১
...আর্যভাষী সুশীল সমাজ যে কল্পনাপ্রবণ তাতে আর সন্দেহ কী। এরাই তো এককালে সিন্ধু উপত্যকায় বেদ রচেছিল।... - ইমন জুবায়ের
২
...প্রকৃতির কোলে কখনও কখনও তা হলে মৃত্যুও তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে? এভাবে ? এই বাংলায়? তাই তো দেখছি! কেবলমাত্র বাংলাতেই এমনটা সম্ভবপর। যে প্রমত্তা নদীটি সকল কীর্তি নাশ করার ক্ষমতা রাখে - তারই নাম ফরিদপুর-মানিকগঞ্জের পদ্মাপাড়ের জনমানুষ ভালোবেসে রাখল ‘পদ্মা’। কী এর মানে?... – ইমন জুবায়ের
৩
একটা শুরু ছিলো এরকম; ইমন জুবায়ের বর্ণনা দিচ্ছেন, সাতাশ'শ বছর আগের এক লেখকের বর্তমান, একটি ভাবের কথা -
"... বিকেল থেকেই সুপারি গাছে ঘেরা মাঠটায় বসেছিল সে। একা। সেই মুহূর্তে আকাশ ভরতি আলোর ভিতর গভীর চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছিল তাকে। কী নিয়ে যেন গভীর ভাবে ভাবছিল সে। মাঠের পাশেই হরিণজালির খাল। খালের জলের রং অনেকক্ষন ধরেই বদলে যাচ্ছিল । বদলে-যাওয়া জলের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। জলে অস্তরাগের লাল আভা। আকাশের রংও বদলে যাচ্ছিল দ্রুত । কতগুলি কাক উড়ছিল। চেনা-অচেনা পাখিরা কলতান তুলে ফিরে যাচ্ছিল যার-যার নিড়ে। ক্রমেই অন্ধকার- হয়ে- ওঠা প্রকৃতিকে সে তার ভিতরে নিয়ে যেতে থাকে, তখন মায়াময় এক সম্পৃক্ততার বোধ হয়।
নবীন কাকার ছিপ নৌকাটি জলের ওপর স্থির।
এই দৃশ্যটাই চিরকালের জন্যে মনের মধ্যে গেঁথে যেতে থাকে।
কপিল উঠে দাঁড়াল। চরাচরে আঁধার নামছিল। সেই সঙ্গে অল্প-অল্প করে ফুটে উঠছিল জোছনা। খাল ও মাঠের চারধারে আশ্চর্য নির্জনতা। নির্জনতা চরাচর জুড়েও। এই শান্তি। সন্ধ্যার অন্ধকার আর ধূলো পায়ে-পায়ে জড়িয়ে ঘরে ফিরছিল কপিল। দিন পনেরো বৃষ্টি হয়নি। পায়ের নিচে ধুলা জমে ছিল। ম্লান জোসনায় তার ছায়াও পড়েছিল ধুলা-মাখা পথে, ওটাও সঙ্গে-সঙ্গে চলছিল। মাথার ওপরে নক্ষত্ররা ফুটে উঠছিল। কতদিন ওই ঘাসের মাঠে শুয়ে প্রহরের পর প্রহর আকাশপাণে চেয়ে মনে হয়েছে -জগৎ আকস্মিক। এর কোনও মানে নেই। কপিল আপন মনে হাসে।
চু চু, পাড়ার লাল কুকুরটি বটতলা থেকে তার পিছু নিল। কপিল নির্বিকার। সে ডান দিকে তাকাল। কলাপাতার ওপর সন্ধ্যারাতের রোদ কাঁপছিল। মৃদু জোছনায় উদ্ভাসিত হয়েছিল চরাচর । ওপাশে কিছু অন্ধকার-অন্ধকার অনাবাদী মাঠ। শেয়াল(রা) ডাকছিল। ঘনঘন। ..."
একটা শুরু। ভাবগম্ভীর সুরে বলি, আরম্ভ। মোটা স্বরে, প্রারম্ভ। একটা কালো আকাশ, হালকা হাঁটুডোবা মিঠাপানির জল, কিংবা কিম্ভুত ছায়া, কিংবা গাছের বাকল উঠে গেছে একটু নিচ থেকে; কেউ তুলে নিয়ে গেছে অর্জূনছাল; ভ্যাপসা জলীয় বাষ্প; জলুয়া স্যাঁতস্যাতে; ইদানিং ক্লিয়ার হয় সোয়াম্প বললে; আদি বাংলা, হালকা পলকা বাষ্প উঠে যাচ্ছে সন্ধ্যা নাগাদ; নারকেল গাছগুলো একটু মাথা হেলিয়ে, থমকে থাকা ভেজা ঘাস, ঝমঝম বৃষ্টি; সুর আছে, একধরনের তাগিদ আছে, কিন্তু কোনও তাড়া নেই; কেউ কোথাও যাচ্ছে না, গেলেও ধীরে সুস্থে।
একটা সন্ধ্যার তালগাছের দিকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাকানো একটা ফিরিঙ্গী ভাবের সমস্যা। আধুনিক যুগের পাতিবুর্জোয়া উপরি-ভাব। ভাব তার অন্তরকে বোঝায়, মৃদু শাসায়, আত্মবিশ্বাস যোগায়, আমারে একেবারে ফালায় দেবার মতন নয়, তালগাছ আমার খুব কাছে। ইহার এসেন্স লইয়া আমি ভাবের অবতারণা করি। একটি দুষ্ট মেকি ভাব। তবুও একটা ভাব বটে। আন্তরিক সহজভাব এভাবে তাকায় না। সামগ্রিক ব্যাপার, কিংবা ইদানিংকালের টোটালিটি কীরূপে ইহাদের ভিতর দিয়া নির্বিকার নিউট্রিনোর মতন চলিয়া যায় শুনিয়াছি, তবে ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি রাখিয়া যায়। এরা এক রহস্য বটে। ভাব নিয়ে তাই সত্যিকারের কিছু বলতে পারি না। যারা জন্মসাহসী, যারা কাছাকাছি গিয়েছেন, লিখেছেন, তাদের শব্দগুলো তুলে দিলেই আনন্দ হয়। হেলান দিয়ে লেখা ইটালিকগুলো চিরকাল-স্পষ্ট ইমন রাগের। অসময়ে শব্দের মাথায় চন্দ্রবিন্দু ব্যবহারের কোন অর্থ নেই। সুখে থাকুক বাকি সবকিছু।
"...কপিল নির্বিকার। সে ডান দিকে তাকাল। কলাপাতার ওপর সন্ধ্যারাতের রোদ কাঁপছিল। মৃদু জোছনায় উদ্ভাসিত হয়েছিল চরাচর। ... জগৎ আকস্মিক। এর কোনও মানে নেই। কপিল আপন মনে হাসে। ... আমার মনে যেসব কথার উদয় হয়, যেসব আমার কাছে সত্য বলেই মনে হয় এবং যে-কথাগুলি আমার প্রিয়ও বটে- তা আমার মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও আমি চিন্তাশীল মানুষের কাছে প্রকাশ করব। এই আমার লক্ষ্য, এই আমার সাধনা। ... "
৪
"...মাঠের কাছে এসে কপিল থমকে দাঁড়াল। মাঠভরতি ধূসর কুয়াশা। সে-কুয়াশা ভেদ করে উড়ে গেল একটি কাক। এই মাঠটাই যে কপিলের পাঠশালা; কত কত দিন ওই ঘাসের মাঠে শুয়ে প্রহরের পর প্রহর নক্ষত্রময় আকাশটার দিকে চেয়ে থেকে মনে হয়েছে - এ জগৎ আকস্মিক; জগতের কোনও মানে হতে পারে না; এখানে লতাদিদের মরে যেতে হয়।
কপিলের চোখ জলে ভরে ওঠে। ..."
একটা জলজ মাছের গন্ধ বর্ষায় নতুন ম্যাগনিচিউড পায়, একটা অস্থিরতার মধ্যে উদাসীনতার বীজ বুনতে কিছু সময়ের জন্যও একটা লুঙ্গিপরা-স্ট্রাকচার কিংবা লাউশাক-কাঠামো রাস্তার ঐ পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। আপনি দৌড় লাগাইলে যাহাকে পাইবেন, আপনি সন্তুষ্ট হইবেন না, ইহা বলিয়া দিতে পারি। কিন্তু আপনি ইহা নিশ্চয়ই জানিবেন, সবকিছু এইখানেই, ইহার মধ্যেই। আর কোথাও কিছু নাই।
ইমন জুবায়ের প্রশ্ন করেন।
পিছন ফিরে কতদূর দেখা যায়?
আমরাও বলি,
কতদূর দেখা যেতে পারে? মানে, কতদূর দেখা বিধেয়? কত দূরের ইতিহাস-ইতিবৃত্ত,কল্পকাহিনীর অভিঘাত আমাদের বর্তমান মনকে আলোরিত করতে পারে,আচ্ছন্ন করতে পারে?
ইমন জুবায়ের উত্তরে সুতোগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেন –
"...উনবিংশ শতকের লালন-রবীন্দ্রনাথ কে তো তাদের বাণীর অভিঘাতে বড় সাম্প্রতিকই বোধ হয়। ষোড়শ শতকের শ্রী চৈতন্যদেবও অতটা অস্পষ্ট নয়। তাঁরই নামে স্থাপিত অধ্যাত্ববাদী ইসকন সংঘটি তো সমসায়য়িক কালের দেশি-বিদেশি ভাববাদীদের আচ্ছন্ন করে রাখছে। দশম শতাব্দীর অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানও কি অতটা আবছা ? তাতো মনে হয় না। তাঁকে আরও বেশি স্বচ্ছ করার জন্য তাঁকে নিয়ে আজও ছোটদের জন্য জীবনী,বড়দের জন্য নাটক লেখা হচ্ছে।
কিন্তু তারও আগে?
বৌদ্ধ দোঁহার গান - চর্যার পদ।
তারও আগে?
খ্রিস্টপূর্ব যুগের করতোয়া পাড়ের পুন্ড্রনগরটি যেন দেখা যায়। প্রাচীন বিশ্বের ওই অতুলনীয় নগরটি গড়ে তুলেছিল নিষাদ জাতির উত্তরসূরি পোদরা। শাসনদন্ডটি যদিও ছিল মগধকেন্দ্রিক মৌর্যদের হাতে।...মগধের প্রথম কেন্দ্রটি ছিল রাজগৃহ।... রাজগৃহ তো ছিল রীতিমতো দার্শনিকদের নগর। যেমন ছিল প্রাচীন গ্রিসের এথেনাই নগররাষ্ট্রটি। সম্রাট বিম্বিসারের সময়ে রাজগৃহে বাস করতেন অস্তিত্ববাদী বুদ্ধ; যিনি সমাহিত ভঙ্গিতে বৈপুল্লগিরির দিকে হেঁটে যেতে-যেতে বলতেন: ‘O Sariputra, form is no other than emptiness, emptiness no other than form , form is precisely emptiness, emptiness precisely form.”… গঙ্গার উত্তরের ৩৬ গণরাজ্যের বিরুদ্ধে সম্রাট অজাতশক্রর সামরিক অভিযানের কারণে ওই রাজগৃহ নগরেই উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন অজিবক ধর্মসম্প্রদায়ের প্রবক্তা দার্শনিক মোক্ষলি গোশাল! বৌদ্ধধর্ম ছাড়াও,বর্ধমান মহাবীর প্রচারিত জৈনধর্মেরও অন্যতম কেন্দ্র ছিল ওই রাজগৃহ নগর... জনসাধারনে না-হলেও বোদ্ধা মহলে ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক দর্শনও জনপ্রিয় ছিল। ... তারও আগে আর্যাবর্তের সুশীল সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল দার্শনিক কপিল-এর সাংখ্যদর্শন। সাংখ্যদর্শনই ভারতের আদি দার্শনিকমত।... কপিলকে ইচ্ছে করেই কপিলমুনি না বলে দার্শনিক কপিল বললাম। তাতে ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যে খানিকটা ক্ষুন্ন হল বটে; হলেও আমরা কপিলকে সংগত কারণে দার্শনিকই বলব। ... একজন বেদবিরোধী মুক্তবুদ্ধির দার্শনিক মুনি হন কী করে। মুনিগণ কি আগে থেকেই কিছু স্বতসিদ্ধ ধারণা মেনে নেন না?... আরও বলব যে, কপিল শুধু ভারতীয় দর্শনেরই নয়- বাঙালির দর্শনের ভিতটিও তিনিই গড়ে দিয়েছিলেন । বৌদ্ধদর্শন তো বটেই - অতীশ দীপঙ্কর থেকে আরম্ভ করে লালন-রবীন্দ্রনাথ অবধি সবাই কমবেশি কপিলের ভাবশিষ্য।..."
ভাবশিষ্য। গুরু তাহলে ছিলেন স্বতন্ত্র এক আদি বাংলায়। বাঙালির জীবনদর্শনের প্রাচীনতম উৎসে ছিলেন নাকি একজন আদিপুরুষ। বাঙালির দর্শন-ঐতিহ্যের ধারা কপিল থেকেই উৎসারিত – বলছেন ইমন জুবায়ের। কিন্তু, কে কপিল? –
৫
"...তারপর কখন রাত ফুরিয়ে ভোর হল। পাখপাখালি ডাকল। কপিল তো জেগেই ছিল। একমুঠ জলভাত খেয়ে কাঁধের ঝুলিটা তুলে নিল সে। পায়ে-পায়ে বাড়ির পিছনে এল। কুয়াশায় ঢাকা পানের বরজটা দেখে নিল। শিশির লেগে পায়ের পাতা ভিজে গেল। বাবার কত শখের বরজ। মারও। মার জন্যও আরও বেশি খারাপ লাগছিল।..."
বাঙালি পথে বের হয়। বের হওয়া তার অভ্যাস। ঘরের বাইরে বের না হলেও বের হয়। বের না হলে নির্বিকার হওয়া যায় না। আধুনিক বাংলাতেও বাংলা তার ভাব এখনও ছাড়িয়া যায় নাই। আমরা তাহাদের দেখা পাই, আবার পাই না। জগত নিজের মতন চলিয়া যায়।
"কপিল যখন বর্তমান, তখন প্রাচীন বাংলার অধিকাংশ স্থানই জল ও জঙ্গলে পরিপূর্ন ছিল। হরিকেল, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ/ নাব্য, পন্ড্রবর্ধন, গঙ্গাহৃদয় -এই সমগ্র অঞ্চলটিই খ্রীষ্টপূর্ব যুগে ছিল পোদ-বাগদি-হাড়ি-ডোম প্রমুখ জাতির বাসভূমি। পোদ-বাগদিরা অরণ্যচারী নিষাদ জাতি থেকে উদ্ভুত। কৌম-গ্রামের পাশেই অরণ্য। ওখানে বেঁটে-কালো নিষাদ নারী-পুরুষের দেখা মেলে। অরণ্য পুড়িয়ে চাষাবাদ শুরু হয়েছে কোথাও,গড়ে উঠছে গ্রাম,তার বটতলা,মেঠোপথ, হাট, আষাঢ়- শ্রাবণের আলো-আঁধারিময় পথঘাট। গ্রামীণ সমাজ লৌকিক দেবতার প্রাধান্য । অরণ্যে তখনও নিষাদ নারী-পুরুষেরা বৃষ্টিতে ভিজছিল। এমনই সহজ সরল জীবন যাপন ওদের । অরণ্যচারী নিষাদরা বোঙ্গা দেবতার পূজো করে। ওই বোঙ্গা দেবতার নামেই রাজ্যের নাম রাখা হল বঙ্গ। বোঙ্গা থেকেই বঙ্গ। (প্রসঙ্গটি বিতর্কিত) ওই ঘন জঙ্গলের কালো-কালো বেঁটে শরীরের আদি-অস্ত্রাল মানুষদের বোঙ্গা দেবতার স্বীকৃতি দেওয়া হল।... এমনই এক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন কপিল... "
কী ভাব তাহার মনে?
ইমন জুবায়ের বলছেন, "বৈদিক মত অনুযায়ী - মানবজীবনের উদ্দেশ্যই ঈশ্বরকে অন্বেষন করা। এই মত অনুযায়ী, জীবন হল এমন এক পাঠশালা যেখানে নিয়ত ঈশ্বরের পাঠ নিতে হয়। এ ছাড়া জীবনের আর কোনও মানে নেই। এই কথাগুলিই বিশ শতক অবধি শ্রী অরবিন্দরা সুন্দর করে ইংরেজিতে লিখে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এইসব কাল্পনিক বিশ্বাসের বিরোধীতা করে ভূ-ভারতে কপিলই সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করে বললেন, ঈশ্বরের পাঠ তো পরের কথা আসলে মানুষের জীবনটাই যে দুঃখপূর্ণ। পৃথিবীতে মানুষ জন্মলাভ করে নানাবিধ দুঃখ কষ্টে ভোগে। বেদপাঠ কিংবা ব্রহ্মাজ্ঞান এইসব দুঃখকষ্ট দূর করতে পারে না। দুঃখকে দূর করতে হলে চাই স্বচ্ছ দৃষ্টি,প্রকৃতি ও পুরুষের জ্ঞান, এককথায় – দর্শন। "
গেল ঈশ্বর, সাতাশ'শ বৎসর পূর্বে, নানাবিধ ঈশ্বরের কালে। আসিলো স্বচ্ছ দৃষ্টি, প্রকৃতি ও পুরুষের জ্ঞান; সাতাশ'শ বৎসর পূর্বে, এই বাংলায়! এলাছ! নৌকাবাইচ হইতেছে ইদানিং, পুরুষ ব্যাটাছেলেরা প্রকৃতি গিলিয়া খাইতেছে, জগতের দুঃখ অতঃপর উহাদের খাইতেছে। সাথে সাথে বিস্কুট দৌড়ও হইতেছে।
"ওহ্, এইসব বিভ্রম আর কতকাল দেখতে হবে!
উঠানের রোদে মায়ের মুখে সুখের ঝিলিক। দু-দুটো মুখ মিশে যাচ্ছিল আলোয়-অন্ধকারে। আশ্চর্য এক অনুভূতি হচ্ছে কপিলের বুকের ভিতর।...কপিল শেষবার আবছা উঠানবাড়ি, পুকুর, অভিমানী হাঁসগুলি দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পথে নামল । তখনও সে জানত না- সে-ই প্রথম সম্পূর্ণ মানবিক ঈশ্বরশূন্য মতবাদ প্রচার করার জন্য পা রাখল অচেনা পথে। সেই বিরল মুহূর্তটি কেবল মনে রেখেছিল - শুভ্র এক ভোর,সজনে ডালে বসে থাকা কতগুলি মৌন কাক আর পদ্মর অভিমানী হাঁসগুলি। ..."
বাকি কথাগুলো একান্তই ইমন জুবায়েরের। টুকটাক এদিক সেদিক প্রকাশিত অপ্রকাশিত। টানা কথা বলতেন তিনি। সবাই শুনতে পছন্দ করতো।
৬
"...স্বীকার করি যে, কপিলের বসবাস অতীত ইতিহাসের এক ধূসর অধ্যায়ে; যার ঘুনেকাটা পৃষ্ঠাটি আজ অবধি কোনওমতে অক্ষত থাকলেও ভাষাটি মাগধীপ্রাকৃত হওয়ারই কথা। যদিও মাগধীপ্রাকৃত ভাষাটি একালের অনেকেই পড়তে পারেন, তবে, আমাদের কপিলতত্ত্বের চেয়ে মানুষ কপিলের প্রতি তীব্র কৌতূহল হওয়াই স্বাভাবিক। প্রবল যুক্তিবাদীরা এও স্বীকার করবেন- তথ্য যেখানে সুলভে মেলে না সেখানে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যেতেই পারে। কল্পনার মাধ্যমে মানুষ কপিলের একটা আবছা ছবি ফুটে উঠলেও উঠতে পারে। ততটুটুই বাঙালি তত্ত্বজিজ্ঞাসুর জন্য যথেষ্ট বিবেচনা করি। ...
কপিলের বয়ান ... বেদ-বিরোধী । আসলে বেদ-বিরোধী ঠিক নয়, বরং বলা ভালো কপিলমতে বেদ-ব্রহ্মার কোনও স্থানই নেই। এই অবহেলা ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সহ্য করবে কেন? অযোধ্যা নগরের ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা সাংখ্যপ্রবচন পড়ে ক্ষেপে উঠল। ব্রাহ্মণ্যবাদী পন্ডিতেরা দারুন হইচই বাঁধিয়ে দিল। “জগৎ সংসারে মানুষ নিরন্তর দুঃখের আগুনে পোড়ে তা তে ব্রহ্মার কী বেদেরই-বা কী!” এইরকম বেদবিরোধী কথা কে কবে শুনেছে। বলে কি না, জগৎ আকস্মিক। মানুষ আজন্ম দুঃখে পোড়ে,তার দুঃখের ঘর। জগতে এক অনন্ত দুঃখ-প্রবাহ বইছে। জগৎ হল নরকের কুন্ড। মানুষ সেই তপ্ত কটাহে পুড়ছে। এতে ব্রহ্মার কী,বেদেরই -বা কী। পুরুষ উদাসীন। নারী এই কারণেই চঞ্চলা। কাজেই কপিলের বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনার ঝড় তো উঠবেই। তাঁকে বলা হল নাস্তিক। বলা হল নিরেশ্বরবাদী। বলা হল পাতক। রৌরব নরকে পুড়বে বলে অভিশাপ দেওয়া হল। তাঁকে বলা হল ম্লেচ্ছ।
...নেহেরুর লেখা The Discovery of India বইটির পাতা উল্টিয়ে দেখি, অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে লিখেছেন, ‘In Kapila’s doctrine, for the first time in the history of the world, the complete independence and freedom of the human mind, its full confidence in its own powers were exhibited... তথ্যটি শিহরিত করে! অধ্যাপক গার্বে কপিলের seventh century b.c. বলে উল্লেখ করেছেন। কাজেই, আয়োনিয়ার Thales নন - বরং বিশ্বের প্রথম মানবতাবদী দার্শনিকটির নাম কপিল। এবং তাঁর জন্মস্থান প্রাচীন বাংলা...আয়োনিয়বাসী থালেস ব্যবসা করতেন। ব্যবসাবানিজ্যের স্বার্থে বিশ্ব ঠিক কী দিয়ে তৈরি - থালেস সে-রকম ভাবতেই পারেন। পক্ষান্তরে,বঙ্গবাসী কপিলের কবিহৃদয় তাঁকে মানবীয় দুঃখদুর্দশার প্রতি সচেতন করে তুলেছিল। এ দিক দিয়েও বুদ্ধ কিংবা কিয়ের্কগার্দ নন- বরং কপিলকেই আমরা অস্তিত্ববাদী দর্শনের জনক বলতে পারি । অবশ্য থালেস কে কোনওভাবেই ম্রিয়মান করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। থালেস মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিজ্ঞানের জনক হিসেবে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন, দর্শনের নয়; কেননা, থালেস চম্বুককে জীবন্ত মনে করতেন। অধ্যাপক গার্বের মতে কপিলেরও তাই; তবে কপিলের ভাষ্য থালেসের মতন জীবননিরপেক্ষ নয়;বরং জীবনঘনিষ্ট। জগৎ দুঃখময় ...
ব্যাক্তিমানুষ হিসেবে ততটা না-হলেও কপিলপ্রচারিত নিরেশ্বরবাদী এবং নারীবাদী সাংখ্যদর্শন আজও বাঙালি তত্ত্বজিজ্ঞাসুর আলোচ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশের দর্শন সম্বন্ধে গভীর কৌতূহল লক্ষ করা যাচ্ছে। কপিলবাদ থেকেই যে বাঙালির দর্শনচর্চার আরম্ভ,সে-কথা দৃঢ়ভাবে বলার আজ সময় এসেছে। সাংখ্যদর্শনকে আমরা বলব কপিলবাদ।
আজকাল তো আমরা সমীচীন না-হলেও জীবনানন্দের কবিতার আলোচনার পাশাপাশি কবির প্রতি লাবণ্য দাশের শীতল উপেক্ষার কথাও যেন আরও বেশি করে আলোচনা করি। ছাতার- বাঁটের- ব্যবসা- করে- ব্যর্থ- হওয়া মানুষ জীবনানন্দ দিন-দিন আমাদের গভীর কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠছেন তাঁর কবিতার পাশাপাশি। সেই রকম সাংখ্য দর্শনের পাঠ গ্রহন ছাড়াও বাঙালি জীবনদর্শনের উৎসে অবস্থান করা দার্শনিক কপিলও আমাদের কৌতূহলের কেন্দ্র হয়ে উঠতেই পারেন। ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসা এই বিমর্ষম্লান ভাববাদী সময়ে সেই নিরীশ্বরবাদী বিদ্রোহীটিকে খুঁজে বার করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমাদের ওপরই বর্তায়। আমরা খুঁজে বার করতে চাই সেই কপিলকে - তা সে যত কালের ব্যবধানেই তিনি দাঁড়িয়ে থাকুন না কেন। তথ্যাদির অভাবে কপিলকে স্পষ্ট করতে চাই কল্পনা শক্তির আশ্রয়, তবে সে-কল্পনা বলগাহীন হবে না - যুক্তিযুক্তই হবে।
প্রাচীন বাংলারই কোনও কৌম গ্রামে, অনুমান করি, যিশুর জন্মে সাত শ বছর আগে জন্ম হয়েছিল কপিলের । তপোব্রত সান্যাল লিখেছেন, “প্রাচীনকালের লেখকরা বঙ্গকে উপেক্ষা করলেও মহামুনি কপিলের সঙ্গে গঙ্গার সম্পর্কে কে মান্য করেছেন। সাংখ্য-দর্শনের প্রবর্তক কপিল যে বঙ্গবাসী ছিলেন, তার প্রমান আছে। সাংখ্যই ভারতের প্রাচীনতম দর্শন। বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্বের উৎসও এই সাংখ্যদর্শন। বস্তুত, বুদ্ধের দু’জন গুরুই ছিলেন সাংখ্যমতাবলম্বী। সনাতন ধর্মাবলম্বী আর্যশাস্ত্রীরা কপিলের লোকায়ত সাংখ্যশাস্ত্রকে কখনোই মেনে নেন নি, কারণ কপিল বেদকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেননি। মনে হয় এই কারণেই বৌদ্ধ-অধ্যুষিত বঙ্গ আর্যদের দ্বারা অবহেলিত হয়েছে।”
কপিলের মূল বিশ্বাস বেদ-এর ধারনার সঙ্গে মেলে না। এই কারণেই হুমায়ূন আজাদ-এর মতন অনুমান করি তাঁর জীবনও বিপদজনক হয়ে উঠেছিল সেই একদেশদর্শী বৈদিক ধর্মান্ধ পরিবেশে। তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার উদগার হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদির দল তো তৎকালেও তৎপর ছিল। বিদ্রোহী কপিলের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের একজোট হয়ে ওঠাই তো স্বাভাবিক।
এতকাল পরে জানা গেল - কেবল কপিল নয়- কপিলের জন্মস্থান বাংলাও বৈদিক ধ্বজাধারীদের আক্রমনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। বৈদিক সাহিত্যেই এর প্রমাণ মেলে। কপিলবাদের পীঠস্থান হওয়ায় প্রাচীন বাংলা কে দুঃখদর্দশা সইতে হয়েছিল। বাংলার প্রতিভাবান সন্তানের জন্য সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগেই তার সবুজ ললাটে পড়েছিল কলঙ্কের কালো কালিমা।
একাত্তরে যেমন পশ্চিম পাকিস্থানীরা তছনছ করেছিল পূর্ববাংলা ।
সেই সময়কার এক পাকিস্থানী প্রভূর ঘৃন্যউক্তি, পূর্ব বাঙলায় মানুষ না, জমি চাই। সেই পিশাচের এইরকম বলার কারণ- বাংলার মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা। বাংলার মানুষের স্বাধীনতার দাবীই তার জন্য কাল হয়েছিল । পূর্ব বাংলায় রক্তগঙ্গা বইল। গনহত্যার আরেকটি অবিশ্বাস্য ইতিহাস নির্মিত হতে লাগল। মুক্তিযোদ্ধারও রক্ত দিয়েই উপযুক্ত জবাব দিচ্ছিলেন। যুদ্ধের বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে এসে যেরকম করে মুক্তিযোদ্ধার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল পাকিস্থানী সৈন্যরা, সেই রকম কপিলের স্বাধীন মতামতের জন্য পশ্চিমা ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যরা প্রাচীন বাংলাকে অন্তত কথার আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে লাগল।
আসলে পশ্চিমের আর্যজন (পশ্চিমের পাকিস্থানীরা) কখনোই বৃহৎ বঙ্গকে সুনজরে দেখেনি। জলজঙ্গলে পরিপূর্ন এই রকম একটি জায়গায় সুদীর্ঘকাল পুন্ড্র-বঙ্গে পশ্চিমা বৈদিক-আর্যদের ইন্দ্র-বরুন প্রভাব (খাঁটি ইসলাম!) প্রগাঢ় হয়নি। আপামর বঙ্গজনের বোঙ্গা দেবতার স্বীকৃতির ঘটনাটা আর্য অভিজাতদের (বনেদি পাকিস্থানীদের) ভালো লাগেনি । পাকিস্থানীরা রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল। এই অঞ্চলের জনমানুষ পশ্চিমা বৈদিক-আর্যদের চোখে ছিল অনাব্রত। কাজেই সেই সময়কার সেই পাকিস্থানী প্রভূর -“পূর্ব বাঙলায় মানুষ না, জমি চাই” কথটা বলা সহজ হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলের জনমানুষদের আর্যরা বলত,অচ্ছুত,বলত শূদ্র। আরও কত কী যে বলত। বলত, বোঙ্গা-পুজারীর দল, বলত, অনাব্রত, মানে ব্রতহীন; বলত দাস, বলত দস্যু, বলত কাক-চেটক সদৃশ। পদদলিত। দলিত! পূর্ববাংলা সম্পর্কে পাকিস্থানীরাও এই রকমই ভাবত। এখন কী বলে কে জানে। ...
কিন্তু, কেন? কেন এই ঘৃনা? কথার আক্রমন? এই অনাব্রতভূমি থেকেই একজন দ্রোহী পশ্চিমের বৈদিক রীতিনীতির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন বলে? বঙ্গবন্ধুর মতো?
তাইই।
প্রাচীন বাংলা আসলে সোনার বাংলাই ছিল । জীবনানন্দের রুপসী বাংলা তো ছিলই। সেই রুপসী বাংলার অধিবাসী ছিল ব্রতহীন, অনাব্রত। তীর্থপ্রবন। যাগযজ্ঞ-এর চাইতে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতে তাদের ভালো লাগত বেশি। আজও তাই। পক্ষান্তরে আর্যগন পরীক্ষিত-জনমেজয়ের বংশধর। তারা সপ্তসিন্ধুদেশে বসবাস করে যাগযজ্ঞর সব উৎকট রীতিনীতি উদ্ভাবন করে পুব দিকে নিয়ে এসেছিল । আর্যদের প্রথমে ওই সপ্তসিন্ধুদেশেই দেখতে পাই। ওদের আদি বাসস্থান ছিল সিন্ধু আর স্বরস্বতী নদীর পাড়ে; সেখানে তারা উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। কালক্রমে সিন্ধু-স্বরস্বতী নদী দুটি শুকিয়ে যাওয়ায় নগরগুলি ঘিরে যে চাষযোগ্য জমি ছিল সেসব উষর হয়ে উঠল। আর্যরা বাধ্য হল যাযাবর জীবন বেছে নিতে । দীর্ঘকাল যাযাবর জীবন যাপন করে ধীরে-ধীরে অপেক্ষাকৃত উর্বর পুবের দিকে অগ্রহর হচ্ছিল তারা। একটা সময়ে এসে তারা গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসতি গড়ে তুলতে লাগল। ধীরে-ধীরে গড়ে উঠল কোশল- কাসী- মগধ- অঙ্গ প্রভৃতি ট্রাইবাল রাজ্য। অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল আর্যরা শ্রেণিস্বার্থেই সমাজে চতুবর্ণের সৃষ্টি করল । বৈষম্য টিকিয়ে রাখতেই দরকার নিয়তিবাদ- এজন্য আর্য দেবদেবীর প্রসার ঘটাল তারা, যাদের কথা তাদের পূর্বপুরুষেরা আগেই লিখেছিল বেদ-এ। শোষন দীর্ঘস্থায়ী করার প্রয়োজনে দরকারমতো স্থানীয় দেবদেবীও গ্রহন করল তারা।
বঙ্গবাসীর ইতিহাস তেমন কি?
না। তার শরীর জীবনানন্দের মতো;যার রক্তে-মজ্জায় ঝিম-ধরা প্রকৃতির রসসুধা,ঋতুর বিস্ময়;বৃষ্টির কাব্য, শীতের নির্জন দুপুরের হা-হুতাশ। দুই বাংলার সংগ্রামী মানুষের মতোই তার জঠরে জাগতিক ক্ষুধা,উঠানে প্লাবনের জল; জলের সেই হা-হা ক্ষুধা,সেই সর্বগ্রাসী তান্ডব দূর করার জন্যই আমরণ ঝড়জলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই নিয়েই তার জীবন। আজও। তার পশ্চিমা ইন্দ্র-বরুন প্রমুখ অতিজাগতিক দেবতার কী প্রয়োজন! তার ইসলামের পাকিস্থানী অপব্যাখার কী প্রয়োজন!"
৭
"ঠাকুর আপনে জানেন - জীবন অর্থহীন মনে না করিয়া প্রাচীন বৈদিকগন ধর্ম, অর্থ ও কাম সার্থক করিতে উদ্যোগী হইয়া ছিল। প্রাচীনেরা ‘বেদ’-এর ভাষ্য ‘উপনিষদ’ রচিল, চাণক্য রচিলেন ‘অর্থশাস্ত্র’, আর বাৎসায়ন রচিলেন-‘কামশাস্ত্র।’ ...আমার ঘোর কাটিল। কখন সেই অল্পবয়েসি ইংরেজ সৈন্যটি কারেন মেয়েটিকে ধর্ষন করিয়া চলিয়া গিয়াছে। মেয়েটা এখন মেঝের উপর পড়িয়া আছে। হয়তো সে পায়ূকামে এখনও সহজ হইয়া উঠিতে পারে নাই, চোখ বুজিয়া ব্যথা সামলাইতেছে। ইহা ধর্ষণ নয়তো কি? মেয়েটির এই মুহূর্তের অনুভূতি টের পাই - সে হয়তো কাউকে ভালোবাসে, কাজেই পরপুরুষের সোহাগাদি তাহার ভালো লাগিবে কেন? ব্রথেলের মেয়ে বলিয়াই তাহাকে স্বৈরীনি ভাবার কারণ নাই! অ-ইষৎ অন্ধকারে বসিয়া আমি সর্বশেষ মোঘল সম্রাট বাহাদূর শাহ জাফরকেও দেখিতে পাই যেন: বাদশা জাফর ইংরেজগনের আক্রমণ-লাঞ্ছনায় ক্ষমতা হারাইয়া বার্মার জঙ্গলে মরিতে চলিয়াছে। এইভাবে ইংরেজগন প্রাচ্যভূমি ছারখার করিয়া দিতেছে; নিভৃতে নারীকে - প্রকাশ্যে, বাদশাকে। এইভাবে জগৎ অর্থহীন হইয়া উঠে কি না? জগৎ অর্থহীন হইলে আমিও নির্লিপ্ত হইয়া উঠিতে পারি কি না? আমি তীব্র বিষাদ বোধ করিতে থাকি। বাহাদূর শাহ জাফর ভৈরবী রাগের অতিশয় ভক্ত ছিলেন। রাগসংগীতের ভক্তমাত্রেরই অধরা দর্শনের বোধ হয়। ইংরেজের লাথি খাইয়া ভক্ত-বাদশার বার্মার জঙ্গলে মরণ হইল! তাহা হইলে? এই কারেন মেয়েটিও এখন ধুঁকিতেছে, মেয়েটি ব্রথেলবাসীনি বলিয়াই ইংরেজ কতৃর্ক ধর্ষিতা হইল ... মেয়েটি সংসারে থাকিলে জীবনভর এক পুরুষের নিয়ন্ত্রিত যৌনতার নিরানন্দ সান্নিধ্য পাইত। তা ছাড়া সংসারই-বা কই। সংসার নাই বলিয়াই তো মেয়েটি পথে নামিল, পথ হইতে এই বন্দিশালায়। এ পথে নামিল; কেননা, ইহার ভাই, পিতা কি স্বামীর কর্মের সংস্থান ইংরেজ পুরুষেরা গ্রাস করিয়াছে। ইহাদের নিঃস্ব করিয়া ইংল্যান্ড ধনী হইতেছে, সুখি হইতেছে। ফলে ইহাদের সংগীত আরও কর্কস হইয়া উঠিতেছে, ইহাদের যৌনাচার অবাধ হইয়া উঠিয়া ইহারা মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ হইয়া উঠিতেছে, মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ হইয়া ইহারা আবেগহীন হইয়া পড়িবে, তখন ইহারা আরও-আরও প্রাচ্যদেশ আক্রমন করিতে দ্বিধা করিবে না। এই সমস্ত ভাবিয়া আমার দীর্ঘশ্বাস ঘন হইয়া উঠিতে থাকে। ধর্ষিতা কারেন মেয়েটি ঝুঁকিয়া কাপড় তুলিয়া নিতেছে। কাপড় পরিয়া এখনি চলিয়া যাইবে। তারপর অন্য পুরুষের কাছে সুখ কিংবা যন্ত্রণা লইবে? অথচ, আমার তাহাকে ইংরেজের তুলনায় অধিক মহিমান্বিত মনে হইল। মেয়েটি বাল্যকাল হইতেই তথাগত বুদ্ধের শিক্ষায় শিক্ষিত। ইংরেজগন তেমন নয়, তাহারা অধিকাংশই মহামতি যিশুর বাণীর নিগুঢ় তাৎপর্য কখনও অনুধাবন করিতে পারে নাই;তাহারা অধিকাংশই মেঘবৃষ্টির দিনে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে। অথচ, এই মেয়েটি কিশোরীবেলায় ইরাবতী নদীর ধারে বৃষ্টিতে ভিজিতে ভালোবাসিত। মান্দালয়ে? বৃষ্টিতে ভিজিতে ভিজিতে ঘুনাক্ষরেও সে তখন টের পায় নাই- জীবন তাহার জন্য কী নিদারুন ফাঁদ পাতিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। কারেনগন বার্মার নিয়ন্ত্রন লইবার লক্ষ্যে দীর্ঘকাল যাবৎ বিদ্রোহ করিয়া আসিতেছে। হয়তো সে সংগ্রামে মেয়েটির পিতা, ভাই ও স্বামী মরিয়াছে। সে পথে নামিয়াছে। তাহার পরে নানা হাত ঘুরিয়া এই ব্রথেলে বিক্রি হইয়াছে। আমার দীর্ঘশ্বাস ঘন হইয়া উঠিতে থাকে।..."
৮
"ইউরোপবাসীরা দীর্ঘকাল শীতল ও জীবনবিচ্ছিন্ন দর্শনে আচ্ছন্ন ছিল বলেই জানতে পারেনি দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলা নামে সুরমা-সুবর্ণরেখা বিধৌত পাটল রঙা পলির একখন্ড জমিন রয়েছে; যে জমিনের ’পর বছর ভর ছ ছ’টি বিস্ময়কর ঋতুর চলে লীলা,যে জমিনের ’পর বর্ষার সময়ে আকাশে মেঘ ঘনিয়ে ঝরে বৃষ্টি, তখন এবং সেই কাজলকালো মেঘলা আবহের তাৎপর্য অকিঞ্চিৎকর নয় মোটেও। কেননা,বাংলার বিস্ময়কর ঋতুর অভিঘাতে অভিভূত মানুষের মনে এককালে উদয় হয়েছিল পৃথিীবীর উদার, মুক্ত ও দুঃসাহসী এক জীবনদর্শনের-যার নাম, উত্তরসূরীরা পরবর্তীকালে দিয়েছে, ভাব - যে ভাব দুঃখবাদী (দুঃখ-সুখের দুইটি ধারায় বইছে নদীর জল /সুখে বাইব তোমার ডিঙা করিয়া কোন্ ছল?); যে ভাব মানবতাবাদী (এমন মানবসমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যখন হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতিধর্ম নাহি রবে।); যে ভাব নারীবাদী (নিগূঢ় বিচারে সত্য গেল যে জানা/ মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা।); যে ভাব জিজ্ঞাসা-ভিত্তিক (জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি?); যে ভাব স্বীকারোক্তিমূলক (করি মানা কাম ছাড়ে না/মদনে/ আমি প্রেমরসিকও হব কেমনে?); যে ভাব ভোগবাদী (থাকতে ক্ষুধা দেহসুধা পান করো রে পাগলা মন); যে ভাব বস্তুবাদী (শুনি ম’লে পাব বেহেস্তখানা/ তা শুনে তো মন মানে না।); যে ভাব বিস্ময়কর এক মৌলিক epistemology (...কলব হইয়া যায় নূরানী চাইলে এক নজর। লক্ষ্য করুন, ইসলামী নূর বাংলায় এসে হয়ে যায় কলব [হৃদয়]!); ...সভ্যতার অন্যান্য ধর্মদর্শন মানুষকে যেখানে বিধানের নিগঢ়ে আবদ্ধ করেছে, বাংলার ভাব মানুষকে এভাবে বরাবরই মুক্ত বলে মেনে নিয়েছে। “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/নৈলে ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।”(লালন)… ঋতুস্রাবের কারণে বিশ্বের অপরাপর সংস্কৃতি নারীকে অনেকটা অচ্ছুত করে রাখলেও ঋতুস্রাবের সঙ্গে বাংলার বাউদের সাধনার সঙ্গে সম্পর্ক কিন্তু ঘনিষ্ট।…এ কারণেই বলছিলাম, সভ্যতার অন্যান্য ধর্মদর্শন মানুষকে, বিশেষ করে নারীকে, যেখানে বিধানের নিগঢ়ে আবদ্ধ করেছে, বাংলার ভাব মানুষকে বরাবরই মুক্ত বলে মেনে নিয়েছে। এ কারণেই বাংলায় প্রাচীন মিশরের মতো Book of Dead নামক পরকালপন্থি অসুস্থ গ্রন্থ নাই, কবি ও কাব্যকে নির্বাসিত করা প্লেটোর Republic নাই,নিম্নকায়কে অপদস্থ করা elite বেদ-উপনিষদ নাই, নারীকে অচ্ছুত করে রাখা মনুর বিধান নাই, নারীকে ‘আত্মাশূন্য’ মনে করা কনফুসীয়পন্থি গ্রন্থাদি নাই; অধিকন্তু, বাংলায় আলেকজান্দারের মতো যুদ্ধবাজের জন্ম হয় নাই, রক্তপিপাসু চেঙ্গিস খানের মতো খুনির জন্ম হয় নাই, বরং বাংলার ভাবচর্চার শিকড়ে রয়েছেন মাতৃতান্ত্রিক কপিল-কপিলের ভাবশিষ্য বুদ্ধ-বুদ্ধভক্ত তান্ত্রিক অতীশ দীপঙ্কর-অর্ধনারীশ্বর শ্রীচৈতন্যদেব-দয়াল লালন- সংস্কারক রামমোহন-দয়ালু বিদ্যাসাগর-ঋষি রবীন্দ্রনাথ-প্রমিথিউস নজরুল-পরিবেশবাদী জীবনানন্দ-মরমী হাসন-বাউল রাধারমন-দুঃখী উকিল মুন্সি- পাগল শাহ্ আবদুল করিম প্রমূখ। এঁরা প্রত্যেকেই বাংলার ভাবের বিখ্যাত বাহক। এরা প্রত্যেকেই অর্ধনারীশ্বর,এ কারণেই সুন্দর, সুন্দর ও কল্যাণকর। ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ - জীবনানন্দের এই পরম উক্তিটি তা হলে কেবল দক্ষিণ বাংলার রূপ দর্শনে নয় - বাংলার জগতের জন্য পরম হিতকর ভাবদর্শন আদ্যপান্ত উপলব্দি করেই তবে দক্ষিণ বাংলার কবিটি লিখেছিলেন - ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’? এবং জগতের জন্য পরম হিতকর এই ঐতিহ্যবোধ থেকে বাঙালিরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করলে বিশ্বজুড়ে দরিদ্র মানুষ যৎসামান্য হলেও আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখতে পারে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ক্ষুদ্র ঋন প্রকল্পের কারণে; এই পরম হিতকর ঐতিহ্যবোধ থেকে বাঙালিরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করলে বিশ্বজুড়ে মানুষের মুখের ভাষাটি ২১ শে ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস মর্যাদা লাভ করে । পক্ষান্তরে, শ্বেতকায় ইউরোপীয় জার্মান নাৎসীরা নিজেদের জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ মনে করলে ২ কোটি মানুষের কপালে লেখা হয়ে যায় মৃত্যু! পক্ষান্তরে, যুদ্ধবাজ মার্কিনীরা সামরিক দিক দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করলে ১৯৪৫ সালের ৬ অগাস্ট দেড় লক্ষ হিরোসিমাবাসীর কপালে লেখা হয়ে যায় মৃত্যু!"
৯
"...বাংলার লোকসম্প্রদায়ের অধিকাংশই সাংখ্যদর্শন প্রভাবিত বলেই নিরেশ্বরবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও নারীবাদী। আথেন্স কিংবা ব্যাবিলন দেবী আথেনা কিংবা ইশতারকে ভজনা করলেও উপযুক্ত বোধবুদ্ধির অভাবে কখনও মাতৃতান্ত্রিক শিক্ষা দেয়নি। বাংলার বাউল-সূফীদের সামনে এসে আথেন্স কিংবা ব্যাবিলনের সংকীর্ণ শিক্ষাদর্শনের কি বলার আছে? ...
...এইই পুরুষতন্ত্রের অনিবার্য অভিশাপ, পুরুষতন্ত্র যুদ্ধকে হাতের কাছেই রাখে। কেননা, সে অপ্রধান বলেই বলতে পারে না ‘Those who give the orders/Seldom see the mess it makes’ এই বোধের জন্য চাই পূর্ন সচেতনতা। যে সচেতনতা শিল্পীর নিঃশ্বাস, নারীর অনিবার্য প্রশ্বাস। যে-কারণে কবিরা নারীর মুখপাত্র, যে কারণে নারী ও শিল্পী এক, সে শিল্পী পুরুষ হলেও এক, নারী হলেও এক -বিষয়টি ঠিক Biological নয়, বিষয়টি অন্তরের শাসনের বা সচেতনতার মাত্রার। যে কারণে বুদ্ধকে নারী মনে হয়, নারী মনে হয় শ্রীচৈতন্যদেবকে। নদীয়া-বাংলার মূল প্রতিপাদ্য আবারও একবার স্মরণ করি - “আমার অন্তরে রাধা,বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।” এ এক অতি পরম সচেতনতা, যে সচেতনতার বশবর্তী হয়ে সুনামগঞ্জের উজান ধল গ্রামের বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম অমোঘ উচ্চারন করেন: “আমার স্ত্রী আমার মুর্শিদ।” শাহ আবদুল করিমের স্ত্রীর নাম ছিল আপ্তাবুনেচ্ছা। করিম সোহাগভরে ডাকতেন সরলা। কিন্তু, কি দেখেছিলেন ভাটির বাউল ওই নারীতে? করিমের বাংলা-কাঁপানো বিখ্যাত সেই গানটির কয়েকটি পঙতি এরকম- “বসে ভাবি নিরালায়, আগে তো জানি না বন্দের পিরিতের জ্বালা/হায় গো, নিজের ভাট্টায় কয়লা দিয়া আগুন জ্বালাইছে/ দেওয়ানা বানাইছে; কী যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগায়ছে” এই হলো শাহ আবদুল করিম-এর অন্তরের অভিঘাতের সচেতন প্রতিক্রিয়া। এখানে, লক্ষ করুন, আপ্তাবুনেচ্ছা শ্রীরামীর ঐতিহাসিক ভূমিকাটিই পালন করেছেন। শ্রীচৈতন্যদেবের ক্ষেত্রে লক্ষ্মীদেবী। পুরোহিতজীবনে চন্ডীদাস ঠিক সচেতন ছিলেন না, ছিলেন অপ্রধান পুরুষ, পুরোহিত বলেই সম্ভবত। শ্রীরামী ‘নারীর অবশ্য করনীয় কৃত্যটি পালন করলেন বলেই চন্ডীদাস সচেতন হলেন, বুদ্ধ হলেন, হয়ে, নির্দ্ধিধায় ঘোষনা করলেন- “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” চতুদর্শ শতকের মহাত্মা চন্ডীদাসের এই পবিত্রতম শ্লোকের একুশ শতকীয় ব্যাখ্যা এই রকমের - মানুষ, সে যেই হোক, নারী কিংবা পুরুষ, রংপুরের গঙ্গাচড়ার হা হা খরায় কি বিক্রমপুরের ভাগ্যকূলের ব্যাপক নদীভাঙ্গনে সে যেন কখনোই তার জন্মভিটে থেকে উৎখাত না হয়ে যায়। সে যে তার ঘরসংলগ্ন ক্ষিরা ক্ষেতের পাশে ডুমুর গাছটিকে বড় ভালোবাসে। সে যেই হোক, নারী কিংবা পুরুষ,কিংবা শিশু; বাংলার শ্যামল শিশুরা যেন ক্ষুধার্ত না-থাকে। তার মাকে যেন সর্বস্ব খুইয়ে চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট সীমান্ত পার হয়ে যেতে না হয় ...সীমান্তের পথে যেতে যেতে পথে ৫ বছরের শিশুকন্যাটিকে যেন ধর্ষিতা না হতে হয় ...কাজেই অগণন চন্ডীদাস, সার্ত্র ও এউরিপিদেস জন্মকামনায় উনিশ শতকে ছেউরিড়ার সাঁইজীর অনিবার্য নির্দেশ দিলেন-“ নারী হও। নারী ভজ।”। অতি গভীর, গভীরতম বাণী। কপিল-উৎসারিত বাংলার ভাব এই গভীরতম পরম উক্তির ওপরই দাঁড়িয়ে। কেননা, বাংলার ভাব, বাংলার প্রকৃতি, বাংলার নারী অতিমাত্রায় শিল্পপ্রবণ।..."
১০
"প্রাচ্য এখন ক্রমেই ডানা মেলছে। দেবদাসের সাফল্যকে প্রাচ্যের অপ্রতিরোধ্য উত্থান হিসেবেও চিহ্ণিত করা যায়। এদ্দিন সবাই পশ্চিমের গল্পই শুনেছে, এখন আবেগপ্রবণ প্রাচ্যের গল্প শোনার দিন এসেছে। এখন আমরা চাই - পদ্মাবতীর জীবন নিয়ে বিশাল আয়োজনে ছবি নির্মিত হোক। সীতা, বেহুলা,রাধা,শ্রীরামী,পদ্মাবতী ও পার্বতীর জীবন তো আবেগপ্রবণ প্রাচ্যেরই গল্প...এঁদের মধ্যে একমাত্র সীতা ও পার্বতী ইষৎ আলোকিত,অন্যরা ততটা নয়। যা হোক। বাঙালি চাইছিল পৃথিবীর রসিক মানুষগুলো শরৎ-বাউলকে চিনুক; বাঙালীর স্বপ্ন সার্থক হলো, বিশ্ববাসী দেবদাসকে জানল। এখন অক্সফোর্ডের শ্রেণিকক্ষে এক বাউলের আবেগপ্রবনতার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে,পাশ্চাত্য যে আবেগপ্রবণতার বরাবরই বিরোধী। ইউরোপে দীর্ঘদিন স্পিনোজার যুক্তিবাদী নীতিদর্শন গ্রহনীয় ও জনপ্রিয়। তবে,এখন দেবদাস-পাঠে পাশ্চাত্যের পুরনো ধারনায় চিড় ধরলেও ধরতে পারে। এখন বিশ্বময় বাংলার ছন্নছাড়া আবেগ প্রতিষ্ঠার দিন এসেছে, জগৎকে আরও কয়েক শতাব্দী টিকিয়ে রাখতে হলে জগৎময় বাংলার ভাবের চর্চার একান্ত প্রয়োজন; যে ভাব বলে - “মিলন হবে অন্ধকারে, জাত-অজাতের। কাজ কি রে তোর ল্যাম্ফোর (computerized civilization?) আলোতে?” কাজেই, বিশ্ব আজ বাংলার দিকে অবশ্যই তাকাবে,তাকাবে তার আবেগময় ইতিবৃত্তর দিকে। ... ১৯৩০। দিল্লীর রামযশ কলেজের স্বচ্ছল চাকরি ছেড়ে স্বেচ্ছায় বাংলায় ফিরে এলেন জীবনানন্দ। দিল্লীতে বাংলার মত অত ভেজা সবুজ ঘাস নেই বলে? ওই বছরই বিয়ে করলেন কবি, কন্যার জনক হলেন; তার পর পরই পড়লেন তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে। স্ত্রী লাবণ্য দাসের মুখ ভার,বিয়ের আগে কত কথা ভেবে রেখেছিলেন; দারুণ সুন্দরী ছিলেন দেখতে,ফিলমে নামার কত ইচ্ছে ছিল, অথচ ...এখন নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরতে লাগলেন;- রাত করে বাড়ি ফিরতেন কবিবউ; আর কবিটি, অস্থির পায়চারী করতেন বারান্দায়। হয়তো, দেওয়ালঘেঁষা কৃষ্ণচূড়াটির প্যাঁচাশূন্য ডালপালার ফাঁকে চেয়ে থাকতেন নির্বিকার চাঁদের দিকে... বুকের ভিতরে তোলপাড়, হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছে। লাবণ্য এখন কোথায়? এইসব উদ্বেগ। মধুমেহ রোগটা কি তখনই ধরল? দিল্লীর রামযশ কলেজে চাকরিটা থাকলে অবশ্য নিদারুন সঙ্কটে পড়তেন না কবি, স্ত্রী-কন্যা নিয়ে সুখে থাকতেন পরবাসে। কিন্তু, দিল্লী তো বাংলার মত নয় ...। জীবনে টাকাপয়সাই কি সব? জীবনানন্দ ছিলেন দেবদাসের মতন আবেগপ্রবণ। বাংলা ও পার্বতীরা এখানেই একাকার হয়ে যায়, বাংলার আবহমান শরতে; ১৯৭১-এ, যখন মৃত্যুপ্রবণ যুবারা...এভাবে,ছন্নছাড়া আবেগময়তার পাঠে আবেগসংক্রান্ত পাশ্চাত্যের প্রাচীন ধারনায় চিড় ধরলেও ধরতে পারে। ... স্পিনোজার যুক্তিনির্ভর নীতিদর্শনকে নিস্প্রভ মনে হতে পারে লালনের একটিমাত্র গানের পাশে - একটা পাগলামী করে/ জাত দেয় অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে। আবার হরি বলে পড়ছে ঢুলে ধূলার মাঝে। তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে ...যারা পাগলামী করে অজাতেরে জাত দেয়, তারাই আবার,আল্লাহ বলে ধূলার মাঝে ঢলে পড়ছে - তাদের তো স্পিনোজা কথা শোনার কথা নয়। বাংলার বাউলসূফীদের সামনে এসে স্পিনোজার কি বলার আছে? বিশ্বের অধিকাংশ প্রজ্ঞা ও সৌন্দর্যবোধই তো লালন ও রবীন্দ্রনাথের অধিকারে! ওই দুই বাউলের সামনে এসে স্পিনোজার কি বলার আছে? বাংলার পাগল নারীর কাছে ইষৎ পরিশ্রুত Judaic নীতিদর্শন কি এমন শুনি? কাজেই, এখন বিশ্বময় বাংলার ছন্নছাড়া আবেগ প্রতিষ্ঠার দিন। তবে এক্ষেত্রে সামান্য হুঁশিয়ারি দরকার - পাগলের সঙ্গে যাবি, পাগল হবি, বুঝবি শেষে! এই রকমই পাগলাটে আবেগ ছড়িয়েছিলেন শরৎ-বাউল। ২,৭০০ বছর আগে কপিল-বাউল...
আমরা এখন চাই পৃথিবীর সহৃদয় মানুষ দ্বাদশ শতকের বাঙালি কবি জয়দেবকে চিনুক। তাঁকে নিয়ে বিশাল কলেবরে ছবি নির্মিত হোক। নৃত্যকলায়, কাব্যে কেবল বাংলা নয় - কেরালাসহ সমগ্র দক্ষিণ ভারত মুগ্ধ করে রেখেছিলেন জয়দেব। এঁর স্ত্রী পদ্মাবতী ছিলেন দক্ষিণ ভারতের মেয়ে, ভালো নাচতেন ...। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, “রাধাকৃষ্ণের ধ্যান-কল্পনাও বোধ হয় এই পর্বের বাঙলাদেশেরই সৃষ্টি এবং কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ- গ্রন্থেই বোধহয় প্রথম এই ধ্যান-কল্পনার সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রচলিত রূপ আমরা দেখিতেছি।” গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবই তা হলে রাধা-কল্পনা করেছেন? যে রাধাকে সমগ্র উপমহাদেশের আপামর নারীপুরুষ মনে করে বাস্তব-কাল্পনিক নয় । ... এ মোটেও কাকতালীয় নয় যে নারীবাদী সাংখ্যদর্শনের পীঠস্থানে - এই বাংলায় রাধা কল্পনা সম্ভব,অন্যত্র নয়। রাধা, এভাবে বাংলারই নিজস্ব কল্পনা, পার্বতীও। এভাবে,ভাবুক কপিলের সঙ্গে শরৎ বাউল ও বাউল জয়দেবের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। এভাবে আমরা একীভূত হয়ে যাই। রাধা,আবহমান বাংলার নারীবাদী ভাব-দর্শনের এক অনিবার্য অধ্যায়। ষোড়শ শতকে শ্রীচৈন্যদেব রাধাতত্ত্বের ব্যাখ্যা করে বললেন - “আমার অন্তরে রাধা বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।” পৃথিবীর মানবিক সম্পর্ক আমূল বদলে দেওয়ার জন্য এই শোকটিই যথেষ্ট। বিষয়ী পুরুষেরা বলবেন-কোথাকার কোন্ নদের পাগল গায়কের খেয়াল ...আমরা বলব, মোটেও তা নয়, বরং, সার্ত্র No Exit (Huis Clos,1944) নাটকে প্রেম সংক্রান্ত যে সমস্ত অনিবার্য সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন – এ শ্লোকে তারই সমাধান নিহিত। এ কারণে বাঙালির অহেতুক Phenomenology চর্চার প্রয়োজন নেই,প্রয়োজন গানের আসর।...
অসাধারণ তিনটি বাংলা গানের কথা বলি। কুড়ি শতকে বাংলার এক বাউল গাইলেন - “বনমালী তুমি, পর জনমে হইও রাধা।” রাধা যে বাংলার - এভাবে তার প্রমাণ হয়ে যায়। শ্রীচৈন্যদেব পিতৃপুরুষের ভিটা যেখানে ছিল - সেই বৃহত্তর সিলেটের রাধারমন গাইলেন, “ভ্রমর কইও গিয়া শ্রীকৃষ্ণের বিচ্ছেদের অনলে...।” রাধা যে বাংলার - এভাবে তার প্রমাণ হয়ে যায়। হাসন রাজার উত্তরসূরী শাহ্ আবদুল করিম গাইলেন:“কৃষ্ণয় দিলা রাধার গলে/ রাধায় দিলা কৃষ্ণর গলে/আনন্দে সখীগন নাচে দেখিয়া প্রেমের খেলা।” রাধা যে বাংলার - এভাবে তার প্রমাণ হয়ে যায়। রাধা,আবহমান বাংলার নারীবাদী ভাব-দর্শনের এক অনিবার্য অধ্যায়। সূক্ষ্ম বিচারে, পার্বতীকেও (এমন কী শ্রীরামী ও চন্দ্রাবতীকেও তাদের আশ্চর্য গভীর ব্যক্তিজীবনের জন্য ) আবহমান বাংলার ভাব-দর্শনের এক অনিবার্য অধ্যায় বলেই মনে হয়। বাংলার ভাবকে উপলব্দি করতে হলে রাধা-শ্রীরামী-চন্দ্রাবতী ও পার্বতীর জীবনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ জরুরি।
বাংলার ভাব মাতৃতান্ত্রিক। রাধা-শ্রীরামী-চন্দ্রাবতী ও পার্বতী - এই চার-কন্যার জীবন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক ভাবকে রহস্যাবৃত করেছে। দেহ ও মনে ‘চমক জ্বরা’ বোধ করে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে হলে জীবনের আশেপাশে প্রচুর রহস্যময় বিষয়াদি চাই। রাধা-শ্রীরামী-চন্দ্রাবতী ও পার্বতী। এদের মধ্যে দু’জন বাস্তব, দু’জন কাল্পনিক। এভাবে বাস্তব ও কল্পনা একমাত্র বাংলাতেই একাকার হয়ে যেতে পারে। বাংলার নারী সংসার করে বাস্তব পুরুষের সঙ্গে, মনে থাকে কল্পনার পুরুষ, এও এক রহস্য, এ রহস্যটি থাক। দেহ ও মনে ‘চমক জ্বরা’ বোধ করে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে হলে জীবনের আশেপাশে প্রচুর রহস্যময় বিষয়াদি চাই। এ কারণে আমাদের অহেতুক Phenomenology চর্চার প্রয়োজন নেই,প্রয়োজন গানের আসর। গানে-গানে কখনও কল্পনার মানুষটিকে জানা সম্ভব। লালন সে রকমই একটি নির্দেশ দিয়ে গেছেন - ‘নিগূঢ় বিচারে সত্য গেল যে জানা/মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা।’ ..."
১১
"...ঢেউ এসে ভেজা বালির ওপর লেখা গল্পটা মুছে দিতে লাগল দেখে কপিল মুচকি হাসেন।..."
______________
মূল উৎস (প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত)
আমার তো কপিলে বিশ্বাস – ইমন জুবায়ের
শরৎ-বাউল – ইমন জুবায়ের
প্রেরিত পুরুষ – ইমন জুবায়ের
পূর্বাহ্ণের আগুন – ইমন জুবায়ের
শেষ দৃশ্যে কবি – ইমন জুবায়ের
আকাশে মণিমালার মুখ – ইমন জুবায়ের