ডাক বিভাগে চাকরি পেয়ে জয়পুরহাট পোস্ট অফিসে ট্রেজারার পদে জয়েন করলাম ১৯৮০ সালে। আমি তখন পঁচিশ বছরের তরুণ।
জয়পুরহাট তখন থানা সদর। গ্রামীণ সংস্কৃতির আড়মোড়া ভেঙে ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকা ছোট্ট একমুঠো শহর। ধানহাটী নামে একটা বাজার আর শহর সংলগ্ন সুগার মিলকে কেন্দ্র করে মানুষের যা কিছু চাঞ্চল্য। শহরের বুক চিরে একটাই পাকা রাস্তা। পোস্ট অফিসসহ দু’চারটি সরকারি ভবন পাকা, বাকি সব টিনের ঘরবাড়ি। শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও বেশির ভাগ বাড়ি ও দোকানপাটে তখনো হারিকেন ও কূপিবাতির দাপট।
রাজশাহী বিভাগীয় শহর থেকে আত্মীয়স্বজনহীন এই নির্জীব শহরে এসে আমি মনমরা হয়ে পড়লাম। সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও থাকার মতো কোন মেস বা ঘর ভাড়া পাওয়া গেল না। আসলে এ ধরনের আধা গ্রাম, আধা শহরের মতো জায়গায় তখনো বহিরাগতদের জন্য মেস বা ঘর ভাড়া দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
প্রথম কয়টা দিন অফিসের মধ্যে দুটো টেবিল জোড়া দিয়ে তার ওপর শুয়ে রাত কাটালাম। রাস্তার ধারে নোংরা রেস্টুরেন্টে খেয়ে আমার পেট নেমে গেল। অফিসের টয়লেট আমি নিজেও নোংরা করে ফেললাম।
দয়ামায়াহীন পোস্টমাস্টার বললেন, ‘ট্রেজারার সাহেব, সরকারি অফিসে এভাবে রাতে শুয়ে থাকা ঠিক হচ্ছেনা। অফিসে ক্যাশ স্ট্যাম্প থাকে। উনিশ বিশ কিছু হলে আপনিও ফেঁসে যাবেন, আমাকেও বিপদে ফেলবেন।’
কথা ঠিক। কিন্তু আমি তো নিরুপায়।
আমার এই দুরবস্থার কথা অফিসের সব স্টাফই জানতো। আমার একটা থাকার ব্যবস্থার জন্য অনেকেই চেষ্টা করছিল। তাদের মধ্যে মোজাম্মেল নামে এক পোস্টম্যান একদিন অফিস টাইমের পর আমাকে নিয়ে গেল শহরের কাছাকাছি একটা জায়গায়। জায়গাটা পুরোদস্তুর গ্রাম। সঙ্গত কারণে গ্রামটির নাম আমি বলছি না।
মোজাম্মেলের ভায়রা কফিলউদ্দিন এই গ্রামের মোড়ল। আমার দুরবস্থার কথা শুনে তিনি তার বাড়ির সামনের দিকে একটা টিনের ঘর ভাড়া দিতে রাজি হয়েছেন। ভাড়া দেড়শো টাকা। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা আমার নিজের। আর যেহেতু গ্রামে সমাজ আছে এবং আমি যুবক ছেলে, সেহেতু আমাকে একটু হিসাব করে চলতে হবে। মোড়লের যেন কোন বদনাম না হয়।
সরকারি চাকরি সোনার হরিণ। আমি সব শর্তে রাজি হয়ে পরদিনই সুটকেস হাতে চলে এলাম। ঘর ভর্তি আউড়ের পালা। কামলা ডেকে সেসব অন্যত্র সরিয়ে ঝাড় দিয়ে ঘর সাফ করে দেয়া হল। ঘরের দুই দরজার একটি দিয়ে বাড়ির ভেতর যাওয়া যায়। বাড়ির ভেতর থেকে শেকল তুলে তালা দিয়ে সেটি বন্ধ করে দেয়া হল। কফিলউদ্দিন দয়াপরবশ হয়ে আমার শোয়ার জন্য বাড়ির ভেতর থেকে একটা ঘুণে ধরা কাঠের চৌকি বের করে দিলেন। আমি বাজার থেকে কেরোসিনের চুলা, হাঁড়ি পাতিল, চাল ডাল সব কিনে নিয়ে এলাম।
নিজে কোনদিন রান্না করে খাইনি। রাঁধতে গিয়ে হাত পোড়ালাম। গরম তেল পায়ে পড়ে ফোস্কা উঠলো। কোনদিন ভাত হল চালপোড়া, কোনদিন হল হালুয়া। ডিম ভাজতে গিয়ে উল্টে ফেলে দিলাম চুলায়। রান্না করার আতংকে কোন কোনদিন দোকান থেকে কেনা কলা আর বানরুটি খেয়ে রাত পাড়ি দিলাম।
এভাবে দিন পনের যাওয়ার পর একদিন অফিস থেকে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে দেখি, মেঝেতে একটা ছোট মাদুরের ওপর পরিস্কার গামলা ও বাটিতে কিছু খাবার ঢেকে রাখা। ঢাকনা খুলে দেখি, গরম ভাত, ডিমের তরকারি আর একমুঠো ডাল ভর্তা। পাশে একটা চিরকুটে কাঁচা মেয়েলী হাতে লেখাঃ হাত পুড়িয়ে রান্না করার দরকার নাই। মেয়েদের কাজ ছেলেরা পারেনা। আব্বাকে বলবেন না। বললে আমার যা হয় হবে, আপনাকে ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দেবে। মনে থাকে যেন।
দেখলাম, ঘরে নতুন দড়ি টানিয়ে তার ওপর আমার প্যান্ট শার্ট, গামছা লুঙ্গি সব সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। বিছানার চাদর টান টান। ঘরের মেঝে ঝকঝকে, তকতকে। বুঝলাম, মোড়লের মেয়ের কাজ। বাড়ির ভেতর দিকের দরজা খুলে ঘরে ঢুকে সে এসব করেছে। আমার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো।
পরদিন সকালে সুটকেস থেকে একটা খাতা বের করে তাতে লিখলাম, এসব না করলে ভাল হয়। জানাজানি হলে সমস্যা হবে।
খাতাটা ওভাবেই বিছানার ওপর রেখে আমি ঘরে তালা দিয়ে অফিসে চলে গেলাম।
সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে হারিকেন জ্বালিয়ে দেখি মেয়েটি আবার রান্না করে রেখেছে। খাতায় আমার লেখার নিচে লেখাঃ ভীতুর ডিম!
মেজাজ খাট্টা হয়ে গেল। ওর লেখার নিচে লিখলামঃ ভয় দেখালেন আপনি, আর এখন আপনিই বলছেন ভীতুর ডিম? বেশ বেশ।
পরদিন মেয়েটি কিছু লিখলো না। আমি লিখলামঃ আপনারা কয় ভাই বোন? আপনি কি বিবাহিতা?
মেয়েটি লিখলোঃ হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিনা। আমাকে বিয়ে করবে কে? আমার কোন ভাই বোন নেই। শুধু দাদি আছে। আমার জন্মের সময় মা মারা গেছেন। সৎ মা পাওয়ার ভাগ্য হয়নি। কিন্তু আপনি এসব জানতে চাচ্ছেন কেন? বেশি জানা ভাল না। তরকারিতে ঝাল লবণ ঠিক হচ্ছে তো?
দুষ্টামি বুদ্ধি মাথায় চাপলো। আমি লিখলামঃ দুটোই বেশি বেশি। একটু কম হলে ভাল হয়।
গ্রামের মেয়ে। আমার লেখার তাৎপর্য বুঝল না। পরদিন তরকারিতে ঝাল লবণ দুটোই বেশ কম হল। খাতায় লিখলামঃ আমি তরকারির ঝাল লবণের কথা বলিনি। আপনার নিজের ঝাল লবণের কথা বলেছি। আপনার নামটা কিন্তু আমার এখনো জানা হয়নি। ওটাও ঝাল ঝাল নয় তো?
উত্তরে মেয়েটি লিখলোঃ আমার ঝাল লবণ তো কেউ চেখে দেখেনি। আপনি একটা ফাজিল লোক। আমার সঙ্গে ফাজলামো করবেন না। ফাজলামো করলে নাম বলব না।
এরপর কিছুদিন আর লেখালেখি নেই। কিন্তু রান্নাবান্না, ঘর গোছানো সব ঠিক মতই চলছে। সত্যি বলতে কি, প্রেমঘটিত একটা দুর্ঘটনা আমার জীবনে আগে একবার ঘটে যাওয়ার পর থেকে নতুন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে আমার প্রচণ্ড অনীহা ছিল। মেয়েদের আমি যথাসম্ভব এড়িয়েই চলতাম।
অফিস থেকে ঘরে ফিরে রাতে বিছানায় শুয়ে হারিকেনের আলোয় আমি খাতার লেখাগুলো পড়ি। সে শুধু সময় কাটানোর জন্য। মেয়েটিকে আজ পর্যন্ত চোখে দেখিনি। অবস্থাপন্ন বাপের একমাত্র মেয়ে। বিয়ে হয়নি কেন কে জানে? মাঝে মধ্যে আমার সতর্ক চোখ খুঁজে বেড়ায় তাকে। কিন্তু মেয়েটি যেন দৃশ্যমান জগতে এক অদৃশ্য রহস্যময় মানবী।
এভাবে প্রায় তিন মাস কেটে গেল। কাজে যোগদানের পর পরই আমি রাজশাহীতে বদলির জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলাম। এখানে আমার কষ্টের কথা জানিয়ে রাজশাহীর পোস্টমাস্টার জেনারেলের অফিসে তদবির করার জন্য বাড়িতে বড় ভাইয়ের কাছে চিঠিও লিখেছিলাম। তখন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার এত রমরমা ছিল না। মোবাইল ফোনের তো প্রশ্নই ওঠে না।
বড়ভাই আপ্রাণ চেষ্টা করে ঠিক তিন মাসের মাথায় আমার ট্রান্সফার অর্ডার বের করে ফেললেন এবং আমাকে চিঠি দিয়ে জানালেন।
সেদিন খুশি মনে ঘরে ফেরার পর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। মেয়েটির সঙ্গে আমার কথাবার্তার সেই খাতার মধ্যে একটা সাদা কালো ছবি পেলাম। নিষ্পাপ চেহারার সুন্দর একটি মেয়ে। কাজল টানা দীঘল চোখে বিষণ্ণ দৃষ্টি। বয়স আঠারো উনিশ হবে। খাতায় লেখাঃ আপনি তো চলেই যাবেন। যাওয়ার আগে ছবিতে আমাকে দেখে যান। ছবির উল্টো পিঠে আমার নাম লেখা আছে। ছবিটা নিয়ে যাবেন না কিন্তু।
মনে হল, আমি বৈদ্যুতিক শক খেলাম। আমি চলে যাবো এটা এই মেয়ে জানলো কিভাবে? বদলির কথা তো আমার জয়পুরহাট অফিসের লোকজনই এখনো জানেনা। ইনটুইশন? থট রিডিং? ছবিটা উল্টে দেখলাম গোটা গোটা হরফে লেখা, নার্গিস।
এক সপ্তাহের মধ্যে আমার ট্রান্সফার অর্ডার চলে এলো। সকাল দশটার মধ্যে নতুন ট্রেজারারের কাছে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। দুপুর সাড়ে বারোটায় রাজশাহী যাওয়ার ট্রেন। বাড়ি ফেরার আনন্দে আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ঘরে ফিরে দেখি, বিছানার ওপর একটা কাঠের ট্রেতে পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখা দুটো সন্দেশ আর এক গ্লাস পানি। পাশে রাখা খাতায় লেখাঃ কাল বিকেলে আমাকে বিয়ে না করার জন্য এক ছেলে তার অভিভাবকসহ দেখতে এসেছিল। এই প্রথম আমাকে কেউ দেখতে এলো। তাদের আনা মিষ্টি থেকে আপনাকে দুটো সন্দেশ দিলাম। আশা করি, যাওয়ার আগে খেয়ে যাবেন।
বিয়ে না করার জন্য ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিল? এমন কথা কখনো শুনেছি বলে মনে পড়লো না। বুঝলাম, যে কোন কারণেই হোক ছেলেপক্ষ নার্গিসকে তাদের বউ করতে রাজি হয়নি। দেখতে তো মেয়েটি অসুন্দর নয়। সম্ভবত যৌতুক বা লেনদেনে বনিবনা না হওয়ায় বিয়ে ভেস্তে গেছে।
মনে মনে দুঃখ পেলেও বাড়ি ফিরে যাওয়ার আনন্দে আপাতত দুঃখবোধ ধামাচাপা পড়ে গেল। এখন মিষ্টি খাওয়ার সময় নাই। দ্রুত হাতে সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে সন্দেশ গুলো কাগজের ঠোঙায় ভরে সঙ্গে নিলাম। ট্রেনে বসে খাওয়া যাবে।
গোছগাছ শেষে বাড়ির মালিকের কাছে গেলাম বিদায় নিতে। কফিলউদ্দিন আমার হাঁড়ি পাতিল, থালাবাসন ও কেরোসিনের চুলা বস্তাবন্দি করে সঙ্গে দিতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘না, থাক।’ তার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে আড়চোখে খুঁজলাম মেয়েটিকে। কিন্তু না, কোথাও নেই সে। তবে কেন জানি আমার মনে হল, এ বাড়ির কোন না কোন আড়াল থেকে কাজল টানা দুটি দীঘল চোখে সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে প্ল্যাটফরমে অপেক্ষা করছিল মোজাম্মেল। ট্রেন আসার দেরি আছে দেখে ওর সাথে গল্প করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার ভায়রার মেয়েটির বিয়ে হচ্ছেনা কেন? দেখতে তো সে ভালোই।’
মোজাম্মেল বলল, ‘বিয়ে কি করে হবে, স্যার? মেয়ে যে বোবা, মুখে জবান নাই। একটা বোবা মেয়েকে জেনে শুনে কে বিয়ে করবে স্যার, বলেন?’
ট্রেন আসার ঘণ্টা পড়লো। মনে হল, আমার হৃৎপিণ্ডটাকে ঘণ্টা বানিয়ে আঘাত করলো কেউ। মোজাম্মেল মাথা নিচু করে বলল, ‘বহু চেষ্টা তদবির করে গতকাল বগুড়ার এক ছেলে পক্ষকে আনা হয়েছিল মেয়ে দেখাতে। মেয়ে তো তাদের এক দেখাতেই পছন্দ। কিন্তু মেয়ে বোবা শুনে তারা আর এক মিনিটও বসেনি। আমার ভায়রা পাঁচ বিঘা ধানী জমি লিখে দিতে চাইলো। তাতেও রাজি হল না।’
আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে গেল মোজাম্মেল।
চলন্ত ট্রেনে অনেকক্ষণ পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীর মতো আমি বসে রইলাম। হাতে ধরা ঠোঙা থেকে একটা সন্দেশ বের করে দেখে মনে হল, এই সন্দেশের স্বাদ তেতো। নিম পাতার রসের চেয়েও তেতো। এই সন্দেশ খাওয়া যাবেনা। মনে মনে বললাম, ‘নার্গিস, আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। দুঃখিত।’ ট্রেনের জানালা দিয়ে সন্দেশসহ ঠোঙাটা ফেলে দিলাম বাইরে।
নার্গিসের সাথে আমার কথা বিনিময়ের সেই খাতাটা সুটকেস থেকে বের করে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। ঝাপসা চোখে কষ্ট করে খুঁজে বের করে আবার পড়লাম মেয়েটির সেই লেখাটা, আমাকে বিয়ে করবে কে?
***
এই লেখাটি মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকার নভেম্বর, ২০১১ মিষ্টি (দ্বিতীয় পর্ব) সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা এটি পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম। ধন্যবাদ।