-মিলছে না মানে,কাল না অংকটা করে দিলাম।
-স্যার,এটা করে দেননি তো।
-কই দেখি?
হ্যাঁ আসলেই অংকটা করে দেয়া হয়নি।এবং অংকটা বেশ জটিল।শুধু শুধু ওকে একটা ধমক দেয়া হল।টাকার চিন্তায় মাথাটাই যেন একে বারে খারাপ হয়ে গেছে।
মেসে ফিরে দেখে মিলে টাকা নেই।মিল বন্ধ।এদিকে রিয়াদের পকেট একদম শূন্য।কোন কুল কিনারা না দেখে শুয়ে পড়ল রিয়াদ।পেটের ভিতর ক্ষুধার পোকাটা ঝিঁ-ঝিঁ করে ডাকছিল এতক্ষন।কোন সাড়া না পেয়ে এবার কুট কুট করে কামড়াতে শুরু করে দিল।রিয়াদ পাত্তা না দিয়ে বালিস চেপে ধরে অসহায়ের মত পড়ে রইল।রুম মেট যখন রাতে বাইরে খেতে গেল তখন বলল ক্ষিদে নেই।সে টিউশনি বাসা থেকে খেয়ে এসেছে।রুম মেট চলে গেলে পরপর দু'গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমাতে গেল।কিন্তু ঘুম আর আসছিল না।ক্ষিধে পোকাটার দম বোধ হয় বেশ লম্বা।একটানা কুট কুট করছে তো করছেই।এতক্ষনে মনে হল সাড়া না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।কামড়ানো থামিয়ে দিয়েছে।এইবার ঘুম রিয়াদের চোখে জাপটে আসতে লাগল।
মিলির বাসা যশোর ।কাল পৌঁছতে হলে আজকে বিকেলেই টিকিট কনফার্ম করতে হবে।রাতে গাড়ি।রিয়াদ মুঠোফোনটা বের করে মিলির পাঠানো ক্ষুদে বার্তাটা আর একবার দেখে নিল।আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব......মিলি।ভেবে চিন্তে কিছু না পেয়ে রিয়াদ একটা নাম্বার ডায়াল করল।ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই রিয়াদ বলল।আপনার নাম্বারটা আমি ব্লগে পেয়েছি।আপনার ও পজেটিভ রক্তের দরকার ।আমি দিতে রাজি আছি।
-থ্যাংক ইউ বাবা ।তাহলে তো আমার বেশ উপকার হয়।
-কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে ।
-কি শর্ত বাবা?বল আমি সব শর্ত মানতে রাজি আছি।
-আমি আপনাকে রক্ত দিব ।বিনিময়ে আমাকে দু'হাজার টাকা দিতে হবে।টাকাটা আমার খুব প্রয়োজন।
-তুমি চলে এসো বাবা।আমরা ব্লাড ব্যাংকে রক্তা পাচ্ছিলাম।কিন্তু সেই রক্ত নিতে চাচ্ছিনা।
-রক্ত দেয়ার পর তিন হাজার টাকা রিয়াদের হাতে গুজে দিয়েছিল।কিন্তু রিয়াদ দু'হাজার রেখে বাকি টাকাটা ফেরত দিয়ে বলল,মাফ করবেন আমার দু'হাজার টাকারই প্রয়োজন।বলেই দ্রুত চলে আসল।
রাস্তায় কোন ঝামেলে না হলে সকাল আটটার মধ্যে সে যশোর নামতে পারবে। মিলি তার জন্য অপেক্ষা করবে।শেষ পর্যন্ত মিলির পছন্দের পিঙ্ক কালারের ড্রেসটা একহাজার টাকার মধ্যেই মেনেজ করা গেল।কাল ওর জন্মদিন।মিলির গাড় কাল চোখের তীক্ষ্ণ চাহনি আর হাসি লোকাতে চাওয়া হাসি হাসি মুখটাকে মনে করে সকল ঝক্কি ঝামেলার কথা ভুলে গেল।
গাড়ীর জানালা একটু খোলে দিল রিয়াদ।বাইরের ঠান্ডা হাওয়া তার মুখে যেন একটু একটু করে কাঁটা কাচের মত ভিতরে ঢুকতে লাগল।চিন্তায় শিঠিয়ে থাকা স্নায়ু গুলো যেন ঠান্ডা পেয়ে জেগে উঠতে থাকল। ভালই লাগতে ছিল রিয়াদের ।কিন্তু পাশের সিটের ভদ্র লোকের করণে বেশি ক্ষন আর খোলা রাখা গেল না।
রক্তটা বোধ হয় একটু বেশিই দেয়া হয়ে গেছে ।ডাক্তার এক ব্যাগের বেশি নিতে চাচ্ছিল না।কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই ব্যাগই দিল রিয়াদ।তাই এখন খারাপ লাগছে।প্রচন্ড দুর্বল লাগছে।সেই সাথে জাপটে আসছে ঘুম।কিন্তু গাড়িতে রিয়াদ ঘুমাতে পারেনা।মাঝে মাঝে অন্য গাড়ির পাশদিয়ে অতিক্রম করার সময় শব্দে কিংবা ব্রেক কষলে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।আজকে যেন ও সব কিছুই মানছিল না।চোখের পাতা জাপটে ধরা ঘুমে আর সে কিছুই মনে করতে পারছিলন।সকাল বেলা সুপারভাইজারের ডাকে যখন চোখ খুলল তখন দেখল চারদিকে চকচকে আলো ।শীতের সকালে শিশির বিন্দুর উপর রোদের কিরণ লেগে কেমন যেন আশ্চর্য পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
বাস স্ট্যান্ডে নেমেই দেখে ভোরের স্নিগ্ধতা নিয়ে কোনার দিকে দাঁড়িয়ে আছে মিলি।কিন্তু তার সেই স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে রিয়াদের দুর্বলতাই যেন তাকে জেকে ধরল।কোন রকমে দুর্বলতাকে ছাপিয়ে মিলের কাছে গিয়ে বলল ´হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ ........´।কিন্তু সে মুখে ক্লান্তির ছাপ যেন লেগেই রইল।শত চেষ্টা করে যে টুকু হাসি হাসি ভাব মুখে আনা গেলে তাতে ক্লান্তির ছাপ দূর করা গেল না।মিলি অবশ্য একবার বলেছিল ,তোমাকে এমন লাগছে কেন?রিয়াদ বলেছে সারা রাত জেগে এসেছিতো তাই ।
প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে রিয়াদের ।কোন রেস্টুরেন্টে বসতে চাইছিল।কিন্তু মিলি নাকি নডুলস নিয়ে এসেছে।তাই পার্কের দিকে রিক্সা নিল।রিক্সার ঝাকিতে তার কেমন যেন বমি বমি আসতে চাচ্ছিল।কোন রকমে তা দুর করতে পেরেছে।রিক্সা থেকে নেমে পার্কের কোন কোনায় সুবিধা জনক স্থান খোঁজতে ওরা হাঁটছে।শেষতক কোনার দিকে একটা বেঞ্চিতে বসল।
বেলা বেশ চড়েছে।এর মধ্যেই ঘটল বিপত্তি।রিয়াদের শরীর যেন বিদ্রোহ করে বসল।মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গিয়ে বসে পড়ল বেঞ্চির উপর।হতবাক হয়ে গেল মিলি।রিয়াদকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার জন্য জোর করতে লাগল।কিন্তু রিয়াদ যেতে রাজি হলনা।বলল,জার্নি করে এসেছি তাই হয়তো খারাপ লাগছে।কিন্তু মিলি নাছোড় বান্দা,ডাক্তারের কাছে নিয়েই যাবে।রিয়াদ কোন ভাবেই যাবে না।এর আগে এ রকম হয়েছে কিনা মিলি জানতে চায়।রিয়াদ না বলে।কেন হঠাৎ করে এমন হল তা জানার জন্য মিলি যখন চাপাচাপি করতে লাগল।তখন রিয়াদ তার রক্ত দেয়ার কথা বলল।
শুনে মিলির ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকল এবং চোখ বেয়ে নেমে এল জলের ধারা।রিয়াদ ওর দিকে তাকাতেই তার কান্নার বেগ যেন বেড়ে গেল।বাঁধ ভাঙ্গা সেই কান্নাকে থামাতেই যেন আশ্রয় নিল রিয়াদের বুকে।বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল।আর রিয়াদের ক্লান্তি যেন নিমিশেই উবে গেল।নরম স্পর্শ আর চোখের পানির দাওয়াই পেয়ে যেন তার স্নায়ু গুলো উতেজ্জিত হয়ে উঠল।তার জন্য কেউ কাঁদতে পারে ভেবে তার চওড়া বুকটা যেন আর একটু স্ফিত হয়ে গেল।হৃদয়ে গহীনে মিলির জন্য যে টুকু জায়গা ছিল তা যেন আর একটু স্ফিতি লাভ করল।মিলির মাথায় হাত রেখে যখন বলল,কেঁদো না জানু,সব ঠিক হয়ে যাবে।ওমন একটা সমস্যায় আমি কাওকে কী এমনিতেই রক্ত দিতাম না?
কিন্তু তাও যেন মিলির কান্না শেষ হতে চায় না ।থেকে থেকে ফুফাতে থাকে।শেষে রিয়াদের উষ্ণ ঠোঁট যখন মিলির ঠোঁটকে খোঁজে নেয় তার পর সকালের রোদ পড়া শিশির বিন্দুর মত মিলির কাঁন্না শেষ হয়।এখন ওরা শীতের সকালে জড়াজড়ি করতে থাকা বাচ্চা কুকুরের মত যেন জড়াজড়ি করে একে অপরের উত্তাপ নিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:১৭