১
গল্পঃ কাউয়ালী দর্শন
নিজামদ্দিন আউলিয়ার মাজারশরীফ। প্রতিদিন শতশত ভক্তকূল তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাচ্ছে। প্রতি বৃহঃস্পতিবার রাতে করে ভক্তদের জন্য কাওয়ালীর আসর বসে। সুফিবাদী এই সংগীতের প্রতি হালকা টান থাকাতে একদিন যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম।
সাথে এক ভারতীয় (অন্য ধর্মের হলেও সে নাকি এর আগেও গেছে সেখানে) বন্ধুকে নিয়ে গেলাম। উপমহাদেশের আর দশটা মাজারের মতোই এটিও। তবে বাংলাদেশেরগুলো থেকে কিছুটা পরিষ্কার আছে। কাওয়ালী মূর্ছনায় হারিয়ে গেলাম জাগতিক পেরেশানি থেকে। এরপর চারিদিকে একটু লক্ষ করে দেখলাম ধর্ম-বর্ণ-গোত্র এই জায়গায় এসে মিলে-মিশে একাকার।
মাজারে যা হয়। সন্ধ্যার সময় গাড়িচালককে যখন মাজারে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন সে মুচকি হেসেছিল। তখন এর মাজেজা বুঝি নি। চারপাশের পরিবেশ দেখে বুঝে নিলাম কেন চালক হেসেছিল?
ভিতরের গল্পঃ মাজার একটি ব্যবসা কেন্দ্র। এখানে বহুরূপী মানুষ ধর্মের আড়ালে তাদের লোভের চুড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখায়। উপমহাদেশের একই রূপ। বাতাসে কটূ গন্ধ।
২
গল্পঃ তুলনা
চানক্যপুরি। ফরেন অ্যাফেয়ার্স অফিস। লিফটে উঠেছি। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে ছিলামাথার দুই পুলিশ অফিসার লিফট আটকিয়ে দিল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বারাম ও কপিল সিবাল উপরে যাবেন। আমিসহ অন্যরা লিফট থেকে বের হতে গেলেই মন্ত্রীরা এসে থাকতে বললেন। আমাদেরটাই জায়গা না হওয়াতে অন্য আরেকটিতে মন্ত্রীর সঙ্গের লোকেরা উঠার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। দশজনের মতো ধারণ ক্ষমতার লিফটে মন্ত্রীসহ সকলে উপরে উঠে আসলাম।
ভিতরের গল্পঃ ভারত-বাংলাদেশ খুব একটা পার্থক্য না থাকলেও রবার্ট ফ্রস্টের ভাষা একটু ঘুরিয়ে বলতে হয় ‘
The woods are lovely, dark and deep,
But we have promises to keep,
And miles to go before we sleep,
And miles to go before we sleep.
৩
গল্পঃ রসনাবিলাস
চৈত্রমাসে গরু হারালে যেমন গ্রামীণ কৃষককুল মাথা গরম করে গরু খোঁজা শুরু করে, ঠিক তেমনি আমরাও সেন্টুর হোটেলে রুটিন খাবার খেতে খেতে রুচির আধামরা অবস্থা হোওয়াতে গরুর মাংসের সন্ধানে চিরুনি অভিযান শুরু করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য সম্ভাব্য সব উৎস থেকে নেগেটিভ ফল পেলাম। পরে হাল ছেড়ে দিয়ে কুরবানীর দিনেও দিল্লী জামে মসজিদে নামাজের পর মুরগী দিয়ে কুরবানী। সেন্টুরের বিস্বাদ খাসির মাংসের যমের অরুচি ধরেছে ইতোমধ্যে। এই খোঁজাখুঁজিতে একটি ভালো দিক হয়েছে দিল্লীর আনাচে-কানাচে খাবার পরখের মহড়া হয়েছে। বাটখারাতে মেপে যে ভাত-বিরিয়ানি খাওয়া হয় তা দিল্লীবাসীর ঐতিহ্য।
মহিপালপুরে এক চাচার রেস্তরাঁতে বাসুমতী চালের হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি। ওফ, জিবে স্বাদটা এখনও লেগে আছে। নিজামের মাজারের কাছে হোটেল ইকবালে কাবাব ও আশেপাশের ছোট হোটেলগুলোর বিভিন্ন পদ। অসাম। দিল্লী জামে মসজিদের কাছে বিখ্যাত করিম’স সহ আশে পাশের বেশ কয়েকটি রেস্তরাঁ। নেহেরু প্যালেসের কাছে কোরেশী’র রুমালী রুটি ও চিকেন। সরোজিনীনগরের কিছু দক্ষিনী খাবার। জাফরানের ছোলা বাটুরে। আরো অনেক জায়গায় গিয়েছি খাবার পরখ করতে। তবে সবচেয়ে বেশি খেতে গিয়েছি জেএনইউ (জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যাল) এর ভিতর ২৪/৭ রেস্টুরেণ্টে। দামে সস্তা। গুণেমানে টপ ক্লাস। প্রায় সারারাত দেশি-বিদেশি গ্রাহকে খোলামেলা চারপাশে জমজমাট। সেখানের বাটার চিকেন, বাটার নান, ফ্রাইড চিকেন মমোস ও স্বল্পমূল্যের বাটার স্কচ আইসক্রিম সহ নানা পদের খাবারের কোনো তুলনা হয় না। জোছনারাতে খোলা আকাশের নিচে বসে মাঝরাতে খাওয়া ও আড্ডা। ওফ, দারুণ। ভোলার নয়। যদিও হোটেলে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যেত।
ভিতরের গল্পঃ খাওয়ার ব্যাপারে কিপ্টামোতে কলকাতাকে ০-১০ গোলে পরাজিত করবে দিল্লীবাসি। দুই-তিনজন প্রফেসরকে দেখেছি আলুর দম ও ভেন্ডি(ঢেঁড়স)ভাজি আর পোড়া গমের রুটি দিয়ে দিনের পর দিন লাঞ্চ সারতে। তাই সস্তায় চমৎকার সব নন-ভেজ খাবারের জন্য একবার হলেও জেএনইউ যাবেন।
৪
গল্পঃ ফারাক
হঠাৎ জানলাম ঢাকা থেকে এক মহিলা প্রফেসর দিল্লীর একটি ইউনিতে পড়াতে আসছে এক বছরের জন্য। সাথে ভারতীয় বন্ধুকে নিয়ে কয়েকজনে মিলে বাসা খুঁজতে বের হলাম। এক রুমের এপার্টমেন্ট দরকার। যে বাসায় যাই বাসা দেখানোর পর কে থাকবে এটা জানার পর আর রাজি হয় না। যদিও আমরা চলতি ভাড়ার চেয়ে বেশি দিতে রাজি। কারণটা নিশ্চয় এতক্ষণে অনুমান করতে পারছেন। বেশ কিছু বাসা দেখলাম। ভালো খারাপ মিলে। কোনো বাসার মালিকই রাজি না।
অবশেষে অনেক শর্তের বেড়াজালে একজন রাজি হল মতি মর্গের কাছে। এক রুম। এক বাথ। ছোট্ট একটি ডাইনিংসহ ড্রয়িং রুম। ভাড়া-৫০,০০০ রুপি প্রতি মাস। ছয়মাস অগ্রিম। দুর্দান্ত কিছু অভিজ্ঞতা পকেটে ভরলাম বাকি জীবন গল্প ফাঁদার জন্য।
ভিতরের গল্পঃ আর্যরা উপমহাদেশে এসে শুধু মানুষের মধ্যে শ্রেণিভাগই করে নি। এটি আমাদের জিনে বিল্ড ইন হয়ে এখন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হচ্ছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে এই অংশটুকু কেটে না ফেলা পর্যন্ত এটি মনে হয় বাহিত হতেই থাকবে।
দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-১
ছবি: লেখক। প্রথমটি কুতুবমিনারের। দ্বিতীয়টি কুরবানী ঈদে দিল্লী জামে মসজিদে তোলা। তৃতীয়টি লোটাস টেম্পল।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩৪