somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চে গুয়েভারা | কমরেড লাল সালাম

০৯ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সারা বিশ্বের কাছে 'চে' নামে পরিচিত বিপ্লবী চে গুয়েভারার পুরো নাম- এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না। ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন তিনি আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই চে গুয়েভারার অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগ ধরা পড়ে। তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য তার বাবা-মা রোসারিও শহর ছেড়ে আলতা গার্সিয়া নামের একটি ছোট শহরে চলে আসে। হাঁপানির থাকায় চে'র পরিবার তাঁকে খুব একটা বাইরে খেলতে পাঠাতেন না। শৈশবে তাঁর সময় কেটেছে ঘরবন্দী অবস্থায় বই পড়ে।

১৯৪৮ সালে চে আর্জেন্টিনার ইউনিভার্সিটি অব বুয়েনস আয়ার্সের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। সে সময় চে'র ছিল ভ্রমণের নেশা। ডাক্তারি পড়া শেষ না করেই আলবার্তো গ্রানাদোর সঙ্গে তিনি ১৯৫০ সালে মোটরসাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা দেখতে বের হয়ে পরে। এইসব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা চে রোজনামচা আকারে লিখে রাখেন। যা পরে "মোটরসাইকেল ডায়েরিস" নামে প্রকাশ করা হয়। দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণের সময় সেখানকার শ্রমিক ও আদিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা দারিদ্র্যের জীবন এবং সমাজের শ্রেণিভেদ চে গুয়েভারার হৃদয়ে গভীর ভাবে দাগ কাটে। ভ্রমণ শেষে আর্জেন্টিনায় ফিরে চে তার ডায়েরিতে লিখেছেন, "আমি আর আগের মানুষটি নেই। ল্যাটিন আমেরিকায় উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ আমাকে কল্পনার চেয়েও বেশি পাল্টে দিয়েছে।"

চে গুয়েভারার জীবনী লিখে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মাঝে একজন মার্কিন সাংবাদিক জন লি অ্যান্ডারসন। চে গুয়েভারাকে নিয়ে লেখা "চে গুয়েভারা : আ রেভ্যুলুশনারি লাইফ" বইতে তিনি বলেছেন, ডাক্তারি পড়া শেষ করে চে গুয়েভারা ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে আবারও দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু এবার তিনি এমন একটি সময়ে ভ্রমণে বের হয়েছেন। যখন ক্যারিবিয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্র কিউবাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। স্বৈরশাসক ফুলখেনসিও বাতিস্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে সে সময় অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। যাদের মধ্যে তখনকার তরুণ নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও ছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই চে গুয়েভারা মধ্য আমেরিকার দেশ গুয়াতেমালায় পৌঁছান। সেখানে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

কিউবায় বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের অনেকে তখন গ্রেফতার এড়াতে গুয়াতেমালায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদেরই একজন হলেন আন্তনিও নিকো লোপেজ। কিছুদিনের মধ্যে লোপেজের সঙ্গে চে গুয়েভারার দেখা হয় এবং দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। লোপেজ সে সময় চে গুয়েভারাকে "এল চে আর্জেন্টিনো" বা "আর্জেন্টিনার চে" নামে ডাকা শুরু করেন। যা পরবর্তীতে আরও ছোট হয়ে "চে" নামে বেশি পরিচিতি পায়।

লোপেজের কাছ থেকে চে গুয়েভারা কিউবার তরুণ নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এবং তাদের আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারেন। সে সময় গুয়াতেমালাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। ১৯৫৪ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। তখন গুয়াতেমালা ছেড়ে চে প্রথমে এল সালভেদর এবং পরে মেক্সিকোতে চলে আসেন। মেক্সিকোতে চে রাজনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫৫ সালের মে মাসে ফিদেল কাস্ত্রো কারাগার থেকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান। পুনরায় গ্রেফতার এড়াতে ফিদেল কাস্ত্রো মেক্সিকোতে পালিয়ে আসেন। ১৯৫৫ সালে মেক্সিকোতে এক গ্রীষ্মের রাতে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে প্রথমবারের মতো দেখা হয় চে গুয়েভারার। সেই রাতে তারা দু’জন কয়েক ঘণ্টা ধরে আলাপ-আলোচনা করেন। পরের দিন সকালে ফিদেল কিউবার গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য চে-কে আমন্ত্রণ জানান এবং চে তাঁর প্রস্তাবে রাজি হন।

১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বরে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় চড়ে চে, কাস্ত্রো এবং ৭৯ জন সঙ্গীদের সাথে কিউবার পথে পাড়ি দেন। নৌকাটি পূর্ব উপকূলের কাছে পৌঁছালে কিউবার সামরিক বাহিনীর দ্বারা হামলার শিকার হয়। এতে বেশির ভাগ সঙ্গী মারা গেলেও ফিদেল কাস্ত্রো এবং চে প্রাণে বেঁচে যান। সেখান থেকে তারা সিয়েরা মায়েস্ত্রা নামের একটি পাহাড়ে আত্ব-গোপন করেন এবং নতুন গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন। পরবর্তী দুই বছর তারা হাভানার সরকারের উপর গেরিলা আক্রমণ চালাতে থাকেন। গেরিলা যুদ্ধে সাহসী ভূমিকায় রাখায় চে-কে গেরিলা যুদ্ধের কমান্ডার করেন ফিদেল কাস্ত্রো। দুই বছর যুদ্ধ চলার পর ১৯৫৯ সালের ১'লা জানুয়ারি গেরিলা যোদ্ধারা কিউবার রাজধানী হাভানায় প্রবেশ করে এবং সেনা শাসক বাতিস্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেন এবং সমাতান্ত্রিক ধারায় এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন।


ছবি : চে গুয়েভারা। তখন তিনি কিউবার শিল্পমন্ত্রী।

বিপ্লবের পর চে গুয়েভারাকে দেওয়া হয় কিউবার নাগরিকত্ব এবং তাকে কিউবার শুভেচ্ছা দূত বানিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে সফরে পাঠান হয়। ১৯৫৯ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে চে কিউবা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ইন্দোনেশিয়া প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সফরের চে'র উদ্দেশ্য ছিলো ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করা দেশগুলোকে কিউবার বিপ্লবের পক্ষে আনা এবং তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা। যা করতে চে সফল ভাবে সক্ষম হন। সফর শেষে তাকে কিউবার শিল্পমন্ত্রী ও কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করা হয়। কিন্তু বেশি দিন এই কাজে তাঁর মন বসেনি। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করে কিউবা ছেড়েন।

একাধিক দেশ ঘুরে মধ্য আফিকার কঙ্গোতে তার দুইমাসের সফর শেষ হয়। কঙ্গোর পরিস্থিতি দেখে চে সিদ্ধান্ত নেয় এখানে সে তার নতুন সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করবে। প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য চে পুনরায় কিউবা ফিরে আসে। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে কিউবা থেকে একদল গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে চে কঙ্গোতে ফিরে আসে। কিন্তু কঙ্গোতে সফলতা না পেয়ে চে এবার দক্ষিণ আমেরিকায় নজর দেয়। বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৬৬ সালের নভেম্বর চে বলিভিয়ায় আসে। বলিভিয়ায় তখন ক্ষমতায় দক্ষিণ-পন্থী সামরিক সরকার। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধের উত্তেজনা তখন চরমে। লাতিন আমেরিকায় কমিউনিস্টদের প্রভাব নিয়ে ওয়াশিংটন তখন বেশ উদ্বিগ্ন। চে গুয়েভারা তাঁর কিউবা থেকে আনা একটি অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের দল নিয়ে বলিভিয়ায় গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেন। গেরিলা বাহিনী সাথে নিয়ে চে চলে যান গহীন জঙ্গলে। তবে চে গুয়েভারার শ্বাসকষ্ট থাকায় তার বাহিনীর গতি শ্লথ হয়ে আসে। অ্যাজমার ঔষধ সংগ্রহ করা কঠিন হবে বলে তারা সেরকম গহীন জায়গায় যেতে পারত না। বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে চে ও তাঁর যোদ্ধারা প্রাথমিক কিছু সাফল্য পেলেও ধীরে ধীরে তাদের বেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

১৯৬৭ সালে ৭ অক্টোবর মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র সাহায্য নিয়ে গভীর সংকীর্ণ এক উপত্যকায় বলিভিয়ার সেনাবাহিনী চে গুয়েভারার গেরিলা বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। আক্রমণে চে আহত অবস্থায় ধরা পরে। হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাত থেকে রাইফেল খসে পড়লে বলিভিয়ার জঙ্গলে চে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাঁকে ঘিরে থাকা সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে চে গুয়েভারার শেষ আকুতি ছিল, "গুলি কোরো না। আমি চে গুয়েভারা। মৃত চে গুয়েভারার চেয়ে জীবিত চে গুয়েভারা তোমাদের জন্য বেশি মূল্যবান।"

সিআইএ’র এজেন্ট "ফেলিক্স রড্রিগেজ" যিনি চে গুয়েভারাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করেছিলেন। ফেলিক্স রড্রিগেজ তার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ’র হয়ে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
বিবিসির মাইক ল্যানচিনকে দেয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে রড্রিগেজ এই কাহিনীর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন, চে তার বিশ্বাস বলিভিয়াতেও ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলিভিয়ার প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবেন। বলিভিয়া ছিল অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ। তিনি মনে করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এরকম দরিদ্র একটি দেশের ব্যাপারে আগ্রহী হবে না। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট রেনে বেরিয়েন্টো ভীত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চান। যুক্তরাষ্ট্র তখন বলিভিয়ার বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫ জন সামরিক উপদেষ্টা বলিভিয়া গিয়ে পৌঁছায়। আমি সহ দুজনকে বাছাই করা হয়। আমাদের কাজ ছিল চে গুয়েভারা বলিভিয়ার যে এলাকায় কাজ করতেন, সেখান থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা। দিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর। আমরা তখন ভায়াগ্রান্ডিতে। বলিভিয়ার বিমান বাহিনীর জন্য কিছু যন্ত্রপাতি পাঠানো হচ্ছিল। তখন আমরা জানতে পারি যে চে গুয়েভারাকে ধরা হয়েছে। তাকে দেখার জন্যও আমার মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরি হলো। পরের দিন হেলিকপ্টারে করে আমি একটা স্কুলে যাই। যেখানে চে গুয়েভারাকে রাখা হয়েছিল। আমি একটা ঘরে ঢুকে দেখলাম তাকে বেঁধে এক কোনায় মেঝের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে। সেই ঘরে চে গুয়েভারার সামনে পড়েছিল কিউবার কয়েকজন কর্মকর্তার মৃতদেহ। যারা মারা গিয়েছিল অভিযানের সময়। একটি ঝোলা দেখলাম যার মধ্যে ছিল চে গুয়েভারার একটা ডায়েরি, অ্যাজমার কিছু ঔষধ এবং কমিউনিস্ট চীনের একটা কোড বুক।

আমি ঐ ঘরে একাই গিয়েছিলাম। চে'র সামনে দাঁড়ালাম। বললাম, চে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। মেঝেতে বসে থেকে সে ক্রুদ্ধ চোখে আমার দিকে তাকালো। বললো, আমার সাথে কেউ কথা বলতে পারে না। আমাকে কেউ জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারে না। আমি বললাম, কমান্ডার, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনি যা ভাবছেন, সেটা ভুল। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, জিজ্ঞাসাবাদ করতে নয়। চে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কথা বলতে শুরু করলো। যতবারই আমি তাকে প্রশ্ন করে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বের করার চেষ্টা করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, না। আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব না। একটা সময় তিনি কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু আমার তাতে মনোযোগ ছিল না। আমি ভাবছিলাম খবরে আমি যে মানুষটাকে দেখেছি। বড় কোট পরা উদ্ধত একজন মানুষ। লাল চীনে গিয়ে মাও জেদং এর সঙ্গে কথা বলছেন। সেই লোকটাকে এখন দেখা যাচ্ছে ভিক্ষুকের মতো। তাঁর পোশাক ছেঁড়া ও ময়লায় ভরা এবং হাত-পা বাঁধা।

বলিভিয়ার হাই কমান্ড থেকে একটি টেলিফোন এসেছিল। আমি যখন ফোনটা ধরলাম, আমাদের মধ্যে খুব সহজ কথাবার্তা হলো। তারা আমাকে বললো ফাইভ হানড্রেড, সিক্স হানড্রেড। ফাইভ হানড্রেড মানে চে। সিক্স হানড্রেড মানে নিহত চে। আর সেভেন হানড্রেড মানে ছিল জীবন্ত চে গুয়েভারা। আমি তাদেরকে বার্তাটি পুনরাবৃত্তি করতে বললাম। তারা বললো ফাইভ হানড্রেড, সিক্স হানড্রেড। কর্নেল সান্তিনারি যখন অপারেশন শেষে ফিরে এলেন। আমি তাকে বললাম, হাই কমান্ড থেকে আমাকে ফাইভ হানড্রেড, সিক্স হানড্রেড বার্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার সরকারের নির্দেশ হচ্ছে, যে কোন মূল্যে তাকে বাঁচিয়ে রাখা। নির্দেশনা ছিল খুব পরিষ্কার। সিআইএ চে গুয়েভারাকে জীবন্ত দেখতে চায়। তার কাছ থেকে আরও তথ্য বের করার জন্য। কিন্তু বলিভিয়ার সামরিক বাহিনী তাকে মৃত দেখতে চায়। প্রকাশ্যে বিচার হলে তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের সমবেদনা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সরকারি ভাষ্য ছিল, তিনি যুদ্ধকালে মৃত্যুবরণ করেছেন।

চে গুয়েভারাকে মেরে ফেলার নির্দেশটি এসেছিল বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। কর্নেল সান্তিনারি আমাকে বলেছিলেন, আমি দুপুর পর্যন্ত চে গুয়েভারাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবো। তারপর যেন চে’র মৃতদেহ নিয়ে তার কাছে আসি। এরপর আমি আবার চে’র ঘরে যাই। ঘরে গিয়ে বললাম, কমান্ডার, আমি দুঃখিত। আপনার কোন শেষ কথা থাকলে বলতে পারেন। সেটা আপনার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেব। চে তখন বললো, আমার স্ত্রীকে বলবেন, আবার বিয়ে করতে এবং সুখী হওয়ার চেষ্টা করতে। এটাই ছিল তার মুখ থেকে শেষ কথা। তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা করমর্দন করলাম। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি হয়তো ভাবছিলেন, আমি তাকে গুলি করতে যাচ্ছি। তারপর আমি ঘর থেকে চলে এলাম। একটা দশ বা একটা কুড়ি মিনিটের দিকে আমি গুলির শব্দ শুনতে পেলাম।

সাংবাদিক জন লি এন্ডারসনের আত্মজীবনী "চে গুয়েভারা : আ রেভল্যুশনারি লাইফ" নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, চে গুয়েভারাকে গুলি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যাইমি টিরান নামক জনৈক সার্জেন্টকে। চে গুয়েভারা তাঁকে বললেন, "আমি জানি তুমি আমাকে খুন করতে এসেছ। গুলি করো। তুমি কেবল একজন মানুষকে মারতে যাচ্ছো।" টিরান চে গুয়েভারার হাত, পা এবং বুকে গুলি করলেন।

চে গুয়েভারা এবং তার সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হলো ভায়াগ্রান্দি। গণকবরে সমাহিত করার আগে মরদেহটি একটি হাসপাতালের লন্ড্রির সিঙ্কে রাখা হয়। এ সময় ফটোগ্রাফাররা তাঁর যেসব ছবি তোলেন, তা পরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বলিভীয় সেনা অধিনায়ককে বলা হয় তাঁর দুটি হাত কেটে রাখতে। যাতে কর্তৃপক্ষ তাঁর আঙুলের ছাপ নিতে পারে এবং প্রমাণ হিসেবে ফিদেল কাস্ত্রোকে দেখাতে পারে যে তাঁর বন্ধু এখন মৃত।

১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর চে গুয়েভারার মৃত্যুর সংবাদ যখন সারা পৃথিবী জানতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তখন লিখেছিল, "একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।" আসলে কথাটা সত্য হয়নি। কমরেডের মৃত্যুর পর কিউবায় লাখো জনতার সামনে আবেগঘন কণ্ঠে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, "যারা মনে করেছে, চে গুয়েভারার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর আদর্শ বা তাঁর রণকৌশলের পরাজয় ঘটেছে, তারা ভুল করেছে।"

১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণ-কবরে চে ও তার সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। সেখান থেকে তাঁর কবর তুলে তা কিউবায় ফেরত পাঠানো হয়। সান্তা ক্লারা, কিউবায় পূর্ণ সামরিক সম্মানের সঙ্গে তাঁর সমাহিতকরণের কাজ সম্পন্ন করা হয়।


ছবি : চে গুয়েভারা (বামে) এবং ফিদেল ক্যাস্ত্রো (ডানে)। ১৯৫৯ সালে তারা সফল বিপ্লবের মাধ্যমে কিউবায় বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটান।

ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, যারা মনে করেছে, চে গুয়েভারার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর আদর্শ বা তাঁর রণকৌশলের পরাজয় ঘটেছে, তারা ভুল করেছে। আসলেই সত্যি তারা ভুল ভেবেছিল। মৃত্যুর পর আজও চে গুয়েভারা অমর হয়ে রয়েছে সারা বিশ্বের বিপ্লবীদের মাঝে। কমরেড চে গুয়েভারা লাল সালাম।।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:৩০
২২৮ বার পঠিত
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

১৯৭২-এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ২০২৪-এর অর্জন না

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ ভোর ৫:৩৯


৭২-এর রক্তস্নাত সংবিধান বাতিল করে । নিজেদের আদর্শের সংবিধান রচনা করতে চায় এরা‼️বাংলাদেশের পতাকা বদলে দিতে চায়! বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ভালো লাগেনা এদের!জাতিয় শ্লোগানে গায়ে ফোস্কা পরা প্রজন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১১:০০

প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় এখন আর কেউ নিজের মতো হতে চাই না, হতে চাই বিশ্ববরেণ্যদের মতো। শিশুকাল থেকেই শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সব ছাত্রদের মাথায় জিপিএ ৫, গোল্ডেন পেতে হবে! সবাইকেই ডাক্তার,... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। এইচএমপিভি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৩




করোনা মহামারির ৫ বছরের মাথায় নতুন একটি ভাইরাসের উত্থান ঘটেছে চীনে। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নামের নতুন এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে দেশটিতে।চীনের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাকিস্তান, আমেরিকা, জামাত-শিবির আমাদেরকে "ব্যর্থ জাতিতে" পরিণত করেছে।

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৭



আজকে সময় হয়েছে, আমেরিকান দুতাবাসের সামনে গিয়ে বলার, "তোরা চলে যা, ট্রাম্পের অধীনে ভালো থাক, আমরা যেভাবে পারি নিজের দেশ নিজেরা গড়বো। চলে যাবার আগে তোদের পাকী... ...বাকিটুকু পড়ুন

=হয়তো কখনো আমরা প্রেমে পড়বো=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৯:০০


পোস্ট দিছি ২২/১২/২১

©কাজী ফাতেমা ছবি

কোন এক সময় হয়তো প্রেমে পড়বো আমরা
তখন সময় আমাদের নিয়ে যাবে বুড়ো বেলা,
শরীরের জোর হারিয়ে একে অন্যের প্রেমে না পড়েই বা কী;
তখন সময় আমাদের শেখাবে বিষণ্ণতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×