somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্যগল্পঃ গ্রাফোলজিস্টের বিয়ে

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গ্রাফোলজি নিয়ে জানতে চাইলে গুণী ব্লগার শায়মা'র এই লেখাটি দেখতে পারেন। কারণ ঐ লেখার অনুপ্রেরণাতে এই অাদিভৌতিক? রম্যগল্পের পয়দা। :P



‘তা ধিন ধিন তা। ধিন তা ধিন তা। ধিন ধিন তা তা’। সেই সকাল থেকে কানের ভিতরে বেসুরো এই নৃত্য-গীত বেজে চলেছে। ছুটির দিন একটু আরাম আয়েশে ঘুমাবো সেটাও আর হল না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকেই এসপার-ওসপার হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। টিশার্টটা গায়ে চেপে উপরের ফ্লোরে উঠে গেলাম। কাজের মেয়ে দরজা খুলতেই, ‘ওস্তাত হ্যারিপ্রসাদ বাজনেওয়ালা খাঁ ও তাঁর শিষ্যদেরকে একটু ডেকে দেওয়া যাবে’ মিষ্টি স্বরে জানতে চাইলাম। কাজের মেয়েটি ভড়কে গেছে। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘এহানে ত অস্তাত হ্যারিপ্রসাদ বাজোনওয়ালা কাকু থাহেন না’। সাথেই একজন সুশ্রী মাঝবয়েসী ভদ্রমহিলা এসে ঘটনা জানতে চাইল।

আমি উনাকে জানালাম ওস্তাত হ্যারিপ্রসাদ বাজনেওয়ালা খাঁ ও তার শিষ্যদের সাথে আমার একটু মোলাকাত করা দরকার। জানালাম আমি নিচের ফ্লোরে নতুন উঠেছি। উনি আমাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে বসালেন। তারপর আমার কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার দশা। ভদ্রমহিলার আন্তরিক ব্যবহারে আমিও মুগ্ধ। উনি কথা দিলেন ‘তা ধিন ধিন তা’ সমস্যার সমাধান করা হবে শীঘ্রই। বেশ ফুরফুরা মেজাজে ফিরে আসলাম নিজের ডেরাতে।

সন্ধ্যায় জিম থেকে বাসায় ফিরছি। ধুম করে দুজন রূপবতী মেয়ে লিফটের সামনে মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। চোখ মুখ বেঁকিয়ে জানতে চাইল আমিই মিঃ অয়ন কি না? হ্যাঁ, বলাটা আমার তখনও শেষ হয় নি। মাইরি বলছি,তাতেই শুরু হয়ে গেল কথার ইট-পাথর নিক্ষেপ। আমার ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। শানে নুযুল হচ্ছে আমি নাকি উনাদের গানের মাস্টারকে ওস্তাত হ্যারিপ্রসাদ বাজনেওয়ালাা খাঁ বলে ব্যঙ্গ করেছি। গুরুর নিষ্ঠাবান শিষ্য হিসেবে তাদের তা আঁতে লেগেছে। তাই আমাকে ওস্তাতের কাছে গিয়ে অতি সত্তর ক্ষমা মার্জনা চাইতে হবে। আমি ভিতুর ডিম মিসাইল সদৃশ বাক্যবাণ থেকে বাঁচার জন্য রাজি হয়ে গেলাম। কথা দিলাম ওস্তাতের পায়ে ধরে হলেও ক্ষমা চেয়ে নিব। মানির মান আমি কিছুতেই ক্ষুন্ন হতে দিতে পারি না। রূপবতীরা প্লিজড আমার উদার ব্যবহারে।




আর আমি প্লিজড অন্য কারণে। সে গল্পে পরে আসছি। আগে আমার পরিচয়টা দিয়ে নেই। বাবা-মা-আপা-দুলাভাই মিলে আমাকে উত্তরার সদ্য কেনা ফ্লাটে পাঠিয়েছে। বয়স তিরিশ ছুঁই ছুঁই করছে। বাবা-মা এখনও নাতি-পুতির মুখ দেখল না। এই হতাশায় বাবা প্রতিদিন আমার উদ্দেশ্যে বগুড়া থেকে বাহুবলী স্টাইলে একসঙ্গে চকচকে তিনটে তীর বিচিত্র কায়দায় নিক্ষেপ করে চলেছে।

এই সব কিছুর জন্য দায়ী আক্কাস ভাই। এই বদটা ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার রুমমেট ছিল। একদিন আক্কাস ভাই তার এক বদখত দেখতে টাক্লু বন্ধুর হাতের লেখা দেখে জানাল তার নাকি বিরাট রূপসী বউ ভাগ্য। আমি ভাবলাম ছেঃ। সত্যি সত্যি বছর খানেক পরে পড়াশুনা শেষ হতে না হতেই টাকলু মশাই বিদেশ যাওয়ার আগে অতীব রূপসী একটি মেয়েকে বিয়ে করে বগলদাবা করে বিদেশ পাড়ি দিল। আমি তো টাস্কি খেয়ে গেছি মাইরি! এই টাকলু, ভুড়িওয়ালারা এত সুন্দর বউ পায় কই! দুষ্টু মেয়েগুলোও ক্যামন যেন?

সাথে সাথে আক্কাস ভাইরে গিয়ে ধরলাম। কীভাবে, ভাই? উনি হাতের লেখা মানে গ্রাফোলজির কিছু বিষয় খুঁটিনাটি জানাল। আমিও তড়িঘড়ি করে আমার হাতের লেখা দেখালাম। আমার লেখা দেখে আক্কাসইসা মুখটা কুট কুট করে কামড়ানো আমাশয় রোগীর মতো করে বলল, ‘ছেলে হিসেবে তুই বেফাজিল হলেও ভোলাভালা, তবে তোর রূপসী সৎচ্চরিত্র বউ ভাগ্য মনে হচ্ছে বেশ গোলযোগপূর্ণ হবে। ‘জ’ ও ‘প’ বর্ণ দুটি বেশ গণ্ডগোলে ঠেকছে’।

এর কিছুদিন পরেই আক্কাস ভাইও বিদেশ চলে গেলেন আমার ভোলাভালা ভাগ্যাকাশে বিশাল এক কাল মেঘের গণ্ডগোলে ছাতা টানিয়ে দিয়ে। এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই ‘জ’ ও ‘প’র জন্যই আমার প্রেম জমে ক্ষীর হওয়ার আগেই ফাঙাসের আক্রমণে গন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমি ছাত্র হিসেবে প্রথম সারির। চেহারা-সুরতে খোদা কি খাস্তা মাশাল্লা। ধনী বাপের একমাত্র পোলা। আচার-আচরণেও পাশের বাড়ির ভালো ছেলেটির মতো। তারপরও দুষ্টু মেয়েগুলো আমাকে এড়িয়ে চলে। এবার কারণটা খুঁজে পেলাম। ‘প’ ও ‘জ’র সমস্যা। সেদিন থেকেই লেখার সংশোধনে উঠে পড়ে লাগলাম। গ্রাফোলজির খুঁটিনাটি নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলাম। একটাই স্বপ্ন বউভাগ্য পাল্টাতে হবে।

দুই বছরের সাধনায় লেখাকে ত্রুটিমুক্ত করলাম। এরপরে দুলাভাইয়ের এক রূপসী মেয়ে কাজিনের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেল। টানা কয়েক মাস চুটিয়ে প্রেম। গ্রাফোলজির বিদ্যা বেশ কাজ দিচ্ছে মনে হচ্ছে। এদিকে পাশ করে আমিও স্বাবলম্বী। বাবা-মা ধরলেন বিয়ে করতে হবে। প্রেমিকাকে জানালাম। সে তো মহা খুশি। আমিও খুশি। সবাই খুশি। দুলাভাই খুশি। বগুড়া খুশি। যাক এতদিনে কাজের মতো একটি কাজ হয়েছে। এবার আমার গ্রাফোলজির বিদ্যাটা একটু জাহির করতে মন চাইল। ওর হাতের লেখা দেখাতে বললাম। বিয়ের কয়দিন আগে ও আমাকে কয়েকটা বাক্য লিখে দিল। যদিও ও জানে না আমি লেখা বিশারদ।

বাসায় এসে ভয়ে ভয়ে খুললাম লেখার কাগজটি। শুরুতেই ‘ক’ বর্ণটি দেখে চেয়ার থেকে ঠাস করে পড়ে যাওয়ার দশা। ‘ক’র মাথাসহ ঠোট এতটাই নিচে নেমে গেছে, মনে হচ্ছে এই মেয়ে দোতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিচতলা থেকে টপাটপ রসের নাগর তুলে ঘরে নিচ্ছে ফস্টিনস্টি জন্য। আমি হতাশ! এই মেয়েকে বিয়ে করা কিছুতেই সম্ভব না। আমাকে কত নম্বর হিসেবে তোলার জন্য বেলকনিতে দাড়াইছে আল্লাহ মালুম! বিয়ে ক্যানসেল।

কয়েক মাস ‘ক’র লম্বা ঠোঁটের শোকে পাথর হয়ে থাকলাম। রাজশাহী শহরের সাহেব বাজারে একটি আইটি ফার্ম দিয়েছি। বেশ জমজমাট অবস্থা। একদিন দেখি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই’র একটি মেয়ে ইন্টার্নি করতে এসেছে। নাটোর বাড়ি। রূপে বনলতা সেনের ছোটবোন। প্রথম দেখাতেই মনে হল এই সেই মেয়ে যাকে আমি খুঁজে চলেছি। কি চোখ! কি ঠোঁট! কি…! খাসা মাইরি! অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বেশ ভাব হয়ে গেল।

মুচি ভাইয়েরা যেমন পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকেদের জুতার দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক আমার অবস্থাও হয়েছে এমন যে মেয়ে দেখলেই হাতের লেখা পরীক্ষা করার জন্য খাতা-বইপত্র দেখতে মন চায়। এই মেয়ের সিভিতে শুধু সাইনটা দেখেছি। প্যাঁচানো তিনটা ইংলিশ আলফাবেটের সাইন। নিচে লম্বা টান ও ফোটা দেখে বুঝা যাচ্ছে মেয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। এই সকল মেয়ে জীবনে সফল হয়। এর বেশি কিছু জানতে পারি নি। যদিও আমি বাংলা লেখার স্ট্রোকগুলো বেশি ভালো পড়তে পারি।

কয়েকদিন পরে বাংলা লেখা হাতে আসল। এরপর ঐ মেয়ের ছায়া মাড়াতেও আমার ভয় লাগছিল। বিশেষ করে ‘ঘ’ বর্ণের উপর দিকের মাত্রাতে ছোট্ট ফুটোটি সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফুটোটি জানিয়ে দিচ্ছে খিড়কির দরজা দিয়ে কেউ একজন প্রতিদিন ঘরে ঢুকে হা-ডু-ডু খেলে ট্রফি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। খিড়কির রাস্তাটাও বেশ মসৃন। মানে নিয়মিতই খেলাধুলার আয়োজন হয়। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। এ জীবনে বিয়ে আর করা হল না রে মনু!!



এভাবে আরো সাতটা মেয়ে ‘ন’, ‘দ’, ‘ব’, ‘চ’, ‘ম’, ‘ঝ’, ও ‘’ত’র পাল্লায় পড়ে বিদায় হয়েছে। আর রাজশাহীতে আমার নামও ছড়িয়ে পড়েছে কুখ্যাত গ্রাফোলজিস্ট হিসেবে। প্রতিদিন গড়ে বিশজন যুবক-যুবতী-মধ্যবয়সীরা আমার কাছে আসছে নিজেদের প্রেমিক-প্রেমিকা ও হাসবেন্ড-ওয়াইফদের লেখা নিয়ে রহস্য উদঘাটনে। প্রায় আশিভাগ সফলতায় আমি এখন কিছুটা জ্যোতিষবাবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। আমারও খারাপ লাগে না বিষয়টি। হা-ডু-ডু খেলোয়াড়েরা এখন আমাকে দেখলে দশহাত দূর দিয়ে যাতায়াত করে। ব্যাপারটি আমিও বেশ উপভোগ করি।

কথায় আছে সুখ বেশি দিন সয় না। এই উপভোগ করাটাই কাল হল। একদিন একটি মেয়ে আসল তার প্রেমিকের লেখা নিয়ে। ‘ঙ’ বর্ণের উলটাপালটা প্যাঁচানো স্ট্রোক দেখে মনে হল এই হারামজাদা কমপক্ষে চারজনের সাথে একইসঙ্গে নৌকাবাইচে নেমেছে। ‘ঙ’র উপরের বেশ লম্বা টান দেখে বুঝা যাচ্ছে এ ব্যাটা বৈঠা ফার্স্টক্লাস চালাতে পারে। মেয়েটিকে জানাতেই কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেল।

সন্ধ্যায় ষণ্ডামার্কা এক যুবক দলবল নিয়ে অফিসে এসে কোনো কথা ছাড়ায় অফিসের সব স্টাফদের তামিল রজনীকান্ত স্টাইলে মার শুরু করে দিল। দুই রাউন্ড মার শেষে শাসিয়ে গেল সাত দিনেই এখান থেকে বিদায় নিতে। হুমকী দিল, না হলে পদ্মার জলে জ্যোতিষীর তেলতেলে দেহখান কুমীর দিয়ে খাওয়ানো হবে। মনে মনে ভাবলাম এই রজনীকান্ত গর্দভকে কে জানাবে পদ্মার জলে কুমীর নেই!

যাহোক, জানের মায়া। পাতাতাড়ি গুটিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে মানে বগুড়াতে ফিরে আসলাম। বিয়ে নিয়ে বেশ টেনশনে আছে পরিবার। গ্রাফোলজি আমার জীবনে শনি হয়ে এসেছে। নতুন করে সব শুরু করার উদ্দেশ্যে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল আমাকে ঢাকা পাঠাবে। উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরের এই ফ্লাট কিনে এখানেই থাকছি এই মাস থেকে। পাশেই আইটি ফার্মটি আবার চালু করেছি। এরপরই সেই তা ধিন ধিন তা সমস্যা। আর আমার বিয়ে নামক জটিল প্রোগ্রামিং এর সমাধানের সূত্র খুঁজে ফেরা। যদিও সেই শুরু থেকেই লুপের মধ্য আটকে আছি।

ইতোমধ্যে আমার বর্তমান অবস্থানও কিছু পুরাতন খরিদ্দার জেনে গেছে। ঢাকাতেও লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। গ্রাফোলজিস্টের এত কদর! রাজশাহীর হা-ডু-ডু খেলোয়াড়গুলো তো একটা দুটাতেই সীমাবদ্ধ থাকত। ঢাকারগুলো মদনরাজ কিংবা শিলা কি জওয়ানী। এরা ডাবল ডিজিটে বিশ্বাসী মনে হচ্ছে। আরো হতাশ হয়ে পড়লাম। মনে মনে বললাম, বিয়ে আর হল না রে মনু, বিয়ে আর হল না!!!


তা ধিন ধিন তা’র সুত্রে ওস্তাত হ্যারিপ্রসাদ বাজনেওয়ালা খাঁ’র বড় শিষ্য পরমা’র সাথে ইদানিং বেশ ভাব হয়েছে। একা একা ফ্লাটে থাকি। মাঝে মাঝে আন্টি দেখি খাবার-টাবার পাঠায়। ওস্তাতের শিষ্যরাও গল্প-গুজব করার জন্য আসে। আমি তক্কে তক্কে আছি এর ফাঁকে পরমার হাতের লেখাটা চেক করা। পরমাকে আমার পারফেক্ট ম্যাচ মনে হচ্ছে। হাঁটার সময় কি ছন্দ মাইরি! এই মেয়ে আমার বউ না হলে জীবন কুরবান করে দিমু এরকম একটা মনে মনে পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তারপরেই ভোজবাজীর মতো সবকিছু ঘটে গেল। বাবা-মা বগুড়া থেকে এসে আট দিন ধরে আছে। সারাদিন দেখি পরমাদের ফ্লোরে গিয়ে পড়ে থাকে। কী নুটুঘুটু করে আল্লাহ মালুম!

কিছু বুঝে উঠার আগেই বাবা-মা, আপা-দুলাভাইয়েরা এসে পরমার সাথে আমার বিয়ে পড়ে দিল। আমি চিৎকার চ্যাঁচামেচি করলাম। হাত-পা ছুঁড়লাম। অন্ততঃ একবার পরমার হাতের লেখাটি দেখতে দেওয়া হোক। আমার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না।

খুঁতখুঁতানি থাকলেও মনে মনে একদিক থেকে আমিও বেশ খুশিই হলাম। যাক, এতদিনে ফাঁড়া কাটল।




বিয়ের দিন পরমাকে জানিয়ে দিয়েছি ওর লেখা দেখা ছাড়া খাটে উঠুম না। সন্ধ্যার পরে ওকে ফোন দিলাম লেখা কই?

পরমা তখন উপর তলাতে। ফোনে জানাল লেখাটি নাকি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছে। দুরু দুরু বুকে তাড়াতাড়ি বের করলাম। শুরুতেই কয়েকটি স্ট্রোক দেখে আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেল। আমি ফাঁদে পড়েছি রে বগা। আমি ফাঁদে পড়েছি। কেউ আমারে আর বাঁচাতে পারবে না! এই ছিল শেষে আমার কপালে। হায়, হায়, এ আমি কাকে বিয়ে করলাম! ‘ভ’, ‘থ’, আর ‘গ’র স্ট্রোক দেখে আমার অজ্ঞান হওয়ার দশা। ‘ভ’র পেট এত নিচে…’থ’র বিশাল ফাঁক…’গ’ ঠ্যাং মেলে দিয়ে পড়ে আছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। সবগুলো বর্ণের স্ট্রোক দেখে হিসেব করলাম অসংখ্য নাগরের কোলে উঠে কুতকুত খেলেছে পরমা। ও মাই কাউ। আমার কান্না পাচ্ছে। এ আমি কাকে বিয়ে করলুম?


নিশুতি রাতে ও ঘরে ঢুকল। আমি ওর মুখের দিকে ঘৃণায় তাকাতে পারছি না। আড়চোখে দেখে বুঝতে পারছি শয়তানী মেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমার গা জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে এখনি বেলকনি থেকে ঝাঁপ দিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করি।

ও ধীরে ধীরে আমার পাশে এসে বসল। আর আমার গায়ে হুলের মতো ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। ও দেখি আমার মুখটা টেনে ঘুরিয়ে নিচ্ছে। শয়তান মেয়ে। বিচ্ছু মেয়ে। আমার জীবন মাটি করে দিল, তামাতামা করে দিল।

-’গ্রাফোলজিস্ট সাহেব বউয়ের কতগুলো প্রেমিক সন্দেহ করছেন, জানতে পারি কি?’ নির্লজ্জ মেয়ের প্রশ্নের ধরণ দেখে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।

উত্তর না দিয়ে কড়া চোখে তাকালাম। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে চাহনি কড়া না হয়ে মনে হয় পুষি বিড়ালের মতো মিউ মিউ টাইপের হয়ে গেছে। শয়তান মেয়ে তা দেখে ফিক করে হেসে দিল।
আমার অসহায় অবস্থা দেখে পরমা আমার হাতে আরেকটা কাগজ গুঁজে দিল। অনিচ্ছায় খুলে দেখলাম। ঝকঝকে মুক্তোর মতো লেখা। প্রতিটা স্ট্রোক পারফেক্ট, নিষ্কলুষ। ওর দিকে তাকালাম বিস্মিতভাবে।

-’আমার লেখা’-- বলে পরমা কোমর দোলাতে দোলাতে বাথরুমে প্রবেশ করল। আর আমি অধিক বিস্ময় নিয়ে পিছু পিছু বাথরুমের দরজাতে গিয়ে থাবা দিয়ে ঢোক গিলে জানতে চাইলাম তাহলে আগের লেখাটি কার? বেশ কিছুক্ষণ পর পরমা বের হয়ে জানাল আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে দিয়ে একটি মেয়ের লেখা আনতে বলেছিল। সেই ড্রাইভারের পরিচিত মেয়ের লেখা ঐটি। আমার আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছে। ঝাঁপ দিয়ে হা-ডু-ডু খেলার ছলে পরমাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম।

কিন্তু ও আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে জানাল আমার হাতের লেখাও সে দেখবে। সেও নাকি এই কিছুদিনে গ্রাফোলজি নিয়ে বেশ জেনেছে। আমিও এরকম কিছুই একটা সন্দেহ করছিলাম। আগেই একটি লেখা লিখে রেখেছিলাম। ড্রয়ার খুলে একটি কাগজ এগিয়ে দিলাম। পরমা লেখা দেখে মুখটা কালো করে ফেলল। অনেক স্ট্রোকের গণ্ডগোল।

তাড়াতাড়ি আমি লেখাটি দেখলাম। আরে এত আমার লেখা নয়। কার লেখা এটি। পরমা বিশ্বাস করে না। কাঁদাকাটি শুরু করেছে। শেষে আমার লেখাটি খুঁজে বের করলাম। তাহলে ঐটি কার লেখা? অবশেষে জানা গেল ড্রাইভারকে ও যখন লেখা আনতে বলে প্রথমে ড্রাইভার নিজের লেখাই দিয়েছিল কাজের লোকের হাতে। পরে মেয়ের লেখা দিলেও ড্রাইভারের লেখাটি ড্রয়ারেই ছিল।

ড্রাইভারের লেখার স্ট্রোকগুলো খুঁটিয়ে দেখলাম। হালার পো কমপক্ষে এগার জনের সাথে কুতকুত খেলেছে। মনে হচ্ছে খচ্চরটার রেড লাইট এরিয়াতে নিয়মিত যাতায়াত আছে। পরমাকে আদর করতে করতে সিদ্ধান্ত নিলাম ড্রাইভারের চাকরি নট। বারতমের ঝুঁকির মুখে পরমাকে রাখা যাবে না।

‘বারতম’ শব্দটা মনে হয় জোরেই উচ্চারণ করেছিলাম। পরমা জিজ্ঞেস করল, ‘বারতম নিয়ে কি বলছ’? আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘না, মানে আমাদের একজন অতিরিক্ত ফিল্ডারসহ একডজন বাচ্চার ক্রিকেট টিম হলে ক্যামন হয়’? ফিসফিস করে বলেই ‘ক’ য়ের মাথাসহ ঠোঁটটা নামিয়ে দিলাম দুতলার বেলকনি থেকে গভীর গিরিখাদে!!!!

*************************************************************************************************************
আখেনাটেন/অক্টো-২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩০
৪৯টি মন্তব্য ৪৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভারত অনেক চেষ্টা করেও দ্বিমুখী আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:০৮



সামু ব্লগে ৪ জন ভারতীয় একটিভ ব্লগার আছেন; এরা সামু থেকে সম্ভাব্য আক্রমণের কথা নিশ্চয় ভারত সরকারকে জানাচ্ছে। সামুতে যেই পরিমাণ জেনারেল আছেন ও যেই পরিমাণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৩




বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দাবি করে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের (বিজেপি) নেতা দিলীপ ঘোষ। এছাড়া বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তিনি। শুক্রবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩



বাংলাদেশে হামলার চেষ্টা করতে পারে সন্ত্রাসীরা— এমন আশঙ্কা থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের সতর্ক করেছে যুক্তরাজ্য।

কোথায় সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে নির্দিষ্টভাবে তা বলা না হলেও রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে ভ্রমণ থেকে বিরত... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে প্রেমে অশ্রু ঝড়ে

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৪৫


মিষ্ট কথার স্মৃতিতে মন যার ভরে না
সুখ স্বপনের স্মরণে হৃদয় যার ঝরে না
যাদের চোখে অকারণ অশ্রুর ধারা বয়
রাতের বাতাসে জাগে না যার হদয় ।

পল্লী সমিতির বিদ্যুতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা মিলে আমাদের একটি বড় রাষ্ট্র ছিল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০৭



ইংরেজ হানাদারের আগে আমাদের বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা মিলে একটি বড় রাষ্ট্র ছিল। সেই রাষ্ট্র হারানোর পিছনে অনেকে মীর জাফরকে অনেকাংশে দায়ী করেন। একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×