“বিউটিফুল ব্রিটিশ কলাম্বিয়া” গাড়ীর নাম্বার প্লেটের উপরের অংশে স্পষ্ট অক্ষরে লিখা। রাস্তাঘাট অনেকটা আমেরিকার সাদৃশ্য তবে মূল সমস্যা স্পীডিং। জিপিএস এ দেখাচ্ছে মাইল হিসেবে কিন্তু রাস্তায় লিখা স্পীড লিমিট “সাধারন যানবাহন ৯০ কি. মি.” ! তবে উপায় একটা আছে বটে! আসে পাশের গাড়ী ফলো করা এবং তাদের সমান গতিতে কিংবা কিছুটা ধীর গতিতে চলা। বিশেষ করে যে সব গাড়ীর নাম্বার প্লেটে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া লিখা।
মহাসড়কের দুপাশে বিশাল খামার আর জমিতে মেশানো কম্পোস্ট সারের উৎকট গন্ধ। কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলাম মাথায় পাগড়ি পরা অনেক পাঞ্জাবি (শিখ) জমিতে কাজ করছে। আশেপাশে বেশ কিছু শিখ মন্দিরও চোখে পড়লো।
আমেরিকা-কানাডা বর্ডার অতিক্রম করে আরো আধাঘণ্টা ড্রাইভ করার পর দূর থেকে দেখা মিললো পৃথিবীর অন্যতম বসবাস উপযোগী মেগাসিটি “ভ্যাঙ্কুভার”, দেখতে অনেকটা প্রতিবেশী শহর সিয়াটলের মতো। সাগরের মোহনায় গড়ে উঠা ভ্যাঙ্কুভার একাধিক দৃষ্টি নন্দন সাস্পেনশান ব্রিজ দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা মসৃণ মহাসড়ক মাড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম।
ভ্যাঙ্কুভার পশ্চিম কানাডার সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ সিটি। চাইনিজ ও পাঞ্জাবী (শিখ) সম্প্রদায়ের আধিক্য বেশ চোখে পড়ার মতো। ডাউনটাউনের আশেপাশে গড়ে উঠা আকাশচুম্বী কণ্ডোমেনিয়ামে শহরের অধিকাংশ মানুষের আবাসস্থল। ২০১০ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের হোস্ট ছিলো ভ্যাঙ্কুভার। ব্যাবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্যটন খাত নগরীর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। গ্রীষ্ম কালীন সময়ে ভ্যাঙ্কুভার টু আলাস্কা নৌ বিহারেরও ব্যাবস্থা আছে।
আপাতত আশেপাশের কোথাও ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে ইন্টারনেট সুবিধা পেতে হবে অতঃপর দেশী হালাল রেস্টুরেন্ট ও হোটেল খোঁজার পালা। মাত্র পনের মিনিটের মধ্যেই সব কিছুর সমাধান মিললো। দেশীর কায়দায় ভুঁড়ি ভোজন শেষে থাকার জন্য বেছে নিলাম ভ্যাঙ্কুভারের পাশেই ২০ কিলোমিটার দূরে আরেক শহর “সারে", শুনেছি এই শহরেই অধিকাংশ উপমহাদেশীয় ও মুসলিম ক্যমুনিটির আবাসস্থল। অতএব, দেশী খাবার দোকান বা জুমা পড়ার জন্য মসজিদ খুঁজে বের করতে সমস্যা হবে না।
পরদিন শুক্রবার জুমা পড়তে রওনা হলাম ব্রিটিশ কলাম্বিয়া মুসলিম এসোসিয়েশান পরিচালিত স্থানীয় একটি মসজিদে। বৃহদাকৃতির মসজিদ, চারপাশে বিশাল বাগান, আসন্ন রমাজান নিয়ে ইমামের উপমহাদেশীয় ধাঁচের খুৎবা ইত্যাদি। তবে মসজিদ থেকে বের হতেই ঘটলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মসজিদের দরজায় এক মাহিলা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাড়িয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছে। তাকে সাহায্য করতেই পেছন থেকে একজন দেশীয় মুরুব্বী কিছুটা দুরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন “আপনার ওই মহিলাকে সাহায্যে করা উচিৎ হয়নি, আমাদের ইমাম ওকে সাহায্য করতে নিষেধ করেছেন। কারণ সে অমুসলিম!”
জবাবে আমি বললাম আপনাদের ইমাম আর কি কি বলেছেন?? উনাকে গিয়ে বলবেন দুনিয়াতে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে। এইসব ছোটখাট ব্যপারে এতো বেশি মাথা ঘামালে তো চলবে না! কিছুক্ষনপর দেখলাম লম্বা দাঁড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ ছুটে এসে ওই মহিলার হাতের প্ল্যাকার্ড ছিনিয়ে নিয়ে হারাম হারাম বলে চিৎকার শুরু করলো!!
ক্যাপিলানো সাস্পেনশান ব্রিজঃ
ছোটবেলায় আমার বয়সী অনেকের অন্যতম প্রিয় টিভি সিরিজ ছিলো ম্যাকাইভার “MacGyver”, সেই ম্যাকাইভারের অধিকাংশ সিজন (৩-৬) মোট ৭ সিজন। নির্মিত হয় ভ্যাঙ্কুভারের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। রিচার্ড ড্যান এন্ডারসনের দেওয়া সেই সব লোমহর্ষক দৃশ্যের অন্যতম স্পট হলো এই ক্যাপিলানো সাস্পেনশান ব্রিজ! বাঞ্জি জাম্পিং এর জন্য বেশ উপযুক্ত স্থান বলা যায়।
ভ্যাঙ্কুভারের উত্তরে ক্যাপিলানো ব্রিজ নির্মাণ করা হয় ১৮৮৯ সালে। এর দৈঘ্য ৪৬০ মিটার এবং উচ্চতা ২৩০ মিটার। ব্রিজ পেরিয়ে অপর প্রান্তে গেলেই দেখা মিলবে ট্রি হাউজ ও ১৩০০ বছর বয়সী পাইন ট্রি’র। রোমাঞ্চপ্রিয়দের জন্য রয়েছে ক্লীফ ভিউর সুযোগ। প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়ন পর্যটক এই ব্রিজ ভ্রমনে আসেন।
উইস্টলার রিসোর্ট টাউনঃ
ভ্যাঙ্কুভার থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার উত্তরে পর্বত বেষ্টিত দর্শনীয় স্থান উইস্টলার। সুউচ্চ পর্বত আর উপসাগরের মাঝ দিয়ে তৈরি দীর্ঘ সড়কের নাম করণ করা হয়েছে “সি টু স্কাই সড়ক”, এই সড়কে ভ্যাঙ্কুভার থেকে দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করলেই সোজা উইস্টলার!!!!!
উইস্টলারকে আসলে একটি অলিম্পিক ভিলেজ বলা চলে। ২০১০ সালে শীতকালীন অলিম্পিককে কেন্দ্র করে মুলত এই শহরের আধুনিকায়ন করা হয়। জনসংখ্যার অধিকাংশই পর্যটক। প্রসাদ আকৃতির বহুতল ভবন, স্কিং, বিভিন্ন আকৃতির ক্যাবল কার, হর্স রাইড, এটিভি ট্রিপ, সহ নানা রকমের বিনোদনের ব্যাবস্থা।
জুলাই ৭, ২০১৩