০৬ সালে নতুন কোম্পানীর চাকরী নিয়ে ঢাকায় চলে আসার কয়েক মাস পর হায়দার আলীও বদলী হয়ে যায় মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানায়। তবুও যোগাযোগ আর সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে এখনো টিকে আছে।
সেই উনিশ বছর বয়সে পুলিশের কনষ্টেবলের চাকরীতে যোগ দিয়েছিলো হায়দার আলী। ভালো মন্দ বহু মানুষের সংশ্রব পেয়েছে কিন্তু কোন দিন ঘুষ খায়নি বা কোন কোন দুর্নীতিতেও জড়িয়েও পড়েনি অথচ রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, বাসে-ট্রেনে চলাচলের সময় পুলিশের প্রতি সাধারন মানুষের কি পরিমান নেতিবাচক ধারনা আর গালাগাল আছে তা নির্মম ভাবে সহ্য করেছে।
বাইশ বছর বয়সে রাহেলা’কে বিয়ে করেছিলো। বিয়ের দুই বছরের মাথায় প্রথম সন্তান হয়েছিলো তার দুই বছর পর আরেকটা। মাঝে মাঝে হায়দার আলী ভাবে সময় কতো দ্রুত চলে যায়। বড় ছেলেটাও এসএসসি পাশ করে এখন কলেজে পড়ে। আর ছোটটা এবার ক্লাস নাইনে। এখন তার পোষ্টিং সৈয়দপুরে।
গত কয়েক দিন ধরে কোন কিছুই ভালো মতো খেতে পারছেনা হায়দার। কারন সৈয়দপুরের খরখড়িয়া নদীর পাড় থেকে একটা গলিত লাশ উদ্ধারের পর থেকে যা কিছু খেতে যাচ্ছে তখন সেই গলিত লাশের বিভৎস ছবি আর সেই দুর্গন্ধ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এ রকম সমস্যা আগেও অনেকবার হয়েছে। মরা পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত লাশ, এ্যাকসিডেন্টে একপাশ থেতলে যাওয়া লাশ নিজের হাতে ধরে তুলতে হতো এবং তা কাটিয়ে উঠতে অনেক দিন লেগে যেতো।
হায়দারের বড় ছেলেটা নিয়ে তার খুব দুশ্চিন্তা হয়। ছেলেটা কেমন মনমরা দিয়ে থাকে সারাক্ষন। ওর তেমন বন্ধুবান্ধবও নেই। ক্লাস ওয়ান থেকে এসএসসি পর্যন্ত পাঁচটা স্কুলে তাকে পড়তে হয়েছে। প্রথম যখন হাই স্কুলে ওঠে তখন হায়দার আলীর বরিশালে পোষ্টিং ছিলো। বরিশাল জিলা স্কুলে পড়তো ছেলেটা। স্কুলের সহপাঠিরা তাকে ‘ঠোলা’র পোলা’ বলে ক্ষ্যাপাতো। এটা নিয়ে অনেক দিন হাতাহাতিও হয়েছে। ক্লাশ এইটে ওঠার পর বদলী হয়ে খুলনায় এসে নিউজ প্রিন্ট মিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলো। সেখানেও একই দৃশ্য। সহপাঠিদের টিটকারি একসময় গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। হায়দার আলী ভাবে হয়তো ওসব কারনে ছেলেটার আজ মনের এই অবস্থা।
রাহেলা বেগম গরীব ঘরের মেয়ে। চাকচিক্যহীন সাদা সিধা জীবনেই সে অভ্যস্থ এবং স্বাচ্ছন্দ। স্বামীর কাছে তার বিশেষ কোন চাহিদা নাই, কোন অনুযোগ কোন অভিযোগও সে কোনদিন করেনি। হায়দার আলী ভাবে রাহেলার এই মিতব্যায়ী জীবন যাপনের জন্যই সংসারে শত টানাটানির মধ্যেও সে সৎ থাকতে পেরেছে। পুলিশের বৌ হিসাবে পাড়াপড়শীর কতো বাঁকা কথাও কতো সময় শুনতে হয়েছে। অনেক ওসি দারোগা সাহেবদের বৌদের গা ভর্তি গহনা দেখেও কোনদিন লোভ হয়নি রাহেলার। বরং কোন কোন অনুষ্ঠানে গিয়ে শুনতে হয়েছে ভাবী আপনার গলা, হাত খালি কেন? ‘নাহ! আমার গহনা পরতে ভালো লাগেনা’ এমন উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে। তবে রাহেলা বেগমের একটাই আক্ষেপ তার স্বামীকে দিয়ে প্রায় সব ওসি দারোগারাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজ করিয়ে নিয়েছে বা এখনো করায়। সাপ্তাহিক কোন ছুটির দিনেও তার স্বামীকে সেই উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের ফরমায়েশ খাটতে হয়।
সৈয়দপুর আসার আগে হায়দার আলী ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে ছিলো তিন বছর। প্রচন্ড রোদ, প্রবল বৃষ্টি আর তীব্র শৈত্য প্রবাহেও ট্রাফিকের দ্বায়ীত্ব পালন করতে হতো। শীত কালে ঢাকার রাস্তার প্রচন্ড ধুলোবালি আর কালো ধোঁয়ায় এ্যাজমার সমস্যা বেড়ে যেতো। পকেটে সবসময় ইনহেলার রাখতে হতো। আর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোমড় আর মেরুদন্ডে ব্যাথা হয়ে যাবার কথা জানাতো রাহেলাকে। বলতো একটু গরম পানির ছ্যাঁকা দিতে পারলে তার আরাম লাগতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক আর মানব সৃষ্ট দুর্যোগই হোক ডিউটি থেকে কোন রেহাই মিলতো না। একবার ফার্মগেটের ট্রাফিকে উল্টোপথে আসা গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র দেখতে চাওয়ার পর তার চাকরি নিয়েই টান পড়ে যায় যায় অবস্থা হয়েছিলো। প্রভাবশালীদের গাড়ি বলে কথা। সেদিন হায়দার আলী বুঝেছিলো প্রভাবশালী থেকে সাধারন মানুষ সবাই এ দেশে আইন না মানা গর্বের বিষয় বলে মনে করে। সে সময় রাহেলা বেগমের খুব টেনশন হতো স্বামীকে নিয়ে।
এ্যজমা বেড়ে একবার এতো খারাপ অবস্থা হলো যে কাঁশির সাথে রক্ত চলে আসতো। যক্ষা সন্দেহ করে ডাক্তার যক্ষার টেষ্ট করিয়েছিলো কিন্তু যক্ষা ধরা পড়েনি। তখন ডাক্তার বলেছিলো ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে। দির্ঘদিন ঔষধ খেতে হবে। দুই মাস সে ঔষধ খাবার পরও কোন উন্নতি না হওয়ায় ভারতে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হয়েছিলো। ভারতের ডাক্তার ক্যান্সার সন্দেহ করে অনেক পরিক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলো না ক্যানসারের পর্যায়ে যায়নি তবে আরএকটু দেরি করলে হয়তো সে পর্যায়ে চলে যেতো। অবশেষে মাদ্রাজে থেকে দুই মাস নিয়মিত ডাক্তারের ফলোআপ আর ঔষধে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। এই জন্য বহু টাকা খরচ করতে হয়েছে। আর সেই টাকা যোগাড় করতে হায়দার আলীর বাবার এক বিঘা ধানের জমি বিক্রি করতে হয়েছে। সেই অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর হায়দার আলী সৈয়দপুরে বদলী হয়েছিলো।
অক্টোবর মাসে শুক্রবারের ছুটি সাথে দুইদিন বাড়তি ছুটি নিয়ে রমিজ পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় কাঞ্চনজংগা দেখতে গিয়েছে একটা ট্যুর গুরুপের সাথে। ওখান থেকে সৈয়দপুরে গিয়ে হায়দার আলীকে একটা সারপ্রাইজ দিলো রমিজ। রমিজকে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছে হায়দার আলী। অনেক কথা জমানো আছে। সেই কবে নরসিংদী থাকতে একবার এক বিকেলে সোনা মুখির ট্যাকে বেড়াতে গিয়েছিলো তার পর আর কোথাও একসাথে বেড়ানো হয়নি। সেদিন যেতে যেতে রমিজ বলেছিলো;
- জানেন হায়দার ভাই, পুলিশ আর কয়ড়া টাকা ঘুষ খায়। সিটি কর্পোরেশন, রেল, গনপূর্ত, শিক্ষা,স্বাস্থ্য, কাস্টম অফিস, ইনকাম ট্যাক্সের অফিস, ভূমি অফিস, আর সাব রেজিস্টার অফিসে যে ঘুষের লেনদেন হয় তার কাছে তো পুলিশের ঘুষ নস্যি। অথচ পাবলিক শুধু পুলিশের ঘুষ নিয়া ফাল পাড়ে।
সেদিন সেই কথা এখনো তার কানে বাজে। দুই একটা আড্ডায়ও রমিজের এই কথা সে কোট করেছে।
একদিন পর সৈয়দপুরে থেকে রমিজ আবার ঢাকায় ফিরে চলে এসেছে।
রমিজ চলে যাবার দুই দিন পরের ঘটনা। ঐ দিন বিকেলের পালায় হায়দারের টহল ডিউটি ছিলো। বিকেল তিনটার পর থেকে তার ডিউটি শুরু রাত পর্যন্ত। বিকেল পাচটার দিকে শহরের মুন্সিপাড়ার মোড়ে টহল ভ্যান এসে দাড়িয়েছে। এমন সময় হঠাৎ ভোলা থেকে হায়দারের বড় বোনের মোবাইল কল। রিসিভ করতেই ও প্রান্ত থেকে কান্নার আওয়াজ।
- ও ভাইরে! বাবা নাই। বাবা নাই। একটু আগে বাবায় আমাগো এতিম কইরা চইলা গেছের ভাই । তুই এখনি রওনা দে।
ওসি সাহেবের কাছ থেকে ছুঁটি নিয়ে সন্ধ্যার পর বড় ছেলেটাকে সাথে করে সৈয়দপুর থেকে রওনা হয়েছে। ঢাকার উদ্দেশ্যে। তারপর ঢাকা থেকে ভোলা যেতে হবে। বিরাট দীর্ঘ পথ। দেশের একপ্রান্ত থেকে অরেক প্রান্ত। শুধু একটাই কথা বলেছে তার বোনকে; বাবাকে আমি শেষ দেখা যেন দেখতে পাই। আমি না আসা পর্যন্ত বাবাকে দাফন করবা না।
সৈয়দপুর থেকে আসার সময় পথে পথে কতোবার চোখ ভিজে গেছে বাবার কথা মনে করতে করতে। ছেলেটা পথে পথে কতো সান্তনা দিয়েছে। তাতে কি আর মন মানে। বাবা সবসময় বলতো হায়দার কোন দিন ঘুষ খাইবা না, অসৎ ইনকাম আমারে খাওয়াইবা না। আমার আর কোন কিছু তোমার কাছে চাওয়ার নাই। আর আমার কথা চিন্তা করবানা। অথচ চাকরীর জন্য বাবার মৃত্যুর সময়ও কাছে থাকতে পারলাম না। এখন প্রতিদিন ফজরের সময় কে কল করে বলবে -হায়দার তুই নামাজ পড়ছোস? ডিউটি কোন সময়, বাড়ি আসবি কবে। এসব মনে পড়ে বারবার বুক ফেটে কান্না আসছে।
পরের দিন লালমোহন গিয়ে বাড়ি পৌছাতে বেলা চারটা বাজে। মান্নান মৌলভী হায়দারকে দেখেই বলে উঠলো;
-বাবা অনেক সময় হইয়া গেছে। তোমার জন্যই কুলে রাখছি। যাও ওযু করে আসো দিন থাকতে থাকতে দাফন করি। মুর্দাকে বেশিক্ষন উপরে রাখলে তার রুহের কষ্ট হয়।
বাবার মৃত্যুও পর হায়দার আলী এখন প্রচন্ড অবসাদে ভোগে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন, ভিইপি, গুরুত্বপূর্ন যায়গা,তল্লাশি চৌকিতে পাহারা ,নিয়মিত টহল, সিনিয়র অফিসারদের সাথে থাকা, অভিযানে যাওয়া, অপরাধীদের সাথে গুলি বিনিময় সহ কতো রক্তাক্ত ও বিভীষিকাময় অপরাধের ঘটনার সাথে মিশে আছে হায়দার আলীর কর্ম জীবন।
এই চাকরী জীবনে কতো প্রিয় মুখের শেষ দেখা তার কঁপালে জোটেনি। কতো ঘনিষ্ট স্বজনদের আনন্দ অনুষ্ঠানে সে উপস্থিত হতে পারেনি। সেই বেদনা কেউ বুজবে না। সেই খবর কেউ খুজবে না।
ঢাকা,
১০ পৌষ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল,(দৈনিক যুগান্তর-২০২৩)
(পোষ্টের সকল চরিত্র স্থান কাল পাত্র সম্পুর্ন কাল্পনিক। কারো সাথে হুবহু বা আংশিক মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১০:৫০