মেয়ের মতি গতি ভালো লাগে না জাহানারার। তাকে বহুবার সাবধান করেছেন তিনি। কিন্তু শারমিন অসম্ভব একরোখা। তার ধারণা, মা তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। মেয়ে কখন কোথায় যায়, কি করে এসব নিয়ে এ যুগের মায়েদের এত কৌতূহল থাকা উচিৎ নয়। এমন তো নয় যে, মেয়ে এখনো ছোট আছে! শারমিন এখন বিবিএর ছাত্রী। নিজের ভালো মন্দ বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার।
কিন্তু মেয়ের এই বয়সটাই জাহানারার আতংকের কারণ। শারমিনের বাবা মারা গেছে ওর ছয় বছর বয়সের সময়। তারপর থেকে জাহানারা মেয়েকে নিয়ে প্রায় একা সংগ্রাম করে চলেছেন। আক্ষরিক অর্থেই একা। কাউকে পাশে পাননি তিনি। শ্বশুর শাশুড়ি, দেবর ননদ সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নিজের বাবা মা অনেক আগে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। একমাত্র ছোটভাই আফজাল মালয়েশিয়া থাকে। সে এখনো বিয়ে করেনি। ভগ্নিপতির মৃত্যুর পর সে প্রতি মাসে মালয়েশিয়া থেকে কিছু টাকা পাঠায়। সে না থাকলে যে কি হতো, ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে জাহানারার। কিন্তু ভাইয়েরও বয়স হয়েছে। বিয়ে-থা করে সংসার করার সময় হয়েছে তার। জাহানারা টাকা পাঠাতে নিষেধ করলেও সে শোনে না। আফজাল ভালো করেই জানে, তার ভগ্নিপতি মৃত্যুর সময় কি রেখে গেছে। ব্যাংকে সামান্য ক’টা টাকা আর কুমিল্লার গ্রামের বাড়িতে স্বার্থপর কিছু আত্মীয়স্বজন। শারমিনের পড়াশুনার জন্য তার বোনকে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করে জাহানারা যে বেতন পান, তা’ বাসার ভাড়া দিতেই শেষ হয়ে যায়। ফোনে কথা বলার সময় আফজাল একটা কথাই শুধু বলে, ‘বুবু, তোমার মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে যখন চাকরি করবে, তখন থেকে আর টাকা পাঠাবো না। তোমার ছেলে নাই তো কি হয়েছে? শারমিন তোমার ছেলের কাজ করবে, দেখো।’
জাহানারা শাড়ির আঁচলে চোখ মোছেন। ভাইটা বিদেশে থাকে। দেশে থাকা ভাগ্নির খবর সে জানে না। জাহানারা জানাতেও চান না। ক’দিন আগে ডাকযোগে একটা চিঠি পেয়েছেন তিনি। নাম ঠিকানাবিহীন কেউ একজন লিখেছে, “ আপনার মেয়ে মাদকাসক্ত। তার কিছু মাদকাসক্ত ছেলে বন্ধু আছে। তারা উত্তরার একটা বাসায় বসে একসাথে নেশা করে। এ ছাড়া, আপনি কিভাবে নেবেন জানিনা, আপনার মেয়ে নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য আজকাল পর্ণো ভিডিও করছে। তার কিছু স্টিল পর্ণো ছবি আমি এই চিঠির সাথে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু আপনি একজন মা বলে আপনার সম্মান রক্ষার্থে সেটা করলাম না। অতি দ্রুত আপনি যদি আপনার মেয়েকে মাদকের থাবা থেকে সরিয়ে আনতে না পারেন, তাহলে আপনার মান সম্মান এমনিতেই যাবে।”
চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে জাহানারা একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। সারা রাত ঘুম হয় না। এক কাজ দু’বার করে করেন, আবার জরুরী কাজের কথা ভুলে যান। কপালের দু’পাশ দপ দপ করে। স্কুলে এক সপ্তাহ ধরে যান না। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি অসুস্থ। ঘরের দেয়ালে ঝোলানো স্বামীর হাস্যোজ্জল ছবির নিচে দাঁড়িয়ে তিনি নিঃশব্দে কাঁদেন।
মেয়ের খিটখিটে মেজাজের কারণে তার সাথে কথা বলতে জাহানারার ভয় হয়। তিনি মেয়ের অনুপস্থিতিতে চিঠিটা তার বিছানার ওপর রেখে এসেছেন। কিন্তু দু’দিন চলে গেলেও শারমিন চিঠির প্রসঙ্গে কিছু বলে না। তার আচরণ ও চলাফেরা আগের মতোই। সকালে বা দুপুরে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে, ফেরে অনেক রাতে। যে বা যারা তাকে বাসার সামনে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে যায়, তাদের একদিনও দেখতে পান না জাহানারা। তারা কেউ গাড়ি থেকে নামে না।
শারমিনের মোবাইল ফোন সারাদিন অফ থাকে। জাহানারা মেয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন না। সম্ভবতঃ তার একাধিক সিম আছে, যা দিয়ে সে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করে। রাতে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে সে মোবাইল ফোনে অনর্গল কথা বলে। কোন কোন দিন সারা রাত কথা বলে। কখন ঘুমায় আর কখন ওঠে, সাত সকালে স্কুলে চলে যাওয়ার কারণে জাহানারা টের পান না। বুয়া জমিলা বলে, ‘আফা আইজ দশটায় উঠছে।’ কোনদিন বলে, ‘আপনে আওনের বিশ মিনিট আগে গ্যাছে গা। নাস্তা খায় নাই।’ জাহানারার হাতঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা বাজে।
এক সপ্তাহ স্কুলে না যাওয়ায় জাহানারা জমিলার কথার সত্যতা খুঁজে পান। কিন্তু মেয়েকে কিছু বলতে তাঁর ভয় লাগে। সাংঘাতিক চড়া মেজাজ তার। মাঝে মাঝে বাসা থেকে চলে যাওয়ার ভয় দেখায় সে। জাহানারা নিজে ওরকম নন। ওর বাবাও ওরকম ছিল না। রোড এ্যাকসিডেন্টে গুরুতর আহত হয়ে জ্ঞান হারানোর পর হাসপাতালে যখন তার জ্ঞান ফিরলো, তখন জাহানারাকে শিশুকন্যা কোলে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অত কষ্টের মধ্যেও তার মুখে মৃদু হাসি। সেই হাসি চিরতরে মিলিয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। আজও জাহানারার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য।
কিন্তু মেয়েটা এমন হলো কেন, কে জানে? তবে কি ওসব বিষ খেয়েই ওর এই অবস্থা? চিঠিতে আর যেসব কথা লেখা আছে, তা’ যদি সত্যি হয় তো...........! জাহানারার চিন্তাভাবনা ভোঁতা হয়ে যায়। কি করবেন এখন তিনি? কি করে বাঁচাবেন মেয়েকে? এসব লজ্জার কথা কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। স্কুলের সহকর্মী শিক্ষিকারা ছাড়া শেয়ার করার মতো জাহানারার আছেই বা কে? কিন্তু তারা এসব জেনে ফেললে কি কেলেঙ্কারি হবে, কে জানে? এ ধরণের মুখরোচক কাহিনী বাতাসের আগে ছড়ায়।
দু’সপ্তাহ পর আবার একটা চিঠি এলো। “আপনি সম্ভবতঃ আমার প্রথম চিঠির কথাগুলো বিশ্বাস করেননি। তাই এবার আপনার মেয়ের কয়েকটা ছবি পাঠালাম। মনে হয়, এবার বিশ্বাস করবেন। ভয় নেই, ব্ল্যাকমেইল করার জন্য ছবিগুলো পাঠাইনি। কারণ আমি জানি, টাকা পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা আপনার নাই। আমিও শারমিনের মতো মাদকাসক্ত। কিন্তু ওর মতো উন্মাদ নই। তাই যৎসামান্য বিবেকের তাড়নায় এই শেষ চিঠিটা পাঠালাম। আগে আমি শারমিনকে ভালবাসতাম, এখন ঘৃণা করি।”
জাহানারা তিন দিন ধরে উদভ্রান্তের মতো সিএনজি নিয়ে উত্তরার সবগুলো সেক্টর চষে বেড়াচ্ছেন। তাঁর নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই। সিএনজির ভেতর থেকে তিনি উত্তরার বিশাল বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। কখনো কখনো সিএনজি থেকে নেমে কোন বাড়ির গেটের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর আবার গাড়িতে উঠে বলেন, ‘চলো।’
সিএনজি চালক মহা বিরক্ত। বলে, ‘খালাম্মা, কই যাইবেন ঠিক মতো কন না ক্যান?’
জাহানারা নিজেই তো জানেন না, তিনি কোথায় যাবেন? আজ তিন দিন হলো শারমিন বাসায় ফেরেনি। সে যেখানে আছে, জাহানারা সেখানে যেতে চান।
************************************