সকাল ৭টায় বন্ধুর ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় ফোন। ভাবলাম এত সকালে বেদনার্ত কণ্ঠে ফোন, কোনো বিপদ নাকি। যদিও ওরই বউ ডাক্তার। হাড় মড়মড়ি রোগ বউ ঠিক করে দেওয়ার কথা।
এ সব চিন্তা করে একপ্রকার উদ্বিগ্ন হয়েই 'হ্যালো' বলতেই,--বন্ধুর প্রতিউত্তর, ‘চল, তুরস্ক অথবা মিশর ঘুরে আসি’।
আমিও আধো ঘুমে জানালাম, ‘একটু দেরী হবে রে। সকালের নাস্তা করে বের হই’।
এরপর বেশ হাসাহাসি। কাশাকাশি। এবং সিদ্ধান্ত পাক্কা। মিশর। কারণ মেরা পেয়ার কা সওয়াল হ্যায়। মেরা নেফারতিতি। এই মিশর নিয়ে আমার একধরণের ফ্যাসিনেশন রয়েছে। কীভাবে হাজার হাজার বছর আগে এমন উন্নততর চিন্তা তারা করতে পেরেছিল? এই উত্তরাধুনিক বিশ্বও তাদের উদ্ভাবনী চিন্তার নাগাল পেতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রাচীন এই ঐতিহ্যগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার অনুভূতিটা কেমন হবে ভাবতেই একটি শিহরণ খেলে যায়?
প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলাম ট্যুর অপারেটরদের প্যাকেজে খোঁজ নিতে হবে। নিলাম। তাদের বেশির ভাগের প্যাকেজের সাথে আমাদের প্লান মিলে না। কেউ শুধু কায়রো ও আলেক্সান্দ্রিয়া নিয়ে যাবে। কেউ আবার কায়রো ও লুক্সর। শেষে স্বাধীনভাবে ছুটাছুটির জন্য আমরা নিজেদের ইটিনারারিতেই মিশর যাওয়ার প্লান করলাম।
ছবি: আমাদের ট্যুর প্লান: মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া টু আবু সিম্বেল। অর্থাৎ ভূ-মধ্যসাগরের তীর থেকে নীল নদের পাড় ধরে সুদানের বর্ডার পর্যন্ত।
সময় নয় থেকে দশদিন। সিদ্ধান্ত নিলাম কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া, লুক্সর, আসওয়ান ও আবু সিম্বেল যাব। এত জায়গায় দশদিন বেশ কম সময়। আমাদেরও উপায় নেই। আরো একটি দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। তাই এটাই ফিক্সড। এর উপরই আমরা একটা খসড়া দাঁড় করালাম।
কায়রো- চার দিন। আলেক্সান্দ্রিয়া-একদিন। লুক্সর-একদিন। আসওয়ান ও আবু সিম্বেল-দুইদিন। সাথে ট্রেন জার্নি রাত দুই। শেষে আমাদের ট্যুরটা শেষ হয়েছিল এরকমঃ
কায়রোতে প্রথম রাত থেকে পরের দিন পিরামিড দর্শন ও অন্যান্য কাজ, যেমন, সিম কেনা, ট্রেনের টিকিট কাটা ইত্যাদি।
দ্বিতীয়দিন সকালের ট্রেনে চেপে আলেক্সান্দ্রিয়া। সেখানে কুইটবে সিটাডেল, আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী, মন্তাজা গার্ডেন প্যালেস ও বাতিঘর, আমর আল মুসা মসজিদ দর্শন এবং রাতের ট্রেনে আবার কায়রো ফিরে এসে রাত্রিযাপন।
তৃতীয়দিন ইজিপ্সিয়ান/কায়রো মিউজিয়াম, তাহরীর স্কয়ার ও অন্যান্য। রাতে ট্রেনে চেপে আসওয়ান।
চতুর্থদিন আসওয়ান হাই ও লো ড্যাম দর্শন, টেম্পল অব ফিলি, নাইল মিউজিয়াম। রাতে আসওয়ান শহরটা ঘুরে টুরে দেখা। ভোররাতে প্রাইভেট ট্যাক্সিতে চেপে আবু সিম্বেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা।
পঞ্চম দিন সকাল বেলাটা আবু সিম্বেল টেম্পল, টেম্পল অব নেফারতিতি দেখে দুপুরে আবার আসওয়ানে ফেরত। বিকেলে নীল নদের পানিতে নৌকাতে করে ঘুরাঘুরি, এলেফেন্টাইন গার্ডেন, নুবিয়ান ভিলেজ দর্শন শেষে ফিরে রাতে ঘুম।
ষষ্ঠদিন ভোরে উঠে লুক্সরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। হোটেলে ব্যাকপ্যাক রেখে লুক্সর টেম্পল দর্শন, ভ্যালি অব কিংস, ভ্যালি অব কুইন, টেম্পল অব হাটসেপ্সুট, কলোসাই অব মেমনন, মেদিনেত হাবুসহ আরো কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন দর্শন। রাতে লুক্সর শহরটা চক্কর দেওয়া।
সপ্তমদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা জায়ান্ট টেম্পল অব কারনাক দর্শন। এবং রাতে ট্রেনে কায়রো ফেরত।
অষ্টম দিন-নবম দিন ইসলামিক কায়রো দর্শন, সালাদিন সিটাডেল, হোসেন মস্ক, আল-আযহার পার্ক, আল-আযহার মসজিদ, খান-ই-খলিলি বাজার ইত্যাদি। রাতে এটা সেটা কেনাকাটা। নবমদিন রাতে বিদায় রাগিণী।
এবারে আমাদের ভ্রমণে ফিরে আসিঃ
কায়রো বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন যখন শেষ করলাম তখন স্থানীয় সময় রাত দুইটা। ডিসেম্বরের শেষে হওয়ায় হালকা শীত। বুকিং ডটকমে হোটেল বুকড করা ছিল। ওদের এয়ারপোর্ট সাটল পাঠানোর কথা। ভাবছি না পাঠালে আমাদের খবর আছে। প্রচুর পর্যটক দেখলাম ইমিগ্রেশন লাইনে। বিশেষ করে চীন, কোরিয়া, জাপান এই সব দেশেরই বেশি। মাঝে মিশরের টুরিজমে বিপর্যয় ঘটেছিল। আবার নতুন করে পর্যটক আসছে। কিছু ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ির জন্য ছেঁকে ধরল। আমরা ধন্যবাদ বলে পা বাড়াই। গেট পার হওয়ার আগে রেন্ট-এ-কারের লোকজনের হৈ হৈ করে বলতে শুনলাম ‘ইন্ডিয়ান’, ‘ইন্ডিয়ান’। ভাবখানা এমন যেন ভুখানাঙ্গা ইন্ডিয়ানরা এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটেই হোটেলে যাবে। মুচকি হেসে জানালাম ‘বাংলাদেশ’। এবার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ‘রোহিঙ্গা’, রোহিঙ্গা’ বলতে শুনলাম। মর জ্বালা!!
‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি দেখছি ব্রান্ড হয়ে গেছে বিশ্বে। যদিও পরে জানতে পারি এটি তারা পজিটিভ অর্থেই ব্যবহার করে। মানে আমারা যে এই লাখ লাখ ‘রোহিঙ্গা মুসলিম’দের আশ্রয় দিচ্ছি এর জন্য তারাও কৃতজ্ঞ। যেটা পরে অনেকের কাছ থেকেই জানতে পারি আলাপে।
মূল গেটের বাইরে দেখি আমাদের নেমকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন বিশ-বাইশ বছরের যুবক। নাম ইশাম।
মিশরে বিমানবন্দরটি বেশ সুন্দর। এত রাতেও লোকে লোকারণ্য। ডিসেম্বর মাস টুরিজমের পিক সিজন। লাখ লাখ পর্যটক আসছে।
আমরা মিসকিন গোত্রের পর্যটক। সাধ্য না থাকলেও সাধটা ষোলআনা থাকায় ঝোলা নিয়ে এখানে-সেখানে বেরিয়ে পড়া আমাদের রুটিন ওয়ার্ক। থাক তাঁহারা সুখে ঐ নীলের পাড়ের ফাইভ স্টারে। মনে এই সান্তনা নিয়ে উঠেছি ডাউনটাউনের বাজেট হোটেলে। দুই রুমের ভাড়া ৫৮ ডলার প্রতি রাত। আমাদের গাড়ীচালক ইশাম প্রাচীন এক বিল্ডিং এর সামনে এই গভীর রাতে গাড়ি দাঁড় করাল। এই খানে তো আমরা বুকিং দেই নাই। হোটেল ছিল কায়রো প্যারাডাইজ বুটিক হোটেল। আর এটা দেখছি কায়রো প্যারাডাইজ হোটেল। ইশাম জানালো ভিতরে ঐটাও আছে। মানে গ্রুপ হোটেলের ঐটা আরেকটা শাখা। ছবি: সকালবেলা তোলা আমাদের হোটেলের নিচে কায়রো ডাউনটাউন।
বিল্ডিং এর প্রাচীনত্ব দেখে আমরা একে অপরের দিকে তাকাই। কারুকাজ দেখে মনে হচ্ছে ভূতের বাড়ি।
মনে সন্দেহ নিয়ে গেট দিয়ে ঢুকেই শতবর্ষী দরজাওয়ালা ছোট্ট খোলামেলা লিফটে ব্যাগসহ চাপাচাপি করে প্রবেশ করলাম। দরজা লাগাতে একটু দেরী হওয়ায় বিকট স্বরে সাইরেন বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি দরজা লাগালাম। ইশাম কাচের দরজার ওপারে আমাদের অসহায় অবস্থায় মুচকি মুচকি হাসছে। উপরে ছয়তলায় উঠে আসলাম। এরপর সেখানে থেকে করিডোর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আবার সিড়িভেঙে হেঁটে পাঁচ তলায় নামলাম। এরপর আমাদের হোটেলের রিসেপশন দেখতে পেলাম মাথায় ছোট্ট ব্যান্ডেজ বাধা অবস্থায় রেসেপশনিস্টকে। মিষ্টি হেসে জানাল তাদের এই পাশের লিফটে কাজ চলছে বিধায় আমাদের অন্য হোটেলের লিফট দিয়ে উঠানো হয়েছে।
পরে হোটেল মালিকের কাছ থেকে শুনেছি এই বিল্ডিং এর বয়স ১০২ বছর। ব্রিটিশরা বানিয়েছে। কিছুটা ঢাকার কার্জন হলের মতো। ছয়টা ফ্লোরের মধ্যে মাঝের দুইটা ফ্লোর এখনো পরিত্যাক্ত। উপরের এই ফ্লোরগুলো লিজ নিয়ে রিনোভেইট করে হোটেল চালু করে করেছে কিছু উদ্যোগতা। বিল্ডিংগুলো সরকারী সম্পত্তি। এরকম শত শত বিল্ডিং রয়েছে কায়রো ডাউনটাউনে। এই জায়গাটা ইউরোপ স্টাইলে বানানো। নিচের সব রাস্তা ওয়ান ওয়ে।
যাহোক তাড়াতাড়ি চেক ইন করে একগ্লাস জুস খেয়ে রুমে ঢুকেই দিলাম একটি ঘুম। দু একটি হাতির মতো মশাও দেখলাম আক্রমন শানানোর চেষ্টা করছে। হোটেলের ভিতরে বেশ ছিমছাম ও গোছালো। সব রুম বুকড পর্যটকে।
সকালে উঠে হোটেলের সরবরাহকৃত ব্রেকফাস্ট। খেয়েই আমাদের প্রথম টার্গেট পিরামিড। সবার আগে সিম কিনতে হবে। হোটেলের নিচের স্ট্রিটেই সারি সারি দোকানের পসরা। একটু হেঁটে গিয়েই ভোডাফোনের আউটলেট। ১০৫ মিশরীয় পাউন্ডে (এক মিশরীয় পাউন্ড = বাংলাদেশী চার টাকা পঁচাত্তর পয়সা) ২ জিবি ডেটা সহ টকটাইমের সিম কিনলাম। নেটের স্পিড বেশ ভালো। আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক ছাত্র আমাদেরকে এ ব্যাপারে বেশ সাহায্য করেছিল।
ছবি: হোটেল থেকে পিরামিড যাত্রা ম্যাপ। নীল নদ পার হয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার যাওয়া লাগে।
এরপর হোটেল থেকে ডানদিকে একটু হেঁটেই আটাবা মেট্রো স্টেশন। ট্যাক্সি কিংবা উবারেও আসা যেত তবে সময় বেশি লাগবে। কায়রো ট্রাফিক জ্যাম ঢাকার মতো না হলেও সময় বাঁচাতে মেট্রোতেই সুবিধা। বিশেষ করে একটি দেশের ভিতরের কালচার জানতে হলে পাবলিকের সাথে মিশতে হলে এর চেয়ে ভালো উপায় আর কি হতে পারে? আমি এটা লাইক করি। মেট্রোতে জন প্রতি পাঁচ পাউন্ডে গিজাতে চলে আসলাম। নীল নদের অপর পাশে গিজা বৃহত্তর কায়রোর অংশ। যদিও মিশরীয়রা আলাদা শহর হিসেবেই দেখে। এখানেই সেই বিখ্যাত পিরামিডগুলো। সেখান থেকে চল্লিশ পাউন্ডে এক ট্যাক্সি ঠিক করে রওয়ানা হলাম পিরামিড দর্শনে। ড্রাইভার আমাদের সাথে একটু চালাকি করার চেষ্টা করেছিল। এইসব নানান ঘটনা নিয়ে 'মিশর কড়চা' নামে একটি সিরিজ লেখার ইচ্ছে রয়েছে।
কায়রোর এ পাশটা বাংলাদেশের সাথে ভালো মিল আছে। যত্রতত্র আবর্জনা। ট্রাফিক জ্যাম। হাউকাউ। চ্যাঁওম্যাঁও। ফুটপাতে বন্ধ করে দোকান। তাই গিজা আর গাজীপুরের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য করা মুশকিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার টিকিট কাউন্টারের অদূরে এনে মাল আনলোডের মতো করে আমাদের নেমে দিল। সাথে সাথে রজনীকান্তের ছবির ভিলেনের মতো করে আট দশটা বন্দুক মাথার উপর ধরার মতো কোথা থেকে যেন আচম্বিতে ডজনখানেক উট, গাধা ও খচ্চর এসে হাজির। আমিও উটের মতো লাফ দিয়ে অবলাদের আছ থেকে সরে আসলুম। আমাদেরকে সাথে নিয়ে তারা পিরামিড দেখতে যেতে চায়। এই অবলা প্রাণীদের দুই হাত তুলে পেন্নাম করে বল্লুম মাফ চাই। অবলারা হয়ত মাফ করল কিন্তু এদের সাথে লোকগুলো জোঁকের মতো ঘুর ঘুর করতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি করে টিকিট কেটে পদব্রজে রওয়ানা হলাম ফ্যারাওদের গোরস্থানের দিকে। সামান্য দূরত্ব। ব্যাটারা হাজার হাজার বছর আগে একটা কাম করে গেছে এ জিনিস বানিয়ে। মরেও বেঁচে থাকার কত আয়োজন।
জন প্রতি ১৬০ মিশরীয় পাউন্ড (৭৭০ টাকা) টিকিটের মুল্য। আমরা যখন ঢুকছি তখন দুপুর কাত হয়ে গড়িয়ে আধা শোয়া অবস্থায় গেছে। তাই হাতে সময় কম। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল এ রকম একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা আর এর প্রবেশমুখ বেশ সাদামাটা। গরীবের সুন্দরী বউরা কি এভাবেই অবহেলা, অনাদরে ক্লিষ্ট বদনে...।
ইতিমধ্যে এই বিস্ময়কর সৃষ্টি ট্যাক্সিতে বসে থাকা অবস্থায় দৃষ্টিগোচর হয়েছে। হাজার হাজার বছর আগে কীভাবে এসব বানানো সম্ভব হয়েছিল তা আজো আধুনিক বিশবের বিস্ময়। আমি পিরামিডের বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি না। এ নিয়ে কিছু লিংক নিচে যোগ করে দিব।
ছবি: সামনের বালিময় গোলচত্ত্বর পেরিয়েই স্ফিংস।
ঢুকেই ঝোলা থেকে ক্যামেরাটা বের করে দূর থেকে পটাপট কয়টা ছবি তুলে ফেললুম এই বিস্ময়ের। বয়স্ক সাদা পরীদের একটি বড়সড় দলকে দেখলাম চত্বরের দেয়াল টপকে চলচল চলে গেল। বালির গোলচত্বর টপকে স্ফিংসের মূর্তির সামনে এসে অর্ধেক সিংহ ও অর্ধেক মানবের ছবি তুললাম। এই জায়গা থেকে পেছনের দুইটা পিরামিডের দৃশ্যটা ভাল আসে। ফলে পর্যটকের নানা কসরতের ছবি তোলার প্রতিযোগিতা এখানে। আমরাও ট্রাই করলাম বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ফারাও খুফুর পিরামিডের সাথে ছবি তোলার।
ছবি: স্ফিংসসহ গ্রেট পিরামিড অব গিজা।
ছবি: ওহে, বেলা যে গড়িয়ে যাচ্ছে... তাড়াতাড়ি চল ...আমরাও ছবি তুলবার চাই...
ছবি: স্ফিংসকে বায়ে রেখে দুই গ্রেট পিরামিড। সন্ধ্যার আগে লোকজন নেই বললেই চলে। সকালে এই জায়গাতে ছবি তোলায় মুশকিল।
ছবি: স্ফিংসের পাশে থেকে ছবি। এখানে নানা দেশের ক্লিউপেট্রারা গা এলিয়ে দিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করছে এই সিংহ পুরুষের।
স্ফিংসের মুখ জীবন্ত হয়ে উঠল ক্যামেরার ঝলকানিতে। এরপর ভাঙাচুরা এক মন্দিরের ভেতর দিয়ে স্ফিংসের খুব কাছে চলে আসলাম। অনেকে এখানে এসে জিরিয়ে নিচ্ছে। বিকেলের সোনা রোদে নীল-সাদা-বাদামী পরীরা তা দিচ্ছে। আমরা ওখান থেকে বাম দিকে মোড় নিয়ে সোজা গ্রেট পিরামিড অব গিজা বা খুফুর পিরামিডের দিকে পদযাত্রা শুরু করলাম। সন্ধার কিছু আগে হওয়ায় হাতে গোনা কয়েকটা লোক তখন পিরামিডমুখি। সবাই দর্শন শেষে বাড়ি ফেরত। আমরা আলসে-কুঁড়ার দল সন্ধ্যার আগে এটি দর্শনে এসেছি। অবশ্য এসে ঠকে নি। এরই মাঝে কিছু উট ও খচ্চরের মালিকেরা আমাদেরকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। শেষে না পেরে ২০ পাউন্ড চুক্তিতে কয়েকমিনিটের জন্য আমার ভ্রমণ সঙ্গীরা উটের পিঠে উঠে পড়ল। আমিও ঝটঝট কয়েকটা ছবি তুলে ওদেরকে উট থেকে নামতে বলতেই লাগল ক্যাচাল।
ছবি: গ্রেট পিরামিডের দিকে হাঁটা দিয়েছি। আমাদের সঙ্গী উট ও খচ্চর।
ছবি: মিশরে উট ও পিরামিড একসাথে গাঁথা।
উটের মালিক চায় আরো সময় থাকুক তারা উঠের পিঠে। সামান্য কিছু পাউন্ড বাড়ায়ে দিলেই হবে। নিজে বসে পড়ছে কিন্তু কিছুতেই ব্যাটা উটকে বসাবে না। শেষে আমাদেরকে অতিরিক্ত বিশ পাউন্ড দিতে হল। এভাবে ট্রিকস করে তারা বেশি বেশি পাউন্ড খসায় পর্যটকদের কাছ থেকে। আমরা টুরিস্ট পুলিশের ভয় দেখিয়ে রক্ষা।
তবে এখানে যে সমস্যাটা হচ্ছে তা হল প্রচুর ঘোড়ার গাড়ি ও উঠের চালক আপনাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে চাইবে। কিছুটা নাছোড়বান্দার মতো। আবার চুক্তি করে গাড়িতে বা উটের পিঠে উঠেও ত্যাঁদড়ের মতো কিছু বেশি ঘোরানোর ধান্ধা করবে এবং বেশি টাকা খসিয়ে নেবে। তাই ভ্রমণে গেলে এ থেকে সাবধান। আমরা আগে থেকে এসব জেনে সতর্ক থেকেও অতিরিক্ত বিশ পাউন্ড দিতে হয়েছিল।
ছবি: সন্ধ্যার আগে সিংহ মানবের দৃশ্য।
যাহোক যেহেতু বিকেলে ঢুকেছিলাম পিরামিড দেখতে তাই পর্যটক কম ছিল। আর সন্ধ্যার আগে আগে বের হওয়ার আগে প্রায় পর্যটক শুন্য। সে সময়টা অপার্থিব। একদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে পিরামিডের কোল ঘেঁষে অন্য দিকে আমরা শুনছি খট খট খট ঘোড়া ও উটের পায়ের আওয়াজ।
ছবি: সন্ধ্যার সোনাঝরা আলোতে পিরামিড
পিরামিড কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে ৪০ পাউন্ডে একটি উবার করে নীল নদের তীরে চলে আসলাম যেখানে তাহরীর স্কয়ার রয়েছে। এই সেই জায়গা যেখানে মিশরের সব পাবলিক আন্দোলনের সূতিকাগার। রাতের বেলা দেখলাম অনেক মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। একপাশে বিখ্যাত ইজিপ্সিয়ান মিউজিয়াম, অন্য পাশগুলোতে ছড়িয়ে আছে ফাইভ স্টার হোটেল। অদূরেই নীল নদ। চারিদিকে রাস্তা। পাশেই ডাউনটাউন কায়রোর জৌলুস। রূপসী কায়রো।
সেখানে আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে টাটকা ডালিমের জুস (১৫ মিশরীয় পাউন্ড) পান করে হেঁটেই হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম দুইপাশের সারি সারি দোকান দেখতে দেখতে। নানা দেশের নানা বর্ণের পর্যটকে টইটুম্বুর কায়রো তখন।
ছবি: রাতের রূপসী নীল পাড়।
পিরামিড দর্শনের সেরা সময় মনে হয় এটাই। না গরম না শীত। অথচ গরমকালে মিশর ভ্রমণে এসে ইউটিউবে অনেককে সারমেয়দের মতো হাঁপাতে দেখেছি। এবং বিকেল বেলাটা আমার মনে হয় শ্রেষ্ঠ সময়। কারণ সকাল সব ট্যুর অপারেটররা পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে। ফলে ভালো মতো একটি ছবি তোলাও মুশকিল। তাছাড়া সন্ধ্যার সময় পিরামিডের উপর সূর্যের আলোর নাচন দেখার মতো। সাথে মরুভূমির মৃদু বাতাস। আজ এপর্যন্ত…
ট্যুর অপারেটরদের প্যাকেজ বাদে যদি আপনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পর্যটক হতে চান, তাহলে মিশর যাবেন কীভাবে?
পাসপোর্ট নিয়ে ৩৩০০ টাকায় ভিসাটা করে ফেলুন। যে কোনো এয়ারলাইন্সের টিকেট কাটুন। ইকোনোমি রাউন্ড টিকেট ৫০,০০০ টাকার আশেপাশেই। ক্রেডিট কার্ড থাকলে সেটাতে ব্যাংক থেকে ডলার এটাচ করে বুকিং ডটকম কিংবা হোটেল ডটকম ইত্যাদি সাইটে গিয়ে হোটেল বুক করতে পারেন। কিংবা মিশরে গিয়েও হোটেল নিতে পারেন। তবে বুক করে যাওয়ায় বেটার, বিশেষ করে কায়রোতে প্রথমে নামলে। এতে এয়ারপোর্ট সাটল (১৫ ডলার) ব্যবহার করে সহজেই হোটেলে গিয়ে পরে অন্য শহরের হোটেল আস্তে ধীরে বুক করতে পারেন কিংবা উপস্থিত হয়ে চেক ইন করতে পারেন।
কারণ সেখানে ইংরেজি জানা লোকের অভাবে প্রথমেই বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন। কিছু বেসিক আরবি ভাষার টার্ম জেনে যেতে পারেন। আর অবশ্যই এক থেকে দশ আরবি সংখ্যাটা জেনে যাবেন। কেন বলছি গেলেই সেটা টের পাবেন।
মোটামুটি মানের হোটেল ভাড়া কায়রোতে বাংলাদেশী টাকায় ১৫০০ থেকে শুরু। যার যেমন বাজেট। আর লুক্সর ও আসওয়ানের হোটেল রেট বেশ কম। বাজেট হোটেল ১০০০ থেকে ২০০০ এর মধ্যেই। এবং বেশ ভালো। সকালের ব্রেকফাস্ট থাকে। সাথে ওয়াইফাইও ফ্রি। আর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মিশর সেফ বলা চলে। আমাদের মতো বাদামী কালারদের সমস্যা নেই। রাত একটায় রামেসিস ট্রেন স্টেশনে নেমে আমরা পনের মিনিট হেঁটে আমাদের হোটেলে এসেছিলাম গুগল ম্যাপ ধরে। রাস্তায় অনেকেই এভাবে চলছে তখন। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে। খাওয়া-দাওয়া খরচও মোর অর লেস বাংলাদেশের মতোই। পাউরুটি খাওয়ার অভ্যসটা পোক্ত করতে পারেন। না হলে কেএফসি বা ম্যাকডোনাল্টসে ঝাঁপ দিবেন।
শহর থেকে শহরে প্রথম শ্রেণির সিটে ট্রেনে ভ্রমণও অনেকে সাশ্রয়ী বলা যায়। ট্রেনের সিটও সহজলভ্য যদি দু একদিন আগে কাটতে পারেন। এখানে স্থানীয় কারো সাহায্যে টিকিট কাটতে পারেন। কারণ এই সকল লোকাল ট্রেনে টুরিস্টদের সাধারণত যাতায়াতে টিকিট দিতে চায় না। পর্যটকদের জন্য ওয়াতানিয়া নামে অতি উচ্চ মূল্যের একটি ট্রেন রাতে চলে ঐ টা তারা রেফার করে। জন প্রতি ভাড়া সেখানে ৮০ থেকে ১২০ ডলার। যেখানে এই টাকা দিয়ে স্থানীয়দের ট্রেনে চেপে গোটা মিশর সফর করা যায়। অনেক পর্যটকও তাই করে।
আমরা আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমাদের পরিচিত এক বাংলাদেশী ভাইয়ের সহায়তায় কায়রো-আলেক্সান্দ্রিয়া-কায়রো (প্রথম শ্রেণী রাউন্ড টিকেট ১৯০ মিশরীয় পাউণ্ড জনপ্রতি) এবং কায়রো-আসওয়ান-লুক্সর-কায়রো (টোটাল ২৩৫+ ৯০ + ১৯০ = ৫১৫ পাউণ্ড জনপ্রতি) ট্রেনের টিকেট বুক করেছিলাম।
আর মিশর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় আমার মতে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। কারণ এ সময় দিনের তাপমাত্রা মোটামুটি ২০ থেকে ২৮ ডিগ্রি থাকে। আর রাতে ১০ থেকে ২০ ডিগ্রী। বাংলাদেশের মতোই। আর গরমকালে গেলে কুত্তার মতো হাঁপাবেন কয়ে দিলুম। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রীর উপরে হরহামেশায়।
আর একটি কথা মিশরের এই নিদর্শনগুলোতে প্রবেশ ফি অত্যধিক। ফলে আপনাকে মিনিমাম হাজার পনের টাকা এ জন্য বাজেটে রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কায়রো মিউজিয়ামে প্রবেশ ফি + লাইভ মমি দর্শন ফি মিলে ৩০০ মিশরীয় পাউন্ড মানে প্রায় ১৫০০ টাকার কাছাকাছি। এরকম সব দর্শনীয় স্থানের ক্ষেত্রেই...। আর কেউ ছাত্র-ছাত্রী হলে আইডি কার্ড নিতে ভুলবেন না। এতে অর্ধেক ডিসকাউন্ট পাবেন। ছবি: বিখ্যাত নীল নদের পাশে কায়রো টাওয়ার। পেছনে একটু হাঁটলেই পৃথিবী বিখ্যাত তাহরীর স্কয়ার।
এরপর দেখা হবে আলেক্সান্দ্রিয়ার পথে-ঘাটে…………
@মিশরীয় পিরামিড
@এখানে জুন আপার পিরামিড নিয়ে চমৎকার ভ্রমণ ব্লগ
@ফ্যারাও খুফুর সাথে ব্লগার জুনাপু
ব্লগার মধুমিতা পিরামিডের কেচ্ছা কাহিনি শুনিয়েছেন এখানে।
***************************************************************************
আখেনাটেন/২০১৯
ছবি: লেখক।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:৪২