আজ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন। একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনে বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের জঘণ্যতম নৃশংসতা। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রাতের অন্ধকারে পাক জল্লাদ বাহিনী এক দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। গণহত্যার নীলনকশা 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে পাকিস্তানী দানবরা মেতে ওঠে নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধনযজ্ঞে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রায় অর্ধলক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালিকে।
বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুর, নির্মম ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা। একাত্তরের এদিনে চির আকাক্সিক্ষত ও প্রিয় স্বাধীনতার জন্য উন্মাতাল লাখো বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার মাটি। ঘুমন্ত শিশু, বধূ, বৃদ্ধার রক্তে কলঙ্কিত হয় মানব ইতিহাস। সেই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা চেঙ্গিস খান-হালাকু খানদের নৃশংস নির্মমতাকেও হার মানায়।
এ রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘণ্যতম গণহত্যা। ন'মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে। মাত্র ন'মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই।
কী ঘটেছিল সেই ভয়াল রাতে সূর্য ডুবল। পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট বিমানে করাচী পাড়ি দিলেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন।
কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারাদিন ধরে রোদেপোড়া নগরী চৈত্রের হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। তারপর দু'ঘণ্টাও যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে জীপ, ট্রাকবোঝাই দিয়ে সৈন্য ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা ছক অনুযায়ী পজিশন নিচ্ছে। গোলান্দাজ, সাঁজোয়া পদাতিকথ তিন বাহিনী থেকে বাছাই তিন ব্যাটালিয়ন ঘাতক।
রাত ১০টা ৩৫। নর্থ ঢাকায় সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল বর্তমানে শেরাটন হোটেল ঘিরে ফেলেছে। ডিসিপশনে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন বাচ্চা ক্যাপ্টেন লিখে দিলেন বাইরে বেরুলেই গুলি। বিদেশী সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। না কাফর্র কোন ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে কানপাতা দায়। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। কাঁচা ঘুমে জাগানো বারণ। ঢাকা-করাচী টেলিপ্রিন্টার লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচারও। কেউ জানতেই পারেনি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা।
'অপারেশন সার্চলাইট' নামে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে মার্কিন ট্যাঙ্ক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানী হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। অসহায় নারী-পুরুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তাণ্ডব। প্রতিটি রুমে রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জল্লাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধার্ত শকুনীরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; পাকি জান্তা সেই রাতে বাবার সামনে মেয়েকে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। কাউকে কাউকে তারা সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোঁড়ার কাজ করতে। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তে। তাদের দিয়েই একে একে সহপাঠীদের লাশ টানিয়ে এনে মাটিচাপা দিয়েছিল পাক সেনারা। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। কাজ শেষে তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১১ রাত ১২:৩৭