ভারত যাব। পাসপোর্ট বের করে দেখি আর মাত্র চার মাস আছে এক্সপায়ার হতে। আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে দালালের সহায়তায় সাত হাজার টাকার জরুরী পুনঃপাসপোর্ট বারহাজার টাকায় দুইদিনে বের করলাম। এরপর ভারতের টুরিস্ট ভিসার আবেদন। সাক্ষাৎকারের পর ভিসাসহ সাতদিনেও পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছি না। চরম অবস্থায় দিন কাটছে। সুসিকে জানিয়েছি। আমি কলকাতায় আসছি। তার কান্না কিছুটা কমেছে। ও বর্তমানে সল্টলেকে ওর মাসির বাসায় আছে। অনেক অবস্থাপন্ন বাঙালীর মতো সুসিদের নিজেদেরও কলকাতার অভিজাত সল্টলেকে বাসা আছে। ওর মেসো দেখাশুনা করে। আগেই বলেছি সুসিরা বনেদী পরিবার। ওর অনেক আত্মীয়রা ‘৪৭র দেশভাগের সময় অনেকে ভারতে চলে গেছে। আবার অনেকেই ‘৭১র পরেও গেছে নানাবিধ কারণে।
অবশেষে দশম দিনে পাসপোর্ট হাতে পেলাম। কিন্তু কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। ভিসা আবেদন বাতিল হয়েছে। কোনো কারণ উল্লেখ নেই। হাতে আর মাত্র চৌদ্দদিন সময়। মুষড়ে পড়লাম। সুসি শুনে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে। বাংলা সিরিয়ালে টুকটাক কাজ করা ওর কাজিন ওকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। উনি না সহায়তা করলে সুসির সাথে যোগাযোগ কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।
এবার আবার ইন্ডিয়ার ভিসা অফিসের দালাল ধরলাম। সাতদিনের মাথায় ভিসাসহ পাসপোর্ট রেডি। হাতে আর মাত্র সাতদিন সুসির বিয়ের ডেট থেকে।
ব্যাংকে আমার কিছু টাকা ছিল। এছাড়া এসিএম প্রতিযোগিতায় গতবছর ব্রাজিল গিয়েছিলাম। এগুলোতে অংশগ্রহণের সময় পরিবার ও নানাদিক থেকে কিছু টাকা হাতে জমা হয়েছিল। এছাড়া দেশি একটি আইটি কোম্পানীতে কিছু সময় দেওয়ার ফলে মাসিক কিছু টাকা আসে। সব মিলে লাখ দুয়েক টাকা ব্যাংকে ছিল। সবগুলো তুলে ডলারে রুপান্তর করলাম।
পরের দিনই রাজারবাগে গ্রিনলাইন বাসের টিকিট কেটে রওয়ানা হলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে।
বাস জার্নিতে সুসি ও আমার সম্পর্কের এই বিশাল বাঁক নিয়ে ভাবছি। আচমকা পাহাড়ী ঢলে যেমন লোকালয় বিপর্যস্ত হয়, ঠিক তেমনি আমার জীবনের মসৃন পথটাও এক ফোনালাপে এবড়োথেবড়ো হয়ে গেছে। সুসি এখন কেমন আছে? সেও কি আমার মতোই বিধ্বস্ত? জীবনের এই বাঁক বদল সে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে? এর পরের পরিণতি কি হবে? ওকে উদ্ধার করে দেশে আনলেও কি রক্ষা হবে? সে কি এই পরিবর্তনকে মেনে নেবে? নিলেও তা কতদিনের জন্য? যেখানে এভারেস্টসম প্রতিবন্ধকতার চূড়া দেয়াল তুলে দিয়েছে দুই পরিবারে-দুই সমাজে, আমরা কি তা মোকাবেলা করতে পারব? সুসি কি এত চাপ নিতে পারবে? আমি নিজেও এই আবেগের গণ্ডি থেকে বের হয়ে কি এই সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দিতে পারব আজীবন? নানা দুঃচিন্তা মাথাটাকে হ্যাং করে দিয়েছে?
হঠাৎ সুসির প্রতি ভালোবাসার অদম্য আবেগের বেগ আমাকে নিয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে পথ-ঘাট পেরিয়ে তেপান্তরের পথে? যার দিগন্তরেখা বলে কিছু নেই। শুধু আছে হিমালয়সম ভালোবাসা। যার উপর ভর করেই এই ছুঁটে চলা। এই চলার শেষ কোথায় হবে জানি না। সুসি কি তা জানে?
বিয়ের চারদিন আগে আমি গিয়ে হাজির হই কলকাতাতে। ভারতের মাটিতে পা দিয়ে প্রথম কাজ ছিল সিম কেনা। সিম এক্টিভেইট করে সুসিকে একটি মিসকল দিয়ে রাখি। সুসিকে আগেই জানানো ছিল যে ওর কাজিনও যেন না জানে আমি এখন ভারতে। সুসিও হয়ত আমার মিসকলের অপেক্ষায় ছিল। পরে যখন সুসির সাথে ফোনে কথা বলি ভারত থেকেই, তখন সুসির উচ্ছ্বাস ফোনের এপার থেকেও আমার উত্তপ্ত হৃদয়কে শীতলবাস্পে অবগাহন করে দিল। আমারও তখন মনে হচ্ছিল আমি কোহেকাফের রাজকুমার পঙ্খিরাজে করে পরিস্থানের রাজকন্যাকে উদ্ধারে বের হয়েছি। যেভাবেই হোক আমাকে এ মিশনে সফল হতেই হবে।
৪
কলকাতা নিউমার্কেটের কাছে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নামলাম। এরপর পাশের হোটেল কস্তুরিতে খেয়ে সস্তা হোটেলের খোঁজে বের হলাম। প্রতিটা টাকা এখন আমার কাছে হীরের চেয়ে মূল্যবান।
এদিকে হালকা শৈত্যপ্রবাহের ফলে ঠান্ডায় অবস্থা কাহিল। সুসিকে ফোন দিলাম যেভাবেই হোক ও যেন বাসা থেকে বের হয়ে আসে। যদিও সম্ভব হবে কিনা জানি না। অসম্ভবরকম টেনশনে সময় কাটছে।
ওদের বাসার ঠিকানা জানা ছিল। আবেগে উদ্বেলিত হয়ে সল্টলেকে রওয়ানা হলাম। সল্টলেক যুবভারতী স্টেডিয়ামের কাছেই বাসা। কাছাকাছি গিয়ে ফোন দিয়ে জানালাম আমি সল্টলেকে ও বের হতে পারবে নাকি।
কিন্তু সুসি জানালো কোনমতেই সম্ভব নয়। অনিকেতসহ তার বাবা-মা সবাই নাকি চলে এসেছে। যে ছেলের সাথে বিয়ে সে নাকি গতকাল একটি ফোন কিনে দিয়েছে সুসিকে। আমার জন্য সুবিধা হয়েছে সুসি আমার সাথে কথা বললেও পরিবারের সদস্যরা মনে করছে হবু জামাইয়ের সাথেই বুঝি কথা চলছে।
সল্টলেকে যেহেতু দেখা পাওয়া যাবে না আবার ফিরে আসলাম নিউ মার্কেট এলাকায়। জানালাম সন্ধ্যার আগেই আমাদের বেনাপোল বর্ডার পার হতে হবে। তা না হলে আজকে আর সম্ভব না।
সে তার কাজিনকে নিয়ে দুপুরের পরেই নিউমার্কেটে চলে এসেছে। ওর কাজিন যেহেতু জানে না যে আমি এখন কলকাতাতে, তাই সুসি ফোনে কথা বললে মনে করছে হবু জামাই। নিউমার্কেটের বিগ বাজারের ঠিকানা দিলাম। ওখানে আমি থাকব। বিকেল সাড়ে তিনটা ঐ জায়গাতে সুসিকে একজন বিশ-একুশ বছরের মেয়ের সাথে এগিয়ে আসতে দেখলাম। নিশ্চয় ঐ কাজিনটি। আমার হার্ট দ্বিগুণ গতিতে পাম্পিং শুরু করেছে। গত চার-পাঁচটা মাস কি নরক যন্ত্রণার পর দেখা পেলাম সেই কাঙ্খিত মুখটির। ওকে আগেই জানানো ছিল অভিনয় করতে। ছলে-বলে-কৌশলে যেভাবেই হোক ঐ কাজিন থেকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও দূরে যেতে হবে।
আমাকে দেখতে পেয়েছে সুসি। সে সময় ওর মুখের আভা বদলের অবয়বটা দেখার মতো ছিল। যেন গোটা শরীর সুসির হাসছে। ও ওর কাজিনের পেছন পেছন হাঁটছে। ওর কাজিন যেহেতু আমাকে চেনে না। ফলে আমি ঠিক ওর পাশেই হাঁটছি। মাঝে একবার ওর হাতটা আমার হাতের মধ্যেও এক মুহূর্তের জন্যে নিয়েছিলাম। ওফ, আমার সুসি। মাই লাভ। শুধুই আমার।
হঠাৎ ওর কাজিন দেখি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলে সুসিকে বলছে, ‘মাসিমা ও অনিকেতদা আসছে রে’।
এ কথা শুনে মনে হল আমার ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশার ধাঁই করে দুশ’র কোঠা অতিক্রম করল। সুসির চোখমুখও ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে। যা করার কাকিমা ও অনিকেত আসার আগেই করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে দোকানগুলোতে এখনও সেই রকম ভীড় করছে না। ফলে সটকে পড়াও টাফ হয়ে গেছে।
সুসিকে খুদেবার্তা দিলাম। ওর কাজিন থেকে যেন একটু দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটে। আর সুযোগ পেলেই যেন সটকে পড়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে। এমনকি আমাকে দেখার জন্য পেছনে দেখারও দরকার নেই। কারণ আমি পেছনেই থাকব।
যা ভাবা। শিলাজিৎ নামে একটি জুতার দোকানে ওর কাজিন ঢুকতেই সুসি দোকানে না ঢুকে একটু সামনে গিয়ে বামে টার্ন নিয়েছে ওর কাজিন থেকে আড়াল হতে। আমিও মোবাইল টিপতে টিপতে পেছনেই হাঁটছি।
দেখলাম ওর কাজিন জুতার দোকানে ঢুকে কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার বের হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ততক্ষণে সুসি বামে টার্ন নিয়ে ফেলেছে। এরপর আর আমাদের পেছনে দেখার সময় নেই। আমি দ্রুত হেঁটে সুসির হাত ধরে ফেললাম। এরপর নিউমার্কেটে পূর্বদিক দিয়ে বের হয়ে মার্কেস স্ট্রিটে চলে আসলাম। হোটেলে এসে ব্যাগ নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে এসে দ্রুত একটি ট্যাক্সিকে বললাম পেট্রাপোল যাবে কিনা।
দ্রুত দরকষাকষি করে ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। আমাদের হাতে সময় কম। সন্ধ্যার আগে বর্ডার পার হতে না পারলে আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যা অবশ্যই নতুন কোনো বিপদ ডেকে আনবে।
ট্যাক্সিতে উঠেই দেখি সুসি আমার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে একটু একটু কাঁপছে হাতটা। ওর দিকে তাকাতেই চোখে জল দেখতে পেলাম। আমার বুকটাও উথাল-পাথাল করা শুরু করেছে। ও থাকতে না পেরে আমাকে ডান হাতে জড়িয়ে ধরে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল। আমার চোখও জ্বালাপোড়া শুরু করেছে। ছয়টা মাস কী নিদারুনভাবে কাটিয়েছি? আমিও ওকে আমার দেহের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলাম। যেন বোঝাতে চাচ্ছি আর ভয় নেই। আমি এখন তোমার প্রহরী হয়ে রাতজেগে পাহারা দেব হে রানী!
ঠিক পৌনে ছয়টায় পেট্রাপোল পৌঁছে গেলাম। তাড়াতাড়ি ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়ালাম। আমাদের পালা আসল। ভাবছি আর মাত্র কয়েক মিনিট। এরপরেই আমরা হব মুক্ত বিহঙ্গ। সুসি সেই যে নিউমার্কেটে আমার হাত ধরেছে আর ছাড়াছাড়ির কথা নেই। ভাবখানা এমন যেন ছাড়লেই আমি হারিয়ে যাব। আরেকটা কথা এখন আমাদের দুটো ফোনোই বন্ধ করে দিয়েছি। কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নই।
আমাদের দুটো পাসপোর্ট জমা দিলাম। একটু পরেই ইমিগ্রেশন অফিসারের কথাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। অফিসার জানালেন আমি বর্ডার ক্রস করতে পারলেও আমার সাথে উনি মানে সুস্মিতা রায় চৌধুরী পারবেন না। কারণ... (কারণটা না হয় আগামীকালকে বলি...)
**********************************************
ছবি: লেখক। এটাই সেই সেলিমের আনারকলির বন্দিশালা। এই সিঁড়ি বেয়েই নিচে কোন এক অন্ধকার কুঠোরিতে আনারকলিকে বন্ধি রাখা হয়েছিল। ফতেপুর সিক্রি, আগ্রা, ভারত।
ভালোবাসার গল্প: দ্বিঘাত সমীকরণ-৩