সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১)
খুব ছোট একটি অসঙ্গতি দিয়ে শুরু হয়েছে যাতে পাঠকরা বুঝতে পারেন কত হেলাফেলা করে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে।
নোট: সংবিধানটি প্রথমে ইংরেজিতে প্রণয়ন করা হয়, পরে সেটা বাংলায় অনুবাদ করা হয়। উভয় ভাষার সংবিধানকে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সেই সাথে উল্লেখ করা হয় যে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। তাই এই লেখা বাংলাতে হলেও ব্রাকেটে ইংরেজি শব্দ বা ব্যাখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ (article) না ধারা (section)?
যেকোন আইনকে প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা করার জন্য ধারাবাহিক ভাবে সাজাতে হয়, যেমন অনুচ্ছেদ (article), ধারা (section), দফা (clause) ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সংবিধানে ১ থেকে ১৫৩ টি ক্রমিক সংখ্যা আছে। এই ক্রমিক সংখ্যাগুলি অনুচ্ছেদ (article), না কি, ধারা (section) হিসাবে পরিচিত হবে?
সংবিধানের শুরুতেই প্রস্তাবনার (Preamble) ঠিক নিচে সূচি (Contents) দেয়া হয়েছে। এই সূচির বাম দিকে ১ থেকে ১৫৩ ক্রমিক সংখ্যার ঠিক উপরে এই ক্রমিক সংখ্যাগুলিকে ধারাসমূহ (Sections) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ভিতরে সর্বত্র এই সংখ্যাগুলিকে অনুচ্ছেদ (article) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পর্যন্ত পড়ে অনেকেই একটা কুতর্ক শুরু করে দিতে পারেন যে সূচি (Contents) সংবিধানের অংশ না। তাই সূচিতে কি লেখা আছে তাতে কিছু যায় আসে না। আপাতত এই কুতর্কে না যেয়ে এটা বলা যায় যে সরকারি ভাবে প্রকাশিত সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য দলিলে ক্রমিক নম্বরগুলির পরিচয় ধারা (section) না লিখে অনুচ্ছেদ (article) লেখা যেত। তাহলে আপাতত এই জায়গায় কোন অসঙ্গতি থাকতো না।
আইনের পরিভাষায়, এমন কি আভিধানিক অর্থেও অনুচ্ছেদ (article) এবং ধারা (section) এক জিনিস নয়।
আইনের পরিভাষায় অনুচ্ছেদ (article) হচ্ছে সম্পূর্ণ আইনটির খণ্ড ভাগ বা একই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি সেট। আর ধারা (section) হচ্ছে একটি অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত বিধান সমূহ। অর্থাৎ কতগুলি ধারার সমন্বয়ে একটি অনুচ্ছেদ। যেমন কতগুলি বাক্যের সমন্বয়ে একটি অনুচ্ছেদ।
আবার চুক্তির ক্ষেত্রে পক্ষগুলির প্রতিটি অধিকার, দায়িত্ব এবং বাধ্যবাধকতাকে অনুচ্ছেদ (article) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
যেমন, সংবিধানে লেখা হয়েছে, "প্রথম ভাগ প্রজাতন্ত্র" তারপর অনুচ্ছেদ (article) ১, ২, ৩ ইত্যাদি। এই ধারাক্রম সম্পূর্ণ ভুল। এটা হওয়া উচিত ছিল "প্রথম অনুচ্ছেদ প্রজাতন্ত্র" তারপর ধারা ১, ২, ৩ ইত্যাদি।
সংবিধানের সর্বত্র এই ধারাগুলিকে ভুলক্রমে অনুচ্ছেদ (article) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন ধারার জায়গায় অনুচ্ছেদ লিখাতে আইনগত কি অসুবিধা হয়েছে? আইনগত অসুবিধার চাইতে এই অসঙ্গতি দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে সংবিধান প্রণয়নের সময় লিগ্যাল জুরিসপ্রুডেন্স, লিগ্যাল থিউরি, লিগ্যাল ফিলসফি ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দেয়া হয় নাই। সংবিধান ও আইন লেখার সময় জুরিসপ্রুডেন্সের কতগুলি নীতি অনুসরণ করতে হয়। শুধু আইন বা সংবিধান না, যেকোন লিগ্যাল ডকুমেন্ট তৈরির সময় নির্দিষ্ট ফরমেন্ট ব্যবহার করতে হয়। যেমন আর্জি বা জবাব লেখার একটা ফরমেন্ট আছে। এই ফরমেন্ট এমনই সুনির্দিষ্ট যে কার্যবিধি আইনে ফরমেন্টের নমুনা দেয়া আছে। অর্থাৎ কেউ আর্জি বা জবাব লেখার সময় নিজের ইচ্ছা অনুসারে লিখলে হবে না, আইনে নির্ধারিত ফরমেট অনুসারে লিখতে হবে। তাই এই ধরণের ছোট অসঙ্গতিগুলি বিবেচনায় রাখলে সংবিধানের বড় বড় অসঙ্গতিগুলি নিয়ে আলোচনা করার সময় এর অন্তর্নিহিত কারণগুলি ধরতে সুবিধা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৮