somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ প্রিয়াদি

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নিস্তব্ধ পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন ঢেউয়ের বাঁকগুলো উঁচু থেকে নিচু হতে হতে কাছে এসে লুটোপুটি খায়, ঠিক তেমনি প্রিয়াদির হাসিটাও শুরুতেই প্রবলভাবে তরঙ্গাকারে দোলা দিয়ে আস্তে করে কাছে টেনে আপন করে নিত। আমার ছোট ছোট দুষ্টুমিগুলো পুকুরে ঢিলের মতোই কাজ করত সেসময় । আর আমিও ঐ হাসিটুকুর জন্য সঙ্গোপনে ঢিল ছুঁড়ে যেতাম।

অবশ্য বেশি বেশি ছুঁড়তে গেলে প্রিয়াদি কাছে এসে আমাকে উনার পালক নরম বুকের সাথে চেপে ধরে মৃদু চপেটাঘাত করার ছলে বলত, ‘মিট্টু, দ্যাখ বেশি দুষ্টুমি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু’

আর আমি ঐ টুকুন বয়সে প্রিয়াদির বুকের পেলব উপত্যকায় মুখ ঘষে মায়ের নাকি প্রেমিকার ওম নিতাম তখনও তা বুঝে উঠার বয়স হয় নি। কারণ তখন আমার বয়স ছিল সবেমাত্র আট কি নয়। আর দিদি তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ঐ বয়সেও আমি টের পেতাম প্রিয়াদির আগুনঝরা রূপের জৌলুস।

শহর সংলগ্ন পদ্মপুকুর গ্রামের ছেলেপেলে কিংবা সদরের হাইস্কুল কলেজের বোর্ডিং এ থাকা ছাত্ররা প্রায়ই দেখতাম প্রিয়াদির বাড়ির সামনে দিয়ে নিজেদের সদ্য কেনা ফনিক্স কিংবা হিরো সাইকেলে করে চক্কর দিতে। কদাচিৎ প্রিয়াদির দেখা পেলে ছেলেগুলো ধন্য হয়ে যেত।

আমার অবশ্য সে বাধ্য-বাধকতা ছিল না। এমনিতে পিচ্চি। আর প্রিয়াদির বাবা শিক্ষক হওয়ায় ওনার কাছে ছোট থেকেই বাবার বিশ্বস্ত শম্ভু দা আমাকে সন্ধ্যার আগেই পড়তে দিয়ে আসত। ক্লাস থ্রি তে উঠার পর প্রিয়াদির বাবা শৈলেন কাকা একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার পড়াশুনার দায়িত্ব তখন গিয়ে পড়ে প্রিয়াদির কাছে। সেই থেকে আমি প্রিয়াদির উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত হতে থাকি।

'-প্রিয়াদি, তুমি এত সুন্দর কেন গো?’ মিষ্টি করে আমি জানতে চাই একদিন।
-'তাই নাকি? তোকে কে বলল?’ প্রিয়াদি মুখে অনিন্দ্যসুন্দর হাসি নিয়ে মাথা দুলিয়ে আমার কাছে জানতে চায়।
-'শম্ভু দা বলছিল সেদিন।’- আমি নির্লিপ্তভাবে বলি।
-'শমভু দা আর কি কি বলে রে?’ প্রিয়াদি চোখ নাচিয়ে উৎসুক হয়ে জানতে চায়।
-'তোমাকে বলব কেন?’ বলে আমি দৌড়ে পালিয়ে যাই প্রিয়াদির নাগালের বাইরে। আর আমাকে ধরার জন্য ‘এই মিট্টু, এই মিট্টু শোন’ বলে আমার পিছু পিছু আসতে থাকে।



এই হল আমার প্রিয়াঙ্কা দিদি। আমি যাকে ডাকি প্রিয়াদি। তিনটা বাড়ির পরেই কালীমন্দির। পাশে শানবাঁধা পুকুর। আর পুকুরের ওপারেই থাকে দিদিরা।

এদিকে আমার বাবা আলতাফ মেহমুদ চৌধুরী তখন রাজনীতির সোনালী যুগ পার করছেন। সবেমাত্র উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। আমার যখন দুইবছর বয়স, তখন নাকি আমার মা আত্মহত্যা করে। অনেকে এরজন্য বাবাকে দোষারোপ করলেও আমি বাবার সাথে এখানেই থাকি। যদিও বাবা লোকটার সাথে আমার তেমন দেখাই হত না উনার রাজনীতির কারণে। উনি আর বিয়েও করেন নি।

বাড়িতে অনেক কাজের লোক। বৃদ্ধ দিদাও ছিল। আর শম্ভু দা আমার সবসময় খেয়াল রাখত। ডিগ্রি পাস করে সুদর্শন শম্ভু দা বাবার ডান হাত হিসেবে বেশ কিছুদিন থেকেই আমাদের বাসায় থাকে । ব্যবসার দেখাশুনা করে। আমাদের বাড়িটা আবার উপজেলা সদর লাগোয়া হওয়ায় এখনও গ্রামের কিছুটা ভাব রয়েছে। তবে এর পরিবর্তনও হচ্ছে জোরেসোরে।

যাহোক, প্রিয়াদি কখনও আমাকে ডাকত মিট্টু, কখনও রাজকুমার। আমার চেহারা নাকি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করা কোনো এক রাজকুমারের মতো। দিদির এই ডাকগুলো শরতের স্নিগ্ধ বিকেলে সবুজ ধানগাছের উপর বয়ে চলা হাওয়ার দোলার মতো আমার মনকেও উদ্বেলিত, সবুজাভ ও রঙিন করে তুলত। কান পেতে আমি রাতের গভীরেও এই ডাক শুনতে পেতাম বহুদূর থেকে ভেসে আসা ইথারে।

কোনোদিন শম্ভুদা একটু দেরীতে আমাকে নিতে আসলে দিদির কোলে মাথা দিয়ে ঘুমে যেতাম। ঘুমেও আমি টের পেতাম প্রিয়াদি আমার মাথায় কি পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শম্ভু দা কোলে করে আমাকে নিয়ে আসত।

একদিন আমার ভীষণ জ্বর হল। সেসময় আমি নাকি বিড়বিড় করে প্রিয়াদির নাম উচ্চারণ করছিলাম। ফলে দিদি এসে আমার সাথে বেশ কয়দিন আমাদের বাসায় ছিল। আমার সাথে আমার বেডেই ঘুমাত। আমিও দিদিকে জড়িয়ে ধরে কোনো এক অসীম শূন্যতাকে পুরুন করার অক্ষম চেষ্টা করতাম। দিদিও হয়ত টের পেত আমার সেই নিঃসীমতাকে। বুঝতে পেরে আরো শক্ত করে আমাকে চেপে ধরত। আমার জ্বর জনিত উষ্ণতা ও প্রিয়াদির প্রাকৃতিক উষ্ণতা মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত।

এর কিছুদিন পরেই বাবা আমাকে ভারতের দার্জিলিং এর বিখ্যাত সেইন্ট পল স্কুলে ভর্তি করে দেয়। বাবা বলছিল আমাদের নাকি এখানে অনেক শত্রু। আমার মনে আছে যাওয়ার আগের দিন আমি পালিয়ে প্রিয়াদিদের বাসায় গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। পরে যখন শম্ভু দা জানতে পেরে আমাকে আনতে যায় তখন ভীষণ কান্নাকাটি করেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি প্রিয়াদিকে একদিন দেখতে না পারলে বাঁচতে পারব না। আমি বাবার কাছে আবদার করেছিলাম প্রিয়াদিকেও আমার সাথে পাঠানো দিতে। বাবা ধমক দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল।



এরপর আমি প্রিয়াদিকে আর দেখি নি। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি আসার দিন আমার পাশের রুম থেকে একজনের ডুঁকরে কান্নার আওয়াজ শুনেছিলাম। শম্ভুদাকে জিজ্ঞেস করলে বলেছিল বিলুর মায়ের কান্না, যে আমাদের বাসায় কাজ করে। কিন্তু তখন বিশ্বাস করলেও পরে নিশ্চিত হই ওটা প্রিয়াদিই ছিল। শম্ভু দা ঢাকাতে আমাকে কলকাতাগামী বিমানে তুলে দেওয়ার আগে বলেছিল, ‘প্রিয়াঙ্কাটার তোর জন্য অনেক মন খারাপ রে’

এরপর আত্রাই নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। আমি আর কখনই গ্রামের বাড়ি যেতে পারি নি। বাবা তখন সংসদ সদস্য হয়ে ঢাকাতে থাকত। নতুন একটা বিয়ে করেছে। প্রথম প্রথম অনেক কাঁদতাম স্কুল হোস্টেলে থাকতে। একবছর পর পর বাবা গিয়ে আমাকে নিয়ে আসত। দেশে এসে ঢাকাতে আমাদের বাসায় উঠতাম। গ্রামের বাড়ি আসতে চাইলে বাবা আমাকে নিয়ে বিদেশ সফরে বের হত।

এভাবেই ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল শেষ করে আন্ডারগ্রাডের জন্য সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, জুরিখে ভর্তি হই। পরে বাবা মাঝে মাঝে সুইজারল্যান্ডে আসত। আমার আর দেশে আসা হয় নি। গ্রাজুয়েশন করে প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস (পিডব্লিউসি) ফার্মে কন্সাল্টেন্ট হিসেবে লন্ডন অফিসে জয়েন করি। সেখানেই জুলিয়ার সাথে পরিচয়। ও স্প্যানিশ। এক সাথেই জব করতাম। পরে দুজনে বিয়েও করে ফেলি। এরপর নিজেরা প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম চালু করি। এর কিছুদিন পরে দেশে আসি বেড়াতে জুলিয়াসহ।



এদিকে বাবা তখন ডাকসাইটে মন্ত্রী। ঢাকাতে এসে যখন গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য আমি কিছুটা উথলা, বাবা কিছুতেই আমাকে সেখানে যেতে দিবে না। আমি একপ্রকার জোর করেই যাচ্ছি প্রায় আঠারো বছর পর। বাবার মুখে শুনেছি শম্ভু দা নাকি কি একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। গ্রাম এখন শহরের সাথে একিভূত। রাস্তা ঘাট সব পাকা আর পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত। আমাকে বাবার চাচাতো ভাই ও তাদের পরিবারেরা দেখে ভীষণ কান্না এবং শেষে অনেক আনন্দ উচ্ছ্বলতায় সবাই মেতে উঠল। জুলিয়ার কাছে সবকিছু নতুন। সে ভীষণ উপভোগ করছে এসব। এরপর আমি আমার এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে জানতে চাই প্রিয়াদির কথা। ক্ষণিকেই দেখি চারপাশের সব কোলাহল থেমে গিয়ে শ্মশানের নিরবতা।

প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সবাই যেন কিছু একটা লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টায় রত। হঠাৎ করে আমার মধ্যে প্রিয়াদির সেই ঢেউ খেলানো হাসির রূপ চাক্ষুস হয়ে ধরা দিল। আমি ফিরে গেলাম সেই আঠারো বছর আগের সোনাঝরা দিনগুলোতে। তড়িঘড়ি করে জুলিয়াকে ওদের কাছে রেখে প্রিয়াদির বাসার দিকে রওয়ানা হলাম।

কালীমন্দির পার হয়ে কাছাকাছি এসে দেখি সেখানে প্রিয়াদিদের বাসার কোনো চিহ্নই নেই। আগের টিনের ছাউনি দেওয়া ইটের তিনটি ঘরের পরিবর্তে ঝাঁ চকচকে একটি ফ্লাট বাসা। সামনে ফুলের বাগানটা অবশ্য আগের মতোই আছে। কাছে গিয়ে দেখি নেমপ্লেটে লেখা আছে ‘সরদার বাড়ি’। আমার পিছে পিছে তিন চারজনকে দেখছি আসছে। এদের অনেককেই আমি চিনি না। আমাদের পরিবারেরই কেউ হবে।

দুটো ছেলে আমাকে হাত ধরে একটু জোর দিয়েই বলছে, ‘আয়মান ভাইয়া বাসায় ফিরে চলেন’

টিনেজ এই ছেলেকে দিলাম একটা ধমক। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম প্রিয়াঙ্কা দিদিরা এখন কোথায় থাকে? ছেলেটি আমার সাথে ট্রিকস করতে চাচ্ছিল। আমার রাগারাগিতে তারা আমার থেকে পালিয়ে গেল। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে নতুন এই বাসার ভিতরে ঢুকলে বাসার অপরিচিত লোকেরা সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবাইকে ভীষণ ভীত লাগছে। ততক্ষণে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে প্রিয়াঙ্কাদির পরিবারের সাথে মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে।

একজন বয়স্ক মহিলাকে একটু কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

-'এখানে প্রিয়াঙ্কাদিরা থাকত না।’
-'উনারা অনেক আগেই চলে গেছে, বাবা।’ --ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠস্বর।
-'কোথায় গেছে?’ ভীষণ উদ্বেগে জানতে চাইলাম।
-'ভারতে।'
-'আপনারা কি এই জমি কিনে নিয়েছেন?'
-'হ্যাঁ-বাবা।'
-'কে কে ভারতে গেছে?'
-'প্রিয়াঙ্কার বাবা, মা, দাদু, ওর চাচার পরিবার, বড় ভাই স্ত্রী সহ।'
-'আর প্রিয়াঙ্কাদি।'
আমার তখন উত্তেজনায় রক্তচাপ বেড়ে গেছে।

এবার ও পক্ষ চুপ। এবার প্রায় কান্নাজড়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

-'প্রিয়াঙ্কাদি কোথায় গেছে।'

ফ্যাঁস ফ্যাঁসে গলায় বাড়ির একজন পুরুষ জানাল,

- 'এই পাড়াতেই থাকে'

আমি ভীষণ বিস্মিত হলাম। এই পাড়াতেই থাকে। তাহলে এত লুকোচুরি কেন? পুরোপুরি খুলে বললেই তো হয়। ফোনটা বেজে উঠল। মন্ত্রী মানে বাবার ফোন।

-'তুমি প্রিয়াঙ্কাদের বাসার ওখানে কি করছ? এখনি তোমার চাচাদের ওখানে যাও। এলাকায় অনেক রাজনৈতিক শত্রু আছে। এভাবে একাকী কোথাও যেও না। আমি থানাতে বলে দিয়েছি। দুজন কন্সটেবল থাকবে তোমার সাথে।' বলেই লাইন কেটে দিলেন।

বাবার কথাও ফেলে দিতে পারি না। কারণ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ খুব একটা সুস্থ নয়। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসার পথে কালীমন্দিরের কাছে ছেলেবেলার খেলার সাথি অখিলের সাথে দেখা। ঐ এগিয়ে আসল। হয়ত আমার আসার খবর শুনেছে। ছোটকালে কত মার্বেল খেলেছি একসাথে। অখিল হচ্ছে শম্ভুদার ছোট ভাই। অনেক দিন পর দেখা হলেও ওর গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কপালের কাটা দাগটাই অপরিচিত হতে দিবে না।

আমাকে দেখে হাসিমুখে কাছে এল। কুশল বিনিময়ের পরই উদ্বেগে জানতে চাইলাম প্রিয়াঙ্কাদির ব্যাপারে। অখিল সাথে সাথে কাজের অজুহাত দেখিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিল। আমি একপ্রকার জোর করেই মন্দিরের একপাশে নিয়ে বসালাম। ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ লক্ষ করলাম। সঙ্গে কিছুটা ক্ষোভও! অনেক জোরাজুরি করলাম। শেষে নিরাপত্তার আশ্বাস দিলে অখিল খুলে বলল সব।

ওর কাছে যা শুনলাম তাতে আমার কষ্ট ও ক্রোধ একিভূত হয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতির উদয় হল।



আমি দার্জিলিং এ ভর্তি হওয়ার বছরখানেক পরেই দিদিকে আমাদের পদ্মপুকুর গ্রাম থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরের বিলের ধারে কাশবনের ভিতরে অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সাতদিন নিখোঁজ থাকার পর ওভাবে উদ্ধার হয় আমার প্রিয়াদি। পাপিষ্ঠরা মৃত মনে করেই ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু দিদি বেঁচে গেলেন অলৌকিকভাবে। তবে মাথায় আঘাতজনিত কারণে আগের সেই স্বাভাবিকতা আর থাকল না। পাগলের মতো আচরণ করতে থাকলেন। এরপর শৈলেন কাকা অজ্ঞাতনামা কিছু লোকের নামে মামলা করলে পুলিশ তদন্তে এলাকার প্রভাবশালী কিছু মানুষের নাম উঠে আসে। কিন্তু সুচারুভাবে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়া হয়। শম্ভুদার দুর্ঘটনায় মারা যাওয়াটাও ছিল সাজানো। কারণ শম্ভুদা জেনে ফেলেছিল সব। এগুলো এলাকার মোটামুটি অনেকেই জানে কিংবা সন্দেহ করে। কিন্তু কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করে নি ভয়ে।

আমি আগেই বলেছি প্রিয়াদির আগুনঝরা রূপ এলাকায় রীতিমতো রূপকথার মতো ছিল। ফলে অনেকেই চাইত ভাব করতে। এগুলো নিয়ে শৈলেন কাকাও বিব্রত থাকত। শম্ভুদার সাথে বিয়েও ঠিক হয়েছিল। আর বিয়ের মাসখানেক আগেই এই পাশবিক ঘটনা। এবং সবাই অপরাধীদের জানলেও সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে কেউ সাজাপ্রাপ্ত হয় নি। আর এই কষ্টে শৈলেন কাকারা দেশের সবকিছু বিক্রিবাটা করে ভারতে চলে যায়। প্রিয়াদিও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাকারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে নাকি পাগলী প্রিয়াদির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশ কিছুদিন অপেক্ষার পরে পাগলীকে ফেলে রেখেই চলে যায় উনারা। আর ঠিক তার বছরখানেক পরে প্রিয়াদি আবার হঠাৎ উদয় হয় পদ্মপুকুর গ্রামে। এরপর ঐ পাকুড় গাছের গোড়া আর মন্দিরের বারান্দা হয়েছে আবাস। মন্দিরের প্রসাদ খেয়েই বেঁচে আছে। এসব শুনে আমার চোখের পানি বাঁধ মানে না। অখিলের চোখের কোণেও পানি। তার দাদার হত্যাকারীদের চিনলেও কিছু করার নেই।



ভীষণ কষ্টে শুধু বললাম, 'কোথায় পাওয়া যাবে দিদিকে এই মুহূর্তে'। জানালো মন্দিরের ওপাশের পাকুড় গাছের গোড়ায় তাকিয়ে দেখ। সাথে সাথে তাকিয়ে দেখে হাঁটা দেই পাকুড় গাছ বরাবর। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কাছে এসেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি এক নারী মূর্তির সামনে। এই মুখ যতই পরিবর্তিত হোক হাজার মাইল দূর থেকে আমার ভুল হবে না।

অস্ফুট উচ্চারণে কান্নাজড়িত কন্ঠে ডেকে বলি, 'প্রিয়াদি, দেখ আমি তোমার মিট্টু রাজকুমার'

প্রিয়াদি আমার দিকে তাকায় না। কথাও বলে না। নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।

ভীষণ কষ্টে ভাঙা গলায় বলতে থাকি,' ও প্রিয়াদি, একটিবার তাকাও না আমার দিকে। আমি তোমার সেই ছোট্ট মিট্টু প্রিয়াদি। আমার দুষ্টুমিগুলো ভুলে গেলে দিদি। একটিবার তোমার মিট্টুর দিকে তাকাও'।

কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পরে আমার দিকে না তাকিয়ে জীর্ণকায় নারীমূর্তিটি কাঁপা কাঁপা হাতে একটি ছোট্ট বাঁশের কঞ্চি নিয়ে মাটিতে একটি ছবি আঁকছে নিঁখুতভাবে। দেখে মনে হচ্ছে আমার অতি চেনা একটি শিশুর অবয়ব। কান্নায় ভেঙে পড়ে আমি অস্ফুটে বলি, 'তোমাকে যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের শাস্তি পেতেই হবে দিদি। শাস্তি তাদের পেতেই হবে। শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া আমি দেশ থেকে যাচ্ছি না'।

এরপর অনেক কাজ করতে হল আমাকে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত। যার ফলাফলস্বরূপ, এলাকার কিছু অতি পরিচিত মুখের করাদ বাস নিশ্চিত হয়। এবং এ কাজে সাহায্য করেন দেশের একজন নামকরা মন্ত্রী। এছাড়া ব্রিটিশ এমব্যাসিতে দৌড়াদৌড়ি। আয়মান মেহমুদ চৌধুরীর নামের ‘মেহমুদ চৌধুরী’ অংশটি চিরতরে ফেলে দিয়ে সেখানে ‘আয়মান মিট্টু’ নামে এফিডেভিট করা।

একদিন সোনালী সকালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে দেশত্যাগ। আমার বাংলাদেশ ত্যাগের দিন থেকে প্রিয়াদিকে নাকি আর কেউ কালীমন্দিরের আশেপাশে দেখে নি। অখিল একগাল হেসে ফোনে তাই বলছিল।

ও, হ্যাঁ। এর মাঝে দেশের সব কয়টা পত্রিকায় হেডলাইন হয়েছিল--- 'আকস্মিকভাবে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকে এক ডাকসাইটে মন্ত্রীর আত্নহত্যা'র খবরে।

*******************************************************************************************
আখেনাটেন/২০১৯

ছবি: অন্তর্জাল

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:২৫
৫৩টি মন্তব্য ৫৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা-বিরোধীদের হাতে বাংলাদেশের প্রশাসন দেয়াটা অন্যায় হবে।

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৫ ভোর ৬:১৭



জেননারেল জিয়া শেখকে হত্যা করে বাংলাদেশ দখল করেছিলো; এরপর, ক্যান্টনমেন্টে বসে, স্বাধীনতা-বিরোধীদের নিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলো; ইহা ছিলো ক্রাইম। জামাত জাতির স্বাধীনতা নস্যাৎ করার জন্য জাতির বিপক্ষে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন, মহাবিশ্ব খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে; কুরআন কী বলে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ৯:৪০

বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন, মহাবিশ্ব খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে; কুরআন কী বলে?

(মহাবিশ্বের ছবি: ওয়েব থেকে সংগৃহিত)

বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে মহাবিশ্ব এমন হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে যা প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব ইজতেমা কে কেন্দ্র করে চলমান অস্থিরতা নিরসনের উদ্যোগ ফলপ্রসু হয়েছে।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৩


জানুয়ারি মাসের শেষ ভাগে সংঘটিত হওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে মানুষের মধ্যে বেশ অস্থিরতা কাজ করছিল। বিশেষত ২০শে জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসীন হওয়াকে কেন্দ্র করে পতিত স্বৈরাচার অনলাইনে খুব... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। পালিয়ে গেছেন আসিফ-সারজিসরা?

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৪:১৫



একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে কোমলমতি ছাত্রনেতারা পালিয়ে গেছেন । আপনাদের কাছে কিছু তথ্য থাকলে শেয়ার করুন । ...বাকিটুকু পড়ুন

শীতের শহর

লিখেছেন সামিয়া, ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৯:১৪

ছবিঃ নেট

শীত যাই যাই করছে।
ঠোঁট ফেটে জমে, ক্লান্তি চোখের পাতায়
ভাঙা শহরের ভাঙা দেয়ালে
কেউ থাকে, কেউ হয় নিরুদ্দেশ।

পৃথিবীর বুক চিরে
সমাজের পাঁজরে ঢুকে
রক্ত মাখা খোঁচার আঘাত,
জীবন হাসে।

কেউ কেউ হাসে
দু হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×