শিক্ষক নিয়ে লেখা আমরা অনেকে কবিতা পড়েছি। অনেকেই শিক্ষকের সম্মান, ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় অনেক কবিতা লিখেছেন। শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে লেখা "শিক্ষাগুরুর মর্যাদা" নামক একটা কবিতা আমি ছোটবেলায় পড়েছিলাম। যা আমার শোনা শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
একদিন ভোরবেলা দিল্লীর বাদশাহ্ আলমগীর দেখেন তার প্রিয় পুত্র মৌলভী শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে। আর শিক্ষক তার নিজ হাতে পায়ের আঙ্গুলে লেগে থাকা ধুলাবালি পরিষ্কার করছেন। ইহা দেখে বাদশাহ্ আলমগীর পরের দিন শিক্ষককে তার কেল্লায় তলব করলেন। বাদশাহর তলব শুনে মৌলভী শিক্ষক মনে করলো আজ তার আর প্রাণে রক্ষা নেই। সামান্য শিক্ষক হয়ে সে বাদশাহর কলিজার টুকরা প্রিয় পুত্রের দ্বারা পানি ঢালিয়েছেন। এমন অপরাধে আজ বোধহয় বাদশাহ তার গর্দান উড়িয়ে দিবেন।
এমন সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভয়ভীতি কথা ভাবতে ভাবতে মৌলভী শিক্ষক চিন্তা করলেন, আমি শিক্ষক শিক্ষাগুরু, আমি সবার শ্রেষ্ঠ, আমার কিসের ভয়। কাল্লা কাটা গেলেও যাক তবু আজ সে বাদশাহ্ আলমগীরকে বলবে, শাস্ত্রে লেখা শিক্ষকের সম্মান এবং মর্যাদা কত বড়, যার সামনে বাদশাহ কিছুই না।
পরদিন বাদশাহর একজন দূত এসে মৌলভী শিক্ষককে বাদশাহর কেল্লায় নিয়ে গেলেন। তাকে প্রবেশ করানো হলো বাদশাহর খাস কামরায়। কামরায় ঢুকে শিক্ষক বাদশাহর মুখোমুখি দাঁড়ালেন। বাদশাহ শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কি আমার পুত্রকে কোন সৌজন্য শেখান নি? সেদিন সকালে দেখলাম, আমার পুত্র আপনার চরণে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর আপনি নিজ হাতে আপনার পায়ের ধুলাবালি পরিষ্কার করছেন। তবে কি আমরা পুত্রকে আপনি কেবল গুরুজনদের প্রতি বেয়াদবি আর অবহেলায় শিখিয়েছেন? এসব দেখে আমি অন্তরে খুব আঘাত পেয়েছি। কেন আমার পুত্র নিজ হাতে আপনার পায়ের ধুলো পরিষ্কার করে দেয়নি।
বাদশাহ্ আলমগীরের মুখ থেকে এমন কথা শুনে, মৌলভী শিক্ষক আবেগে আপ্লুত হয়ে বাদশাহকে সালাম জানিয়ে বললেন,
”আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”
এভাবে দিল্লির মহান সম্রাট বাদশাহ্ আলমগীরের কাছ থেকে শিক্ষক পেয়েছিলেন তার মর্যাদা। একেই বলে শিক্ষকের প্রতি সম্মান। কাজী কাদের নেওয়াজ -এর লেখা শিক্ষাগুরুর মর্যাদা নামক কবিতা পরে দেখতে পারেন।
শিক্ষাগুরুর মর্যাদা
কাজী কাদের নেওয়াজ
বাদশাহ্ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলবী দিল্লীর্
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশা-শাহাজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধূলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলবী
ভাবিলেন, আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝ তাঁর সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ, হেন অপরাধ কে করেছে-কোন কালে।
ভবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তাঁর ভালে।
হঠাৎ কী ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি নাক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক অমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন ছার,
ভয় করি নাক, ধারি নাক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।
তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
শিক্ষকে ডাকি বাদশাহ কহেন,‘শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে
সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নাহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা।’
শিক্ষক কন-‘জাহাপনা, আমি বুঝিতে পারি নে, হায়,
কী কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?’
বাদশাহ কহেন, ‘সেদিন প্রভাতে
দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাত খানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যাথা পাই মনে।’
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষক তবে দাঁড়ায়ে সগৌরবে,
কুর্ণিশ করি বাদশাহর তরে কহেন উচ্চরবে-
‘আজ হতে চিরউন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’
পক্ষান্তরে আজকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষকের সম্মান নিয়ে বলার মত আমার কিছুই নেই। সব আপনাদের চোখের সামনে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:২১