শহর থেকে গ্রামে নানার বাড়ি বেড়াতে যাওয়া এক কালে খুব আনন্দের ব্যাপার ছিল। আমরা ছয় ভাইবোন যখন ছোট ছিলাম, তখন স্কুল ছুটি হলে নানার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশ, গাছের টাটকা ফল, পুকুরের তাজা মাছ, বাড়ির গাই দোয়ানো দুধের সর, আহা! তবে নানাভাইয়ের কাছে গল্প শোনার প্রতি আমাদের আকর্ষণ ছিল সবচে’ বেশি। তাঁর ভাণ্ডারে ছিল অসংখ্য গল্পের মজুদ। রাখালের গল্প, চাষীর গল্প, বাঘ সিংহ হরিণ শেয়াল আর সারসের গল্প। যুবক বয়সে তিনি কী কী দুঃসাহসিক কাজ করেছেন, সেসব গল্প। অন্যের গাছে উঠে চুরি করে ফল পেড়ে খাওয়ার গল্প।
একবার (১৯৬৭ সালের দিকে) আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে (বড়ভাই এসব গল্প শুনতেন না) তাঁর চারপাশে বসিয়ে নানাভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ পর্যন্ত তোমরা আমার কী কী চুরির গল্প শুনেছ?’ আমরা সমস্বরে বললাম, ‘আম, তেঁতুল, নারকেল, কলা আর বাতাবী লেবু।’
‘বেশ। আজ তোমাদেরকে বলবো বউ চুরির গল্প।’
‘বউ চুরি?’
‘হাঁ, বউ চুরি। আমার বউকে আমি কীভাবে চুরি করে নিয়ে এসেছিলাম, সেই গল্প।’
আমাদের নানী আমাদের জন্মের আগে মারা যাওয়ায় তাকে আমরা কেউ দেখিনি। সে যুগে তার কোন ছবিও ছিল না। তার ব্যাপারে আমাদের বরাবরই খুব কৌতূহল ছিল। কিন্তু মায়ের কাছে তার সম্পর্কে যৎসামান্য শুনে আমাদের কৌতূহল মিটতো না। তাই নানাভাইয়ের বউ চুরির গল্প শোনার জন্য আমরা লাফিয়ে উঠলাম। ‘ইস্, বউ চুরির গল্প!’নিজেদের মধ্যে আমরা বলাবলি করলাম, ‘খুব মজার হবে, তাই না? বলো নানাভাই, তাড়াতাড়ি বলো।’
‘তোমাদের নানীর বয়স যখন দশ বছর, তখন আমার বয়স ছিল পনেরো। ঐ বয়সে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।’
‘এ আল্লাহ্! এত ছোট বয়সে কোনদিন বিয়ে হয়?’
‘তখনকার দিনে যে তাই হতো ভাই।’
‘এ্যাই, তুই চুপ কর! খালি বকর বকর করে! তুমি বলো নানাভাই।’
‘হাঁ, শোনো। বিয়ে তো হলো, কিন্তু ফ্রক প্যান্ট পরা তোমাদের নানী তার বাবার বাড়িতেই থেকে গেল।’
‘কেন?’
‘তোমাদের নানী যে তখনো লায়েক (সাবালিকা) হয়নি। লায়েক না হলে স্বামীর বাড়ি যেতে নেই।’
‘লায়েক হলে কী হয়?’
আমাদের মা সে সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নানাভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি যে কী সব গল্প বলেন না আব্বা! এসব গল্প ওদের বলবেন না তো!’
নানাভাই বিব্রতমুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বউ চুরির গল্প থাক। অন্য গল্প বলি, কেমন?’
‘না, না, না।’ আমরা অন্য গল্প শুনতে রাজী নই। বউ চুরির গল্পই বলতে হবে। নানার সাথে বহু দেন দরবারের পর শেষে সিদ্ধান্ত হলো যে, আজ নয়, কাল নানার আমবাগানের ভেতর মাদুর পেতে বসে আমরা বউ চুরির গল্প শুনবো। আর গল্প শোনার সময় কেউ কোন কথা বলতে পারবে না।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন নির্ধারিত স্থানে বসে নানাভাই গল্প বলা শুরু করলেন। যেহেতু প্রশ্ন করা যাবে না, তাই ‘লায়েক হলে কী হয়’, সেটা আর জানা হলো না।
‘তোমাদের নানী তো তার বাপের বাড়িতে থেকে গেল। আমাদের গ্রাম থেকে তার বাপের বাড়ি অনেক দূর। অত দূরে তো আর যখন তখন ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় না। কিন্তু সেখানে যেতে আমার খুব ইচ্ছে করতো।’
‘কেন? তোমার যেতে ইচ্ছে করতো কেন?’ সব ছোট ভাইটার (বয়স ছয় বছর) এই আজগুবি প্রশ্নে আমি (বয়স বারো বছর) ও আমার বোন (বয়স চৌদ্দ বছর) মহাবিরক্ত। আমরা দু’জন তার দুই কান মলে দিয়ে চুপ থাকার জন্য ধমকে দিলাম। কানমলা খেয়ে সে কেঁদে ফেললো। নানাভাই তাকে আদর করে কান্না থামিয়ে কোলে বসিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তুমি বড় হয়ে যখন বিয়ে করবে, তখন তোমারও শ্বশুরবাড়ি যেতে ইচ্ছে করবে।’
ছোটভাই বললো, ‘আমি বিয়ে করবো না।’
‘আচ্ছা করিস না। নানাভাই, তুমি ওর সাথে বক বক করো না তো! গল্প বলো।’
‘হাঁ, শোনো। আমার বাবা ও শ্বশুর দু’জনেই ছিলেন জোতদার মানুষ।’
‘জোদ্দার কী?’ আমার আরেক ভাইয়ের প্রশ্ন (বয়স দশ বছর)।
‘যাদের অনেক জমি জমা থাকে, তাদের জোতদার বলে। তো শোনো, এরপর কী হলো। একদিন আমি খুব ভোরে কাউকে কিছু না বলে একা একা আমার বউকে দেখার জন্য ওদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে দুপুরবেলা গিয়ে পৌঁছালাম ওদের গ্রামে। কিন্তু ওদের বাড়ি আর খুঁজে বের করতে পারি না। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও ভয় লাগে। বিয়ের সময় ঢাক ঢোলের বাদ্য বাজনাসহ অনেক লোকজন নিয়ে ছোট বাবার (ছোট চাচার) সাথে ঘোড়ায় চড়ে এই গ্রামে এসেছিলাম। শুধু এটুকু মনে আছে যে, আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল টিনের ছাউনি দেওয়া বিশাল লম্বা একটা বাড়ি। চারপাশে আম কাঁঠালের গাছ। কিন্তু এখন সে বাড়ি আর চোখে পড়ছে না। চারদিকে খড়ের চালা দেওয়া ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর দেখে মন খারাপ হয়ে গেল।’
‘কুঁড়ে ঘর দেখে তোমার মন খারাপ হয়ে গেল কেন?’ আরেক ভাইয়ের প্রশ্ন (বয়স আট বছর)। নানাভাই হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘উকিলের ছেলেরা খালি উকিলের মতো প্রশ্ন করে। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় দশ বারো মাইল হেঁটে ক্লান্ত হয়ে বউ দেখতে এসেছি। কিন্তু বউয়ের বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না। মন খারাপ হবে না?’
‘তুমি হেঁটে গেলে কেন? ঘোড়ায় চড়ে গেলেই তো হতো।’
‘এ্যাই চুপ! একদম কথা বলবি না।’
নানাভাই বললেন, ‘আরে বোকা! আমাদের বাড়িতে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, পালকি সবই ছিল। কিন্তু সেসব নিয়ে রওনা দিলে বাবা টের পেয়ে যাবে না? আমার বাবাকে তো তোমরা দেখনি। ভীষণ রাগী মানুষ ছিল। যাই হোক, কথা বোলো না, শোনো। বউয়ের বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে বিকেল হয়ে গেল। ক্ষিধে ও ক্লান্তিতে আমার দুই পা আর চলে না। অচেনা লোকজনকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয় না। তা’ছাড়া আমার শ্বশুরের নামও আমি জানতাম না। শুধু বউয়ের নাম জানতাম। ময়মুনা।’
‘ময়মুনা? ছিঃ, কী বিচ্ছিরি নাম!’
‘এ্যাই, তুই চুপ করবি?’
‘খুঁজে খুঁজে বাড়ি না পেয়ে আমি হতাশ হয়ে ফিরে যাবো কী না ভাবছি, ঠিক এই সময় হঠাৎ সেই বড় বাড়িটা আমার চোখে পড়লো। বাড়ির পাশে আমবাগানের ভেতর ক’জন ছেলে মেয়ে এক্কা দোক্কা খেলছে। আমি গাছগুলোর আড়ালে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে হেঁটে তাদের কাছাকাছি গিয়ে দেখি, একটা মেয়েকে আমার বউয়ের মতো লাগছে।’
বিপুল উল্লাসে হাততালি দিয়ে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। নানাভাই তার বউ খুঁজে পেয়েছে, এটাই আমাদের উল্লাসের কারণ।
‘বসো বসো। আসল গল্প তো এখনো শোনইনি।’ নানাভাই আমাদের হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বললেন। ‘ওদের খেলা শেষ হতে হতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সে পর্যন্ত আমি চোরের মতো চুপচাপ আমগাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকলাম। খেলা শেষে সবাই নিজ নিজ বাড়ি চলে গেল। আমার বউয়ের মতো দেখতে মেয়েটা এক্কা দোক্কা খেলার মাটির তৈরি হাঁড়ি ভাঙা খোলা গুলো কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ির ভেতর যাওয়ার আগে আমি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে তার কাছে গিয়ে বললাম, তোমার নাম ময়মুনা? মেয়েটি ঘাড় নেড়ে হাঁ-সূচক জবাব দিয়ে বললো, আপনি কে?’
আমি মজিবর। তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।
মেয়েটি এদিক ওদিক তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো, এখানে এসেছেন কেন?
আমি বললাম, তোমাকে দেখতে।
মেয়েটি আরো ভয় পেয়ে গেল। বললো, বাবা জানতে পারলে আমাকে মারবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে। তোমাকে দেখা হলো। আমি এখন যাই।
মেয়েটি হড়বড় করে বললো, তাই করেন। আপনি চলে যান।
আমি ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত শরীরে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। কিছু দূর আসার পর মনে হলো, ময়মুনা আমাকে পেছন থেকে ডাকছে। তার হাতে এক জগ পানি আর বাঁশের তৈরি কাঠা ভর্তি গুড় মুড়ি। সে দৌড়ে আমার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, এগুলো খেয়ে যান।
রাস্তার ধারে একটা গাছের নিচে বসে আমি রাক্ষসের মতো গুড় মুড়ি খেয়ে জগ মুখে ধরে ঢক ঢক করে ঠাণ্ডা পানি খেয়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। ময়মুনা পাশে বসে আমার খাওয়া দেখছিল। সে বললো, রাত হয়ে গেল। অন্ধকারে বাড়ি যাবেন কীভাবে? ভয় লাগবে না?
আমি বললাম, একটু একটু ভয় তো এখনই লাগছে। তুমি যাবে আমার সাথে? তুমি সাথে থাকলে ভয় লাগবে না।
ময়মুনা কিছুক্ষণ ভেবে বললো, চলেন যাই।
গ্রামের রাস্তায় রাতের বেলা লোকজন তেমন থাকে না। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া চারদিক নিস্তব্ধ। আমি আর ময়মুনা রওনা হলাম আমাদের বাড়ির দিকে। মাইল খানেক হাঁটার পর ময়মুনা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, হাঁটতে পারছি না।
কী মুশকিল! আমি বললাম, আস্তে আস্তে হাঁটো।
কিন্তু কিছুদূর হেঁটে ময়মুনা রাস্তার ওপর বসে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি আর হাঁটতে পারবো না।
আকাশে আধ ফালি চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ঘাবড়ে গেলাম। বেচারী ঘেমে নেয়ে অস্থির। এত রাস্তা এই ছোট মেয়ে হেঁটে যাবে কীভাবে, আগে ভেবে দেখিনি। বললাম, এক কাজ করো। আমার পিঠে উঠে বসো। আমি তোমাকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাবো।
ময়মুনাকে পিঠে তুলে নিয়ে আমি বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে হাঁটছি। মাঝে মাঝে ওকে পিঠ থেকে নামিয়ে রাস্তার ধারে বসে একটু জিরিয়ে নিই। তারপর আবার ওকে পিঠে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরি। এভাবে কতক্ষণ হেঁটেছি বলতে পারবো না। এক সময় আমার আর কিছু মনে নাই।’
‘তারপর? তারপর কী হলো?’ আমরা সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে নানাভাইয়ের গা ঘেঁষে বসলাম।
পরদিন দুপুরে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে আমি নিজের ঘরে শুয়ে উহ্ আহ্ করছি। আমার রাগী বাবা বাড়ির উঠানে বাঘের মতো পায়চারী করছেন আর বলছেন, ভাবতে পারো, অতটুকু ছোট মেয়েটা রাতের অন্ধকারে রাস্তার মধ্যে বসে হারামজাদাটাকে আঁকড়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদছে আর চিৎকার করে বলছে, আমার স্বামী মরে গেছে, আমার স্বামী মরে গেছে। আরে, আমার বংশের ছেলে বউ নিয়ে আসবে পালকিতে করে। বাড়িতে চার চারজন বেহারা তিনবেলা বসে বসে খায়। আর তোমার এই কুলাঙ্গার ছেলে চুরি করে বউ নিয়ে আসছিল পিঠে বয়ে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। হারামজাদার জ্বরটা সারুক, তারপর ওর পিঠের চামড়া কীভাবে তুলতে হয়.........।’
‘তুমি কী সত্যি সত্যিই মরে গিয়েছিলে নানাভাই?’ (সব ছোট ভাইটা)।
‘এক থাপ্পড় দেব বেকুব কোথাকার! মরে গেলে কেউ আবার বেঁচে ওঠে? নানাভাই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।’ (আমার বড় বোন)।
গল্পের শেষটুকু এরকমঃ এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর নানাভাইয়ের রাগী বাবা মহা ধুমধাম করে ছেলের বউ তুলে এনেছিলেন। বউ এসেছিল সেজেগুজে পালকিতে চড়ে। কিন্তু নানাভাইয়ের বউ আরো দেড় বছর নানাভাইয়ের মায়ের কাছে ছিল। শুধু দিনের বেলা নানাভাই খেতে বসলে সে হাতপাখা দিয়ে তাকে বাতাস করতো। ব্যস্।
*******************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:৩৬