আমাদের মহল্লার আলতাফ ভাই যখন বি এ ক্লাসের ছাত্র, আমরা তখন ক্লাস নাইন টেনে পড়ি। আলতাফ ভাই ছিলেন খুব পাড়া হিতৈষী মানুষ। পাশের পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলে আমরা একবার ৫-০ গোলে হেরে যাবার পর তিনি আমাদের ডেকে বললেন, ‘এভাবে হবে না। ক্লাব তৈরি করতে হবে।’
দেশ স্বাধীন হবার আগের কথা। দেশত্যাগী এক হিন্দু পরিবারের ফেলে যাওয়া পতিত জমিতে ক্লাব তৈরি করা হলো। বাড়ি বাড়ি, দোকানে দোকানে চাঁদা তুলে ইট, সিমেন্ট, বালু কিনে আমরা নিজেরাই পাঁচ ইঞ্চির দেয়াল গেঁথে বারো হাত বাই ষোলো হাত ক্লাব ঘর তুলে ফেললাম। মিস্ত্রী খরচ বাঁচাতে গিয়ে আমাদের হাত সিমেন্ট-বালুতে ফুটো হয়ে গেল। কিন্তু ক্লাব ঘর তৈরির উত্তেজনায় হাত ফুটো হবার কষ্ট ধামাচাপা পড়ে গেল। আলতাফ ভাই বললেন, ‘সাবাস! তোরা পারবি।’
ক্লাব ঘরে টিনের ছাউনী দেবার কাজ মিস্ত্রী এনে করা হলো। সে কোন মজুরী নিল না। হাফ ডজন জর্দা দেওয়া পান খেয়ে হাসিমুখে সে কাজটা করে দিল। আলতাফ ভাই বললেন, ‘সাবাস! খাঁটি দেশপ্রেম কাকে বলে, দেখ।’
ক্লাবের নাম দেওয়া হলো ‘টাইগার ক্লাব।’ আলতাফ ভাইয়ের পছন্দের নাম। কেউ কেউ বললো, টাইগারের আগে রয়েল বেঙ্গল দিলে কেমন হয়? আলতাফ ভাই ধমক দিয়ে বললেন, ‘চুপ থাক! আগে টাইগার হয়ে দেখা, তারপর রয়েল বেঙ্গল। ব্যাটা, বিড়ালের মতো পাঁচ গোল খেয়ে এলি, লজ্জা করে না? মেনি বিড়ালের রয়েল বেঙ্গল হওয়ার শখ!’ কথা ঠিক। আগে বিড়াল থেকে অন্ততঃ মেছো বাঘ তো হওয়া যাক, তারপর না হয় রয়েল বেঙ্গলের কথা ভাবা যাবে। আলতাফ ভাই ক্লাবের সভাপতি হলেন। একই সাথে তিনি ক্লাবের ম্যানেজার, কোচ ও ক্যাশিয়ারও হলেন। সাধারণ সম্পাদক পদ দেওয়া হলো আরেক সিনিয়র ভাই অশোক দাদাকে। ক্লাবের খেলাধুলা ইনডোর ও আউটডোর দু’ভাগে ভাগ করা হলো। ইনডোরে থাকবে দাবা ও ক্যারাম। আউটডোরে থাকবে ফুটবল, হকি আর ক্রিকেট। এখনকার মতো তখন ক্রিকেটের এত রমরমা ছিল না। হকিও ছিল দায়সারা গোছের। আসল খেলা ছিল ফুটবল।
তো সেই ফুটবলের জন্য শুরু হয়ে গেল ধুন্ধুমার প্রস্তুতি। প্রতিদিন খুব ভোরে আলতাফ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা পাড়ার ছেলেরা চলে যেতাম রাজশাহী কলেজের মাঠে। সেখানে এক ঘণ্টা ফুটবল প্র্যাকটিস করার পর আমরা চলে যেতাম পদ্মার চরে। সেখানে বালুর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি। আলতাফ ভাই হাতে একটা ছড়ি নিয়ে তদারকি করতেন আর মাঝে মাঝে হুংকার দিয়ে বলতেন, ‘সাবাস! তোরা পারবি।’
অশোক দাদা একটু জবুথুবু টাইপের মানুষ। তিনি তাঁর মতো আরও কিছু নির্জীব ছেলেকে নিয়ে ইনডোরে দাবা ও ক্যারাম প্র্যাকটিসে মগ্ন হয়ে থাকতেন। আর আমরা বিশ পঁচিশ জন ছেলে আলতাফ ভাইয়ের কোচিং-এ ‘কালোমানিক পেলে’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর।
এমন সাংঘাতিক জোশের মধ্যে এসে গেল ‘ডিসি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট।’ শহরের বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতার বর্ণাঢ্য আয়োজন। জেলা প্রশাসক নিজে উপস্থিত থেকে টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করেন এবং টুর্নামেন্ট শেষে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ দলের হাতে ট্রফি তুলে দেন। আলতাফ ভাই ক্লাবের সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। তাঁর কথা হলো, এই টুর্নামেন্টে অংশ নিতেই হবে। টাইগার ক্লাবের নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার এটাই মোক্ষম সুযোগ। আমরা হাত তালি দিয়ে আলতাফ ভাইয়ের প্রস্তাব সমর্থন করলাম। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘সাবাস! তোরা পারবি।’ টান টান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে মিটিং শেষ হলো।
কিন্তু ভজঘট শুরু হলো পরদিন থেকে। ডিসি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিতে হলে ক্লাবের রেজিস্ট্রেশন থাকতে হবে। কিন্তু টাইগার ক্লাবের রেজিস্ট্রেশন নাই। আলতাফ ভাই দমে যাবার পাত্র নন। তিনি অশোক দাদাকে সাথে নিয়ে রাত জেগে বসে বসে রেজুলিউশন, মাইনুটস-এসব কী কী সব কাগজপত্র তৈরি করে ফেললেন। ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলা হলো। ক্যাশ বই ও এক্সপেন্ডিচার স্টেটমেন্ট তৈরি করা হলো। শহরের দু’চারজন নামী দামী লোককে ক্লাবের পরিচালনা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। তারপর সেসব কাগজপত্রের সাথে ক্লাব রেজিস্ট্রেশনের টাইপ করা আবেদনপত্র নিয়ে তিনি দল বেঁধে চলে গেলেন ডিসি অফিসে।
তখনকার দিনে খেলাধুলার জন্য ক্লাবের রেজিস্ট্রেশন পাওয়া খুব একটা কঠিন ছিল না। এডিসি (সার্কেল) সাহেব টাইগার ক্লাব পরিদর্শনে এলেন। তাঁর জন্য এক ডাক্তার সাহেবের চেম্বার থেকে গদিওয়ালা চেয়ার আনানো হলো। নানারকম খাবার ও পানীয়র ব্যবস্থা করা হলো। তিনি সেসব খাওয়ার পর ঢেকুর তুলতে তুলতে আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। আমরা ঘন ঘন হাত তালি দিয়ে তাঁর ভাষণ দীর্ঘ করে দিলাম। কিন্তু এডিসি সাহেবের জন্য তৈরি করে আনা ফুলের মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়ার কথা কারো মনে ছিল না। বিদায় নেওয়ার সময় সেটা তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো। আলতাফ ভাই প্যাকেট করা এক পিস নতুন সিল্কের টাই তাঁকে উপহার দিলেন। ‘এসবের কী দরকার ছিল’ বলতে বলতে এডিসি সাহেব আমাদের তুমুল করতালির মধ্যে গাড়িতে উঠে প্রস্থান করলেন।
এক সপ্তাহের মধ্যে ক্লাবের রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেল। নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ডিসি কাপ টুর্নামেন্টে টাইগার ক্লাবের নাম লেখানো হয়ে গেল। খেলোয়াড়দের জন্য সাদা ও সবুজ রঙের কম্বিনেশনে জার্সি বানানো হলো। জার্সির বুকে বাঘের মাথার ছাপ। পিঠে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা TIGER CLUB . আলতাফ ভাই নিজ হাতে আমাদের একজন খেলোয়াড়ের গায়ে জার্সি পরিয়ে দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, ‘সাবাস! তোরা পারবি।’
এরপর ভজঘট হলো বুট নিয়ে। টুর্নামেন্টে খালি পায়ে খেলা যাবে না। অথচ এতদিন আমরা খালি পায়ে খেলে অভ্যস্ত। বুট পরে প্র্যাকটিস করতে গিয়ে আমাদের দৌড়ের গতি কমে যায়। আলতাফ ভাই হাতের ছড়ি ঘুরিয়ে হুংকার দেন, ‘ফাস্ট, ফাস্ট।’ টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র সাতদিন দেরি আছে। ফিকচার অনুযায়ী প্রথম দিনেই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাইট স্টার ক্লাবের সাথে নবাগত টাইগার ক্লাবের খেলা। এই সাত দিনের মধ্যে বুট পরে খেলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। অতএব প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। স্কুল কলেজ ফাঁকি দিয়ে সকাল বিকাল শুধু বিরামহীন প্র্যাকটিস। আলতাফ ভাই বাড়িঘর প্রায় ছেড়ে দিয়ে টাইগার ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে সারাদিন মাঠে পড়ে রইলেন।
তারপর চলে এল সেই বহু প্রতিক্ষিত দিন। মাদ্রাসা মাঠে (এই নামে একটা বড় মাঠ রাজশাহীতে এখনো আছে) টুর্নামেন্টের প্রথম খেলা। শুরু হবে বিকেল চারটায়। সকাল থেকে আমাদের ক্লাবে ও পাড়ায় হৈ হৈ রৈ রৈ অবস্থা। পাড়ার ছেলে বুড়ো সবাই টাইগারদের খেলা দেখার জন্য মাঠে চলে এলো। চারদিক লোকে লোকারণ্য। এত দর্শকের মধ্যে আমরা কোনদিন খেলিনি। তাই সবার বুকের মধ্যে একটা ঢিপ ঢিপানি ভাব। কিন্তু আলতাফ ভাইয়ের কড়া নির্দেশ, সকলের চেহারার মধ্যে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব থাকতে হবে। আমরা চোখ মুখ কঠিন করে আলতাফ ভাইয়ের নির্দেশ পালন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু খুব একটা যুতসই হচ্ছে না।
ডিসি সাহেব লম্বা চওড়া অবাঙ্গালী অফিসার। তিনি দুই দলের খেলোয়াড়দের সাথে হ্যান্ডশেক করে পরিচিত হলেন। উদ্বোধনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি কিছুক্ষণ উর্দুতে ভাষণ দিলেন। তারপর একসাথে বাঁধা কয়েক ডজন বেলুন উড়িয়ে টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। চেহারায় বাঘের মতো হিংস্রতা নিয়ে আমরা আলতাফ ভাইয়ের নেতৃত্বে মাঠে প্রবেশ করলাম। মাঠের সীমানা নির্দেশক দড়ির বাইরে থেকে আমাদের পাড়ার দর্শকরা বিপুল হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানালো। আমাদের সাহস বেড়ে গেল। আজ কিছু একটা করে দেখাতেই হবে। ব্রাইট স্টার ক্লাবের খেলোয়াড়রা মাঠে প্রবেশ করলে তাদের সমর্থকরাও হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানালো। আলতাফ ভাই ‘বডি ল্যাংগুয়েজ, বডি ল্যাংগুয়েজ’ বলে চিৎকার করছেন। আগে থেকে সিদ্ধান্ত ছিল যে, আমাদের প্রতিপক্ষ দল মাঠে নামার সাথে সাথে আমরা বডি ল্যাংগুয়েজের মাধ্যমে ওদের চিবিয়ে খেয়ে ফেলার মতো একটা ভাব দেখাবো, যাতে ওরা ঘাবড়ে যায়। আলতাফ ভাইয়ের মতে, এতে নাকি খেলায় অর্ধেক জেতা হয়ে যায়। কিন্তু খেলা শুরুর আগে ওদের নিখুঁত ড্রিবলিং ও পাশিং প্র্যাকটিস দেখে আমাদের বডি ল্যাংগুয়েজ ততটা ভালো হলো না। আমরা নিজেদের মধ্যে বল দেয়া নেয়া করতে করতে ওদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছি বটে, কিন্তু ওরা আমাদের পাত্তাই দিচ্ছে না। মনে হয়, আলতাফ ভাইয়ের ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ তত্ত্ব মাঠে মারা গেল।
যাই হোক, রেফারীর বাঁশি বাজার সাথে সাথে খেলা শুরু হয়ে গেল। ব্রাইট স্টার রাজশাহীর পুরাতন ক্লাব। প্রায় প্রতি বছরই ওরা চ্যাম্পিয়ন বা রানার্স আপ হয়। খেলা শুরু হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে ওরা আমাদের দু’গোল দিয়ে দিল। দর্শকদের মধ্যে ভীষণ হৈ চৈ। প্রতিপক্ষের সমর্থকরা হাত তালি দিয়ে হা হা করে হাসছে। আলতাফ ভাই মাঠের বাইরে থেকে চিৎকার করে আমাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ওদের খেলোয়াড়দের পিছু পিছু দৌড়ানো ছাড়া আমরা বিশেষ কিছু করতে পারছি না। আসলে খেলোয়াড় হিসাবে আমরা অতটা খারাপ ছিলাম না। কিন্তু বুট পরে খেলার কারণে আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারছিলাম না। তার ওপর বুট পরে প্র্যাকটিসের কারণে আমাদের কয়েকজন খেলোয়াড়ের পায়ের আঙ্গুলে ফোস্কা পড়ে ছিল। কিন্তু প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়ার ভয়ে তারা সে কথা প্রকাশ করেনি। খেলার প্রথমার্ধে আমরা ৪-০ গোলে পিছিয়ে থেকে বিরতিতে গেলাম।
আলতাফ ভাই রাগে থর থর করে কাঁপছেন। চিৎকার করতে করতে তাঁর গলা ভেঙ্গে গেছে। তিনি আকাশের দিকে মুখ করে ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ‘এই হারামখোরদের জন্যে ধার দেনা করে টিম তৈরি করলাম। আর এরা এই খেলা খেলছে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’
দ্বিতীয়ার্ধে দু’জন খেলোয়াড় পরিবর্তন করা হলো। সেন্টার ফরোয়ার্ডে আসলামকে বসিয়ে হান্নানকে নামানো হলো আর গোল কিপার হুদাকে বসিয়ে আলতাফ ভাই নিজেই নেমে গেলেন কিপিং করতে। তিনি স্কুল জীবনে মুসলিম হাই স্কুলের নাম করা গোল কিপার ছিলেন। ভাগ্যিস, স্ট্যান্ড বাই চারজন খেলোয়াড়ের তালিকায় আলতাফ ভাই নিজের নাম রেখেছিলেন! আমরা একটু সাহস পেলাম।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে ওরা আরও হেসে খেলে আমাদের গোল দিতে লাগলো। একটা করে গোল হয়, আর মাঠের বাইরে ব্রাইট স্টারের সমর্থকরা হাত তালি দিয়ে হেসে খুন হয়ে যায়। আলতাফ ভাই লম্ফ ঝম্ফ দিতে দিতে হয়রান। এর মধ্যে কীভাবে কীভাবে যেন আমাদের হান্নান একটা গোল করে বসলো। ফলাফল ৭-১। আলতাফ ভাই গোল বার থেকে চিৎকার করে বললেন, ‘সাবাস হান্নান, সাবাস! বাঘের বাচ্চারা দেখিয়ে দে।’ এক পর্যায়ে অতি উত্তেজনায় আলতাফ ভাই নিজের গোল বার ছেড়ে বল পায়ে ছুটে চললেন ওদের গোল বারের দিকে। গোল কিপার গোল করার জন্য ছুটে চলেছে, এমন দৃশ্য দর্শকরা কেউ কোনদিন দেখেনি। তারা হাত তালি দিয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছে আলতাফ ভাইকে। টান টান উত্তেজনাকর দৃশ্য। কিন্তু মাত্র দু’মিনিটেই উত্তেজনা শেষ। আলতাফ ভাইয়ের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে পাশ দিতে দিতে এনে আমাদের অরক্ষিত গোল বারে মোলায়েম ভাবে ঢুকিয়ে দিল। ফলাফল ৮-১।
মাথা গরম করে আমাদের একজন খেলোয়াড় ডি-বক্সের ভেতর ওদের একজন খেলোয়াড়কে ফাউল করে বসলো। রেফারী পেনাল্টির বাঁশি বাজালো। ওদের স্ট্রাইকার গোলবারের ডান দিকে শট নিল। আলতাফ ভাই বাম দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ফলাফল ৯-১।
শেষে আর সহ্য হলো না। পা থেকে বুট খুলে ফেলে দিয়ে আমরা খালি পায়ে বাঘের মতো ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আর কী আশ্চর্য! এতে যাদুর মতো কাজ হলো। ফলাফল ৯-২। কিন্তু খেলার বাই লজ ভঙ্গ করায় দু’দলের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। রেফারী আমাদের দ্বিতীয় গোল বাতিল করে দিল। শুরু হয়ে গেল মহা হট্টগোল। আমাদের পাড়ার দর্শকরা মাঠে ঢুকে পড়ে রেফারীর বাঁশি কেড়ে নিয়ে তাকে কিল ঘুষি মারা শুরু করে দিল। ব্রাইট স্টারের সমর্থকদের সাথে টাইগার ক্লাবের সমর্থকদের ইট পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়ে গেল। সে এক এলাহী কাণ্ড! মাঠের ভেতর কে কাকে মারছে বোঝার উপায় নাই। রেফারীর দুই পা ধরে মাটিতে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন দর্শক। আলতাফ ভাই মাটিতে শুয়ে পড়ে চিৎকার করছেন, ‘জার্সি খুলে পালিয়ে যা।’ ওদের খেলোয়াড়রা পালিয়ে গেছে। আমরাও বুট জার্সির মায়া ত্যাগ করে মাঠ ছেড়ে পালিয়ে গেলাম।
আলতাফ ভাইকে নিয়ে আমরা দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু ক্লাবে ফিরে এসে দেখি, তিনি আমাদের আগেই পালিয়ে এসেছেন এবং অশোক দাদা সহ অন্যান্যদের সাহায্যে মোখলেসকে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ক্লাবের ভেতর বসিয়ে রেখেছেন। মাঝবয়সী শীর্ণদেহ মোখলেস হলো আমাদের পাড়ার উঠতি গনক। পেশায় বেকার। এর ওর হাত দেখে ভবিষ্যৎবাণী করা তার একমাত্র কাজ। খেলতে যাওয়ার আগে সে ভবিষ্যৎবাণী করে বলেছিল, টাইগার ক্লাব ২-১ গোলে জিতবে। দোয়া পড়ে সে খেলোয়াড়দের মাথায় ফুঁ দিয়ে দিয়েছিল। আলতাফ ভাই খুশি হয়ে তাকে পাঁচটা টাকাও দিয়েছিলেন।
‘এখন তো তো তোরাই বল, এই ব্যাটাকে কী শা শা শাস্তি দেওয়া যায়?’ আলতাফ ভাই রাগে তোতলা হয়ে গেছেন।
আমাদের মধ্যে একজন বললো, ‘নাপিত এনে ওর মাথা ন্যাড়া করে দিলে কেমন হয়?’
আলতাফ ভাই হুংকার দিয়ে বললেন, ‘সাবাস! নি নি নিমাইকে এখুনি ডেকে নিয়ে আয়।’